বিশেষজ্ঞ মত
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে তার দল বিএনপিসহ বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সময়োচিত বক্তব্য দিয়েছেন উল্লেখ করে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, তার আগমনে অভূতপূর্ব নবজাগরণ তৈরি হয়েছে।
তিনি যে ভাবনার কথা বলেছেন তাতে মানুষ নতুন আশার আলো দেখতে পেয়েছেন। তরুণ প্রজন্মকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি। জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। তবে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে উল্লেখ করে এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তার বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও মা খালেদা জিয়ার মতো প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তারা।
দীর্ঘ ১৭ বছরের নির্বাসন শেষে তারেক রহমান গত বৃহস্পতিবার দেশে ফেরেন। ফেরার পর জনতার মহাসমুদ্র তাকে স্বাগত জানায়। বক্তব্য দেওয়ার সময় তিনি মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা লুথার কিং জুনিয়রের আদলে দেশ নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রত্যাশিত বাংলাদেশ গড়ে তোলার কথা বলেছেন।
দেশে ফেরার দ্বিতীয় দিনে তারেক রহমান গতকাল জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে। আজ তিনি শহীদ শরীফ ওসমান হাদির কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এছাড়া নির্বাচন কমিশনে যাবেন ভোটার হওয়ার জন্য। বিএনপির তরফ থেকে আগেই জানানো হয়েছে তারেক রহমান আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের নেতৃত্ব দেবেন। তিনি বগুড়া-৬ আসনে বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচন করবেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে এক অভূতপূর্ব নবজাগরণ বলে উল্লেখ করেন বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক এম শহীদুজ্জামান। আমার দেশকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, সত্যিকার অর্থে নতুন করে আমরা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। বাংলাদেশে যে একটি নেতৃত্বের শূন্যতা ছিল তার অনেকটাই পূরণ হয়েছে তারেক রহমানের দেশে ফেরার মাধ্যমে। তারেক রহমান তার বক্তৃতায় যা বলেছেন, তা এ দেশের কোটি কোটি মানুষের আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। তিনি মার্টিন লুথার কিংকে উদ্ধৃত করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে নতুন বাংলাদেশ গড়ার এক স্বপ্ন দেখিয়েছেন। মনে হয়েছে তিনি হৃদয় থেকে কথা বলেছেন। তাই সেখানে কোনো ঘৃণা ও প্রতিহিংসা দেখা যায়নি। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি এক নতুন আইকন। তবে তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। যেমন চ্যালেঞ্জ দেখেছি তার বাবা জিয়াউর রহমানের সময়েও। জিয়াউর রহমান তার দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়েছিলেন। তারেক রহমানও তার নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সেই ধরনের প্রজ্ঞার পরিচয় দেবেন বলে বিশ্বাস করি।
আগামী দিনের পররাষ্ট্র নীতির কথা তুলে ধরে এম শহীদুজ্জামান বলেন, পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছে জাতীয় স্বার্থ। এর বাইরে অন্য কিছু নেই। বিএনপির অন্যান্য শীর্ষ নেতার মাঝে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ করে ভারতনীতি কী হবে তা নিয়ে সমস্যা আছে। যারা ভারতের প্রভাবে বশীভূত তাদের পাশে সরিয়ে রেখে তারেক রহমান বাংলাদেশের একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি তৈরি করতে সক্ষম হবেন বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। তারেক রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশের নতুন এক যাত্রা শুরু হোক এটাই আমার প্রত্যাশা।
তারেক রহমানের স্বদেশে ফিরে আসাকে দল হিসেবে বিএনপি এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলে মনে করেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী। আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং গোষ্ঠীর মধ্যে অনৈক্য ও দূরত্ব বেড়েই চলেছে ঠিক সেই মুহূর্তে দেশে ফিরে জাতীয় ঐক্যের কথা শুনিয়েছেন তারেক রহমান। তিনি কাউকে ছোট করেননি।
তারেক রহমান সবার কথা স্মরণ করেছেন উল্লেখ করে এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, জুলাই বিপ্লবকে বিএনপি ধারণ করে কি নাÑএমন প্রশ্ন গত এক বছরে উঠতে শুরু করেছিল। কারণ দলটির কিছু প্রভাবশালী নেতা জুলাই বিপ্লব নিয়ে এমন কিছু মন্তব্য করেছেন যা সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। কিন্তু তারেক রহমান বক্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন— তিনি ও তার দল জুলাই বিপ্লবকে সত্যিকার অর্থে ধারণ করেন।
তিনি আরো বলেন, তারেক রহমান যে ঐক্যের কথা বলেছেন— তা তিনি কাজে পরিণত করে দেখাবেন বলে আমরা প্রত্যাশা করি। তিনি যদি ভোটের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পান তাহলে তার উচিত হবে প্রথমেই বিরোধী দলের সঙ্গে বসে তাদের আস্থায় নেওয়া, দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের ভূমিকাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। যোগ্য বাবা-মায়ের যোগ্য সন্তান হিসেবে তারেক রহমান আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহবুব উল্লাহ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, পরিকল্পনার বিষয়টি বিস্তারিতভাবে জানা না গেলে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। তবে সার্বিকভাবে প্রথম দিনে উনাকে ইতিবাচক মনে হয়েছে। আমরা দেখি রাজনৈতিক নেতারা তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে আক্রমণাত্মক মন্তব্য করে থাকেন। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্যে আমরা তা দেখিনি। এদিক থেকে তিনি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন। জনগণের প্রত্যাশিত বক্তব্য দিয়েছেন। তারপরও মানুষের তো নানারকম জিজ্ঞাসা থাকে। এগুলো নিয়ে আগামী দিনে যখন কথা বলবেন তখন পরিষ্কার হবে। এ নিয়ে এখন বিস্তারিত মন্তব্যের সুযোগ এই মুহূর্তে নেই। দেশবাসী বিশাল আবেগ নিয়ে ১৭ বছর পর উনাকে রিসিভ করেছেন। সেই আবেগের একটা মর্যাদা তো দিতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তারেক ফজল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তারেক রহমানের যে পরিকল্পনা তা আগেই মোটামুটি বিস্তারিতভাবে উপস্থাপন করেছেন। আমরা জানি প্রথমে তিনি ২৭ দফা দিয়েছিলেন। পরে যুগপৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মিলে ৩১ দফা দিয়েছেন। এটাকে তার এবং তাদের দলের পরিকল্পনা বলা যেতে পারে। ওই পরিকল্পনায় আমরা বেশকিছু ভালো এবং সাহসী ঘোষণা দেখেছি। তবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন উপস্থাপিত প্রস্তাবের তুলনায় তারেক রহমানের পরিকল্পনা পুরো মাত্রায় এগিয়ে আছে বলে বলা যায় না। ঐকমত্য কমিশনের তুলনায় তাদের পরিকল্পনা সামান্য হলেও পিছিয়ে রয়েছে বলে দাবি করা যেতে পারে। বিএনপির নোট অব ডিসেন্টও এর প্রমাণ দেয়।
তিনি আরো বলেন, অনেক দিন পরে মজলুম নেতা হিসেবে তারেক রহমান দেশে ফিরে এসেছেন। তার জন্য দেশবাসীর বড় ধরনের মনোযোগ তৈরি হয়েছে। তার নিজের যেমন একটি বড় দল আছে, তেমনি তার পিতা ও মায়ের প্রতি দেশের মানুষের ভালোবাসা রয়েছে। এ হিসেবে তার প্রতিও মানুষের একটি দরদ রয়েছেÑগণসংবর্ধনায় তার প্রকাশ আমরা দেখেছি।
তারেক রহমানের পরিকল্পনাকে নতুন বলা যাবে না উল্লেখ করে এই অধ্যাপক বলেন, তিনি যে প্লানের কথা বলেছেন তাকে আমরা নতুন বলতে পারি না। কারণ এ বিষয়ে জনগণ ও বিশ্ববাসী অবগত রয়েছেন। তবে বড় কথা হচ্ছে তিনি নিজেই দেশের মাটিতে এসে পরিকল্পনার কথা উচ্চারণ করেছেন। উচ্চারণ করেছেন মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা লুথার কিং জুনিয়রের মতো করে। তবে তার সামগ্রিক পরিকল্পনাকে আরো দৃঢ় ও মজবুত করার সুযোগ রয়েছে। কারণ উন্নত মানুষ গড়ে তোলার জন্য তাদের পরিকল্পনায় পর্যাপ্ত উপাদান আছে তা বলার সুযোগ কম। উন্নত রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য তাদের আরো আপগ্রেড করার সুযোগ রয়েছে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সাহাবুল হক বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দীর্ঘ ১৭ বছর দেশের বাইরে অবস্থান করেছেন। অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই কোনো রাজনীতিক দীর্ঘদিন জেলে বা নির্বাসনে থাকলে দেশ নিয়ে ভাবনার সময় পান। দীর্ঘদিন বিদেশে নির্বাসনে থাকার কারণে তারেক রহমানও দেশ নিয়ে ভাবনার অফুরন্ত সময় পেয়েছেন। তার মনে দেশকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। বিদেশে থাকার সময়টাতে উনি রাজনীতিতে ভার্চুয়ালি সক্রিয় ছিলেন যার কারণে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে তিনি অবগত রয়েছেন।
তিনি বলেন, লন্ডনের মতো একটা উন্নত শহরে অবস্থান করে তারেক রহমান সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। ফলে এই দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য তার মধ্যে এক ধরনের আগ্রহের তৈরি হয়েছে, সেটিই তিনি তার ভাষণে বলেছেন। আমরা আশা করব তিনি যে প্ল্যান মনের মাঝে লালন করেছেন তা বাস্তবে রূপ দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হবেন।