মাঝেমধ্যেই আমাদের কানে আসে- আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পরিবার, প্রতিবেশী বা সহকর্মীর মধ্যে অমুক অসুস্থ। হাসপাতাল, ক্লিনিক কিম্বা বাড়ি, আমরা সেখানে তাকে দেখতে যাই। সান্তনা সহযোগিতা প্রকাশ করি। নিশ্চয়ই এই মানসিকতা ও আচরণ কাম্য ও প্রশংসনীয়। এতে অসুস্থ ব্যক্তির মাঝে মনোবলের সঞ্চার হয়। হতাশা আর নিরাশা দূর হয়ে সে পায় মানসিক শক্তি।
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বনি আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি আপনাকে কীভাবে দেখতে যাব? আপনি তো বিশ্বজাহানের রব! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে।’ (মুসলিম : ২৫৬৯)
তবে রোগীর সাক্ষাতে যেতে আমাদের কিছু আদব ও সুন্নাহ সম্পর্কে অবগত থাকা জরুরি। যেন ভদ্রতা ও সামাজিকতা রক্ষার পাশাপাশি হাদীসে বর্ণিত অসুস্থের সাথে সাক্ষাতের শিষ্টাচারগুলো পালন করতে পারি এবং ফজিলতগুলো অর্জন করতে পারি। রোগীর সাক্ষাতে গেলে আমরা যে ফজিলত লাভে ধন্য হতে পারি:
১. রোগীর পাশে থাকা মানে জান্নাতের ফল আহরণ করা। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো মুসলিম ব্যক্তি তার অসুস্থ মুসলিম ভাইকে দেখতে গেলে সে (যতক্ষণ তার কাছে অবস্থান করে ততক্ষণ) যেন জান্নাতের ফল আহরণ করতে থাকে।’ (তিরমিজি : ৯০৯)।
২. রোগীর সাক্ষাতে যাওয়া ব্যক্তি সকাল- সন্ধ্যা সত্তর হাজার ফেরেশতাদের দোয়া প্রাপ্তে ধন্য হয় এবং জান্নাতে একটি ফলের বাগান লাভ করেন। আলী (রা.) বলেন, ‘আমি আল্লাহর রাসূল (সা.) কে বলতে শুনেছি, কোনো মুসলমান অপর (অসুস্থ) মুসলমানকে সকালে দেখতে গেলে- তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা সন্ধ্যা পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে। যদি সে সন্ধ্যাবেলা দেখতে যায়, তাহলে সত্তর হাজার ফেরেশতা তার জন্য ভোর পর্যন্ত দোয়া করতে থাকে এবং জান্নাতে তার জন্য একটি ফলের বাগান তৈরি করা হয়।’ (তিরমিজি : ৯১১)।
৩. আসমানের ফেরেশতার উত্তম ও কল্যাণকর দোয়ার অংশীদার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন হয়। হাদিসে এসেছে, ‘কোনো ব্যক্তি অসুস্থ রোগীকে দেখতে গেলে আকাশ থেকে একজন আহ্বানকারী বলে, তুমি উত্তম কাজ করেছ, তোমার পথচলা কল্যাণকর হোক এবং তুমি জান্নাতে একটি বাসস্থান নির্ধারণ করে নিয়েছ।’ (ইবনে মাজাহ : ১৪৪৩)।
৪. অসুস্থ ব্যক্তির দোয়া কবুল হয়। তাই সাক্ষাতকার ঈদ জন্য দোয়া কবুলের মুহূর্ত ও মাধ্যমের পথ উন্মোচিত হয়। উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি কোনো অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গেলে তাকে তোমার জন্য দোয়া করার অনুরোধ করবে। কেননা, তার দোয়া ফেরেশতাদের দোয়ার মতোই। (ইবনে মাজাহ : ১৪৪১)।
আমরা অসুস্থের সাথে সাক্ষাতের সংকল্পে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা ও বিধিনিষেধ মেনে চলবো। রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে এই বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিবো। সাক্ষাতের সময়, লোকসংখ্যা ইত্যাদি বিষয়ে রোগীর পরিচর্যায় নিয়োজিত ব্যক্তি থেকে সাক্ষাতের পূর্বেই পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করবো। রোগীর সংক্রামক ব্যাধি হলে সাক্ষাতে অবশ্যই সাক্ষাতকারী সতর্কতা ও নিজের সুরক্ষার ব্যবস্থা অবলম্বন করবে।
খাদ্যদ্রব্য নিতে হলে রোগীর জন্য উপযুক্ত খাবার নিবো। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, রোগী যদি কিছু খেতে চায় তবে তাকে খেতে দেওয়া উচিত। (বোখারি : ১০/১১৮)।
রোগীর সুরক্ষার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এজন্য সাক্ষাতের পূর্বে বাহির থেকে আগমনকারীর জন্য অযু হতে পারে পরিচ্ছন্নতার অনন্য মাধ্যম। তাছাড়া হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি উত্তমরূপে অজু করে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কোনো অসুস্থ মুসলমান ভাইকে দেখতে যায় তাকে জাহান্নাম থেকে ষাট বছরের পথ দূরে রাখা হবে।’ (আবু দাউদ : ৩০৯৭)।
রোগীর কাছে হৈচৈ বা উচ্চ আওয়াজে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, সুন্নত হলো রোগীর পাশে কম সময় বসা এবং উঁচু আওয়াজে কথা না বলা।
তবে কথা বলতে হলে ইতিবাচক ও আশাব্যঞ্জক বাক্য চয়ন করা। অসুস্থতা ও রোগের ব্যাপারে এমন মন্তব্য থেকে বিরত থাকা যা শুনে রোগী আতংকিত ও হতাশাগ্রস্থ হয়। রোগীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে তার সাথে কুশল বিনিময় ও কথাবার্তা বলা। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘শুশ্রষার পূর্ণতা হলো রোগীর কপালে বা শরীরে হাত রেখে জিজ্ঞেস করা, কেমন আছেন?’ (তিরমিজি : ৪/৩৩৪)। সেই সঙ্গে এই কথাও বলা 'লা-বা’সা তুহু-রুন ইনশাআল্লাহ।' অর্থাৎ ভয় নেই, আল্লাহর মেহেরবানিতে আরোগ্য লাভ করবেন ইনশাআল্লাহ। (বোখারি : ৫৬৬২)।
রোগীর দ্রুত আরোগ্যের জন্য হাদিসে বর্ণিত দোয়া পাঠ করা যেতে পারে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, কোন রোগীর কাছে গিয়ে নিম্নের দোয়াটি সাতবার পাঠ করলে, মৃত্যুরোগ ছাড়া সব রোগ থেকে সে সুস্থ হয়ে উঠবে। দোয়াটি হলো, ‘আসআলুল্লাহাল আযিম, রাব্বাল আরশিল আযিম, আই ইয়াশফিয়াক্ব।’ (আবু দাউদ : ৩১০৬)।
রোগীর অবস্থা বেগতিক হলে, মৃত্যুর আশঙ্কা সৃষ্টি হলে, তওবার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অবস্থা বিবেচনায় সুন্নাহ পদ্ধতিতে কালেমার তালকীন করা যেতে পারে।
রোগীর সাক্ষাত শেষে অপ্রয়োজনে কাল বিলম্ব না করে দ্রুত প্রস্থান করা। কেননা আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, রোগী দেখার সময় হলো উটের দুধ দোহন পরিমাণ। আরেক বর্ণনায় এসেছে, রোগী দেখার উত্তম পন্থা হলো তাড়াতাড়ি ফিরে আসা।