চলে গেলেন সৌদি আরবের গ্র্যান্ড মুফতি, দীর্ঘদিনের হজের খতিব ও সর্বোচ্চ উলামা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিশ্বখ্যাত আলেমে দ্বীন শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ। গত মঙ্গলবার (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ মোতাবিক ১ রবিউস সানি) সকালে ইন্তেকাল করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
জন্ম ও বেড়ে ওঠা
তিনি ১৯৪৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি পুণ্যভূমি পবিত্র মক্কা মোকাররমার ঐতিহ্যবাহী ‘আলে শায়খ’খ্যাত বনেদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আট বছর বয়সে বাবাকে হারান। শায়খ মুহাম্মাদ বিন সিনানের কাছে মাত্র দশ বছর বয়সে পুরো কোরআন মুখস্থ করেন।
জন্মলগ্ন থেকেই তিনি কিছুটা দৃষ্টিহীনতায় ভুগছিলেন। অতঃপর তার বয়স যখন বিশ, যখন জীবনের ঠিক নতুন একটি অধ্যায় শুরু করতে যাবেন, আল্লাহর অদৃশ্য ইশারায় সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে যান। চোখের নিভু নিভু আলোটুকু হারিয়ে ফেলার পরও থেমে থাকেনি ওহির জ্ঞান অন্বেষণের পথে তার অবারিত যাত্রা। অভীষ্ট লক্ষ্যে ছিলেন সদা অবিচল এবং অদম্যপ্রাণ। এভাবেই নিজেকে আসীন করেন একক অনন্য মাত্রায়।
পারিবারিক পরিচয়
তিনি ছিলেন বনি তামিম গোত্রীয় আলে মুশরিফ পরিবারের ধারার। সৌদি আরবে মুহাম্মাদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের (রহ.) বংশধরদের ‘আলে শায়খ’ অর্থাৎ ‘শায়খের বংশধর’ বলে বিশেষ সম্মান দেখানো হয়।
পড়াশোনা ও জ্ঞানার্জন
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তিনি ইলমে দ্বীন হাসিল করেন এবং নিজ চেষ্টা, প্রখর মেধা ও তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ততার মধ্য দিয়ে শরিয়তের নানা বিষয়ে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহিম আলে শায়খ (রহ.), গ্র্যান্ড মুফতি শায়খ আবদুল আজিজ বিন বাজ (রহ.) এবং সালেহ আল-মুরশিদ (রহ.)-এর মতো তৎকালীন শীর্ষ আলেমদের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেন।
রাজধানী রিয়াদে অবস্থিত ইমাম ইনস্টিটিউট অব সায়েন্টিফিক অ্যাডভোকেসিতে প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপর ১৯৬৪ সালে ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়াহ ফ্যাকাল্টি থেকে পড়াশোনা শেষ করেন।
কোরআনের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক
ইলমে দ্বীনের একনিষ্ঠ চর্চা, পাঠদান এবং ব্যক্তিগত আমলের মধ্যে ছিল অপূর্ব সমন্বয়। প্রতি তিন দিনে তিনি পূর্ণ এক খতম কোরআন পড়তেন। কোরআনকে তিনি নিপুণভাবে এবং যথারূপে আয়ত্ত করতে সক্ষম ছিলেন পূর্ণমাত্রায়। রাতের তাহাজ্জুদ এবং দীর্ঘ সময় নামাজে দাঁড়িয়ে কাটানো তার নিত্যকার অভ্যাস ছিল।
ঐতিহাসিক আরাফার খতিব
শায়খ আবদুল আজিজ আলে শায়খ (রহ.) রাষ্ট্রীয় আদেশে ১৯৮২ সালে ঐতিহাসিক আরাফার খতিব নিযুক্ত হন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত একাধারে ৩৫ বছর আরাফার ময়দানে অবস্থিত ঐতিহাসিক মসজিদে নামিরায় হজের খুতবা প্রদানের বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন। সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী তিনি ছিলেন আরাফার তৃতীয় খতিব।
সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি নির্বাচন
১৯৯৫ সালে তিনি সৌদি আরবের ডেপুটি গ্র্যান্ড মুফতি নিযুক্ত হন। এরপর ১৯৯৯ সালে এক রাষ্ট্রীয় ফরমানে গ্র্যান্ড মুফতি নির্বাচিত হন। সেই থেকে নিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত টানা ২৭ বছর রাষ্ট্রীয় গুরুদায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে সম্মানিত এই আসনটি অলংকৃত করেন। সৌদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা-পরবর্তী তিনি ছিলেন আরাফার তৃতীয় সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি।
রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন
১৯৮৭ সালে তিনি সৌদি আরবের শীর্ষ ওলামা কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ছিলেন মুসলিম ওয়ার্ল্ড লিগের সুপ্রিম কাউন্সিলের সভাপতিও। তিনি স্থায়ী গবেষণা ও ফতোয়া বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
মনীষীদের জন্য বিরল অবদান
পূর্ববর্তী মুসলিম মনীষীদের মধ্যকার যাদের রচনাবলি ও লেখনীর কাছে পুরো মুসলিম উম্মাহ চিরঋণী, এমনকি তৎকালীন সময়ে নানা প্রতিন্ধকতায় হজ করার সুযোগ না হওয়া মনীষীদের পক্ষ থেকে তাদের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি বদলি হজ করতেন। যেমন : ইমাম ইবনু হজম, ইমাম নববি, ইবনু আব্দিল বার, ইবনে রজব হাম্বলি এবং ইমাম মুনজিরি (রহ.)-এর মতো মহান ও জগদ্বিখ্যাত মনীষীদের পক্ষ থেকে তিনি পবিত্র হজ পালন করেন।
জানাজা ও দাফন
ইন্তেকালের দিন রাজধানী রিয়াদের ইমাম তুর্কি বিন আবদুল্লাহ মসজিদে তার জানাজা হয়। জানাজায় ইমামতি করেন মরহুমের ছেলে আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ। এতে সৌদির প্রধানমন্ত্রী ও ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানসহ দেশটির শীর্ষস্থানীয় ওলামায়ে কেরাম এবং রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। এরপর রিয়াদের প্রসিদ্ধ কবরস্থান মাকবারাতুল উদে তাকে চিরসমাহিত করা হয়।
সৌদি সরকারের রাজকীয় আদেশে মক্কার মসজিদে হারাম ও মদিনা মসজিদে নববিসহ একযোগে দেশটির সব মসজিদে শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ (রহ.)-এর গায়েবানা জানাজা পড়ানো হয়।
তার ইন্তেকালে সৌদি আরবসহ পুরো মুসলিম বিশ্ব হারালো একজন এক প্রাজ্ঞ আলেমে দ্বীন এবং জগদ্বিখ্যাত মনীষীকে। পুরো জীবন যিনি ইসলামি জ্ঞানের প্রচার ও প্রসার এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং ভূমিকা রেখেছেন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফিরদাউস দান করুন।
লেখক : মাস্টার্স অধ্যয়নরত, উম্মুর কুরা বিশ্ববিদ্যালয় মক্কা মোকাররমা