দয়ার নবী মুহাম্মদ (সা.) সত্যিই গোটা মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতস্বরূপ। আরব কিংবা অনারব, মুসলিম বা অমুসলিম—সবার জন্য। বরং তার দয়ামায়া পশু-পাখি ও জীবজন্তু ছিল সবার জন্যই ব্যাপক। তিনি মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন এবং জীবজন্তুর প্রতি দয়া—এ দুয়ের সমন্বিত পথই শিক্ষা দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আমি তো আপনাকে গোটা বিশ্বজগতের জন্য রহমতস্বরূপ পাঠিয়েছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭)
নবীজি (সা.) পশুপাখি বা জীবজন্তুকে নির্যাতন করা, না খাইয়ে রাখা, তাদের ওপর অসহ্য বোঝা চাপানো, কিংবা তাদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে মারতে কঠোর নিষেধ করেছেন। এমনকি প্রাণীকে গালাগাল কিংবা অভিশম্পাত করতেও মানা করেছেন। (মুসলিম : ২৫৯৬) যা কি না মানব ইতিহাসে এর আগে কখনোই এভাবে গুরুত্ব পায়নি।
তিনি সতর্ক করেছেন—জীবের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ মানুষকে জাহান্নামে নিয়ে যেতে পারে। যেমন—এক নারী একটি বিড়ালকে বন্দি রেখে না খাইয়ে মেরে ফেলায় জাহান্নামে গেছে। (বুখারি : ২৩৬৩; মুসলিম : ২২৪৪) অন্যদিকে এক পতিতা তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। (মুসলিম : ২২৪৫) এক হাদিসে আছে, সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, জীবের প্রতি দয়া করলে কি আমরা সওয়াব পাব? রাসুল (সা.) বললেন, ‘যেকোনো জীবন্ত জীবে দয়া করলে সওয়াব আছে।’ (বুখারি : ২৩৬৩; মুসলিম : ২২৪৪)
প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানাতেও রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন। একবার আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) দেখলেন কিছু যুবক একটি পাখি বেঁধে রেখে তীর ছুড়ে খেলছিল। তিনি বললেন, ‘যে প্রাণীকে লক্ষ্যবস্তু বানায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে লানত করেছেন।’ (মুসলিম : ৫০৫৯)
কোনো পাখি বা প্রাণী মায়ের থেকে তার ছানাকে বিচ্ছিন্ন করতেও নিষেধ করে গেছেন নবীজি। একবার সাহাবায়ে কেরাম নবীজির সঙ্গে সফরে ছিলেন। একটি পাখি ও দুটি ছানা তাদের নজরে পড়ল। নবীজি কোথাও গেলেন। এই সুযোগে তারা ছানাদুটি হাতে নিয়ে নিলেন। তখন মা-পাখিটা ছানার বিয়োগব্যথায় ডানা ঝাপটাতে লাগল। নবীজি (সা.) ফিরে এসে এ দৃশ্য দেখতে পেয়ে বললেন, ‘কে এ পাখিটিকে তার বাচ্চার জন্য ব্যথিত করল? বাচ্চাগুলো ফিরিয়ে দাও।’ (আবু দাউদ : ২৬৭৫)
নবীজি জীবন্ত প্রাণীর অঙ্গ কেটে নেওয়া বা দাগ কেটে কষ্ট দেওয়া নিষিদ্ধ করেছেন। একবার তিনি একটি গাধার মুখে দাগ দেওয়া দেখে বললেন, ‘যে এ দাগ দিয়েছে, আল্লাহ তাকে লানত করুন।’ (মুসলিম : ৫৫৫২)
প্রাণীকে ভালোভাবে দেখভাল করার ব্যাপারেও নবীজি দিকনির্দেশনা দিয়ে গেছেন। সাহল ইবন হানজালিয়া (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) একটি উটের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। উটটির পিঠ ক্ষুধায় পেটের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। তখন তিনি বললেন, ‘এই নির্বাক প্রাণীগুলোর ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো! এগুলো যখন চলার উপযোগী থাকে, তখন তোমরা চড়ো; আর যখন জবাইয়ের উপযোগী হয়, তখন খাও।’ (আবু দাউদ : ২৫৪৮)
জন্তু ব্যবহারে দয়া ও নমনীয়তা প্রদর্শন করতেও শিক্ষা দিয়েছেন নবীজি। একবার আম্মাজান আয়েশা (রা.) একটি উটে চড়েছিলেন; উটটি কিছুটা খিটখিটে ছিল। তিনি বারবার শক্তভাবে টানছিলেন। তা দেখে রাসুল (সা.) বললেন, ‘হে আয়িশা, কোমল আচরণ অবলম্বন করো।’ (মুসলিম : ২৫৯৩)
প্রাণীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই লাগাতেও ইসলাম নিষেধ করেছে। কারণ এটি নিছক যন্ত্রণা ও কষ্ট সৃষ্টি করার নামান্তর। যেখানে কোনো উপকার নেই; আছে শুধু অত্যাচার ও অন্যায়। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) প্রাণীদের পরস্পরের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা নিষেধ করেছেন-যেমন : উট-উট, ভেড়া-ভেড়া, মোরগ-মোরগ লড়ানো। (আবু দাউদ : ২৫৬২)
সফরকালে উর্বর ও অনুর্বর জমিনভেদে জন্তুর সঙ্গে উত্তম আচরণেরও শিক্ষা দিয়েছেন নবীজি। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা যদি উর্বর স্থানে সফর করো, তবে উট-গবাদি পশুকে জমিন থেকে চরার সুযোগ দাও। আর যদি খরার সময় সফর করো, তবে দ্রুত যাত্রা করো—যাতে তারা শক্তি নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে।’ (মুসলিম : ১৯২৬)
ইমাম নববি (রহ.) এ হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেন, উর্বর জমিতে পশুকে কিছু সময় চরতে দেওয়া উচিত। আর অনুর্বর ও খরার সময় ধীরগতিতে গেলে ক্ষুধায় তারা দুর্বল হয়ে পড়বে। (শারহু মুসলিম : ১৩/৬৯, ইমাম নববি)
বস্তুত নবী (সা.) ছিলেন তুলনাহীন দয়াময়। ছোট-বড়, মানুষ ও প্রাণী, মুমিন ও কাফের—সবাই তার রহমতের ছায়া পেয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যারা দয়া করে, রহমান তাদের প্রতি দয়া করেন। তোমরা পৃথিবীর ওপর বিচরণশীলদের প্রতি দয়া করো; আকাশের অধিপতি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (তিরমিজি : ১৯২৪)