উম্মে সুলায়ম বিনতে মিলহান (রা.)
হিজরতের পর মদিনা শহর নতুন এক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। বাতাসে খেজুর বাগানের গন্ধ, ওহুদের রঙ বদলানো পাহাড়, এসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক নারী, যার হৃদয় ছিল স্বর্ণদীপ্ত, দৃঢ়তায় ছিলেন পাহাড়ের মতো শক্ত। তিনি উম্মে সুলায়ম বিনতে মিলহান (রা.), তিনি ইসলামের প্রথম যুগের সেই নারীদের একজন, যাদের ঈমান ও প্রজ্ঞা যুগ যুগ ধরে আলো হয়ে আছে।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দ। মদিনা তখন ইয়াসরিব নামেই পরিচিত। নবীজি (সা.) হিজরতের অল্পকিছু আগে মদিনায় ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়েছে; ঠিক এ সময়েই উম্মে সুলায়ম নবীজি (সা.)-এর বার্তা শুনে সত্যের পথে আসেন। সে ঘটনা বিস্তারিত আজও ইতিহাসের স্বর্ণাক্ষরে লেখা। হিজরতের পূর্ব মুহূর্তে আনসারদের প্রথম সারির নারী হিসেবে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
তার স্বামী মালিক ইবন আন-নাদর তখনো ছিলেন জাহিলিয়ার অন্ধকারে নিমজ্জিত। স্ত্রী ইসলাম গ্রহণ করেছেন-এ খবর তার হৃদয়ে যেন এক তীক্ষ্ণ বর্শা হয়ে বিঁধল। বহুবার নিষেধাজ্ঞা, অপমান, রাগ—কিছুই উম্মে সুলায়মকে পথ থেকে সরাতে পারল না।
অবশেষে মালিক ঘর ছেড়ে সিরিয়ার দিকে রওনা হলেন। জানা যায়—তিনি সেখানে পৌঁছানোর আগেই নিহত হন। উম্মে সুলায়ম তখন নবীন বয়সের বিধবা এক নারী। চোখ বাঁধভাঙা ছিল ঠিকই, তবু হৃদয়ে দৃঢ়তা ছিল অটুট। তিনি বুঝে নিয়েছিলেন আল্লাহর পরীক্ষা এসেছে আর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ হলো—সন্তানকে সৎপথে বড় করে তোলা।
তাই উম্মে সুলায়ম তার প্রিয় ছেলে আনাস ইবন মালিক (রা.)-কে দশ বছর বয়সে নবীজির দরবারে নিয়ে গেলেন। সাল ৬২২, হিজরতের প্রথম বছর। উম্মে সুলায়ম বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ, আনাস আমার একমাত্র সন্তান। তাকে আপনার কাছে রেখে যাচ্ছি।’ এই বাক্য যেন মদিনার বাতাসের মিষ্টতায় আরো মিষ্টি বৃদ্ধি করে দিল, যা এখনো অম্লান হয়ে আছে। এরপর ঘটে এক হৃদয় জাগানিয়া ঘটনা, যা যুগ যুগ ধরে ভালোবাসার কাহিনির চূড়ান্ত উচ্চতা হয়ে আছে।
মদিনার ধনী ও প্রভাবশালী যুবক-সুন্দর চেহারার অধিকারী—আবু তালহা ইবন সাহল (রা.), যিনি তখনো মূর্তিপূজায় লিপ্ত। তিনি এলেন উম্মে সুলায়মকে প্রস্তাব দিতে। আবু তালহা ইবন সাহল (রা.)-এর সামাজিক মর্যাদা তখনো এমন যে, প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান চিন্তাই করা যায় না। কিন্তু উম্মে সুলায়মের হৃদয় তখন এক আলোর পথে। তিনি শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবু তালহা, তুমি যে মূর্তিগুলো পূজা করো, জানো তো সেগুলো কাঠের তৈরি? জানো সেগুলো বানায় এক কালো দাস? এমন জিনিসের সামনে তুমি নুয়ে পড়ো, যেটা আগুনে দিলেই পুড়ে যায়?’ আবু তালহা বিস্ময়ে স্তব্ধ, সমাজে এমন কথা বলার সাহস খুব কম নারীর ছিল।
তিনি ফিরে গেলেন কিন্তু তার হৃদয়ে শুরু হলো এক অদ্ভুত প্রশ্নের ঘূর্ণি। কদিন পর তিনি আবার এলেন। সঙ্গে নিয়ে এলেন সোনার মুদ্রা, মোহরানা, জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের প্রলোভন। কিন্তু উম্মে সুলায়ম এবার আরো দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আবু তালহা, আমাকে সোনা দিয়ে কিনতে চেয়ো না। তুমি যদি ইসলাম গ্রহণ করো—এটাই হবে আমার মোহর। আমি আর কিছুর প্রয়োজন অনুভব করি না।’
এ যেন তার হৃদয়কে ভেদ করে গেল। তারপর তিনি বললেন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ। এই কালেমা তার জীবনের পথই বদলে দিল। উম্মে সুলায়ম চোখে অশ্রু নিয়ে ছেলেকে ডাকলেন, ‘আনাস, ওঠো—এই নতুন মুসলিমের সঙ্গে আমার নিকাহ সম্পন্ন করে দাও।’
তারিখটি ইতিহাসবিদরা নির্ধারণ করেছেন, হিজরতের দ্বিতীয় বর্ষ, ৬২৩ সাল, মদিনায়। এ যেন এক অভূতপূর্ব ঘটনা, যা অন্তর শীতল করে দেয়। এমন পাত্রী ছিলেন উম্মে সুলায়ম, যা নরম মাটির বুকে ফুল সুরভি ছড়িয়ে দেয়, এ বিয়ের মোহরও ছিল ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। স্বর্ণ নয়, কাপড় নয়, প্রাসাদ নয় বরং ঈমান।
হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, আনাস ইবন মালিক (রা.) বর্ণনা করেন, ‘আবু তালহা আমার মাকে প্রস্তাব দেন, তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। আমার মা বললেন, তোমার মতো কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না, কিন্তু তুমি মুশরিক আর আমি মুসলিম। যদি তুমি ইসলাম গ্রহণ করো—এটাই হবে আমার মোহর।’ আবু তালহা ইসলাম গ্রহণ করলেন।
আনাস বলেন, ‘আমরা জানি আবু তালহার বিয়েতে দুনিয়ার সবচেয়ে বরকতময় মোহর ছিল—ইসলাম।’ (বুখারি : ৫১৫৫; কিতাবুন নিকাহ, এছাড়া ঘটনাটি সিরাত ইবন হিশাম, খণ্ড ১-২; যেখানে উম্মে সুলায়মের ইসলাম গ্রহণ, মালিকের মৃত্যু এবং আবু তালহার নিকাহর ঘটনা প্রামাণ্যভাবে উল্লেখ আছে)।
হ্যাঁ, আজকের দুনিয়ায় একটি আইফোন, কয়েকবারের ভিআইপি ট্রিটের সামনে যখন তরুণীরা বিলিয়ে দিচ্ছে নিজের ঈমান-ইজ্জত, সেখানে সাহাবিরা পুরো দুনিয়াকেও পায়ে দলেছেন ঈমানের সামনে। উম্মে সুলায়ম শুধু একজন নারী নন, তিনি এক আলোকস্তম্ভ। তার প্রজ্ঞা, যুক্তি, ঈমানের দৃঢ়তার সামনে আজকের প্রগতিগর্বী অসার নারীবাদীরা তুচ্ছ। সুবহানআল্লাহ, কী চমৎকার পাত্রী ছিলেন উম্মে সুলায়ম, কী চমৎকার মোহর ছিল তার বিয়ের মোহর। আল্লাহু আকবার।