আধুনিক সমাজে সন্তান প্রতিপালন এখন কেবল পারিবারিক দায়িত্ব নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক কঠিন নৈতিক সংগ্রাম। প্রযুক্তির অগ্রগতি যেমন মানুষের জীবনকে সহজ ও তথ্যসমৃদ্ধ করেছে, তেমনি শিশুমনের জগতে এনে দিয়েছে নানা জটিলতা ও বিভ্রান্তি। আজ মোবাইল, ভিডিও গেমস ও ইন্টারনেট শিশুর নিত্যসঙ্গী। এই প্রযুক্তির আলো একদিকে জ্ঞানের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে, অন্যদিকে তৈরি করছে এমন এক নির্ভরতা, যা শিশুদের শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলছে। চোখ ঝলসে দেওয়া স্ক্রিনের উজ্জ্বলতায় অনেক শিশু হারাচ্ছে বাস্তব জীবনের উষ্ণতা ও নৈতিক বোধ।
ইসলামি দৃষ্টিতে সন্তান বাবা-মায়ের জন্য এক পবিত্র আমানত। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা নিজেদের ও তোমাদের পরিবারকে জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা আত-তাহরিম : ৬) রাসূল (সা.)-এর বাণীও এই আমানতের গুরুতর দায়ের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়Ñ‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকের কাছেই তার দায়িত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন করা হবে।’ (বুখারি : ৭১৩৮)
এই নির্দেশনা স্পষ্ট করে, সন্তানের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সুরক্ষা শুধু ভালোবাসা নয়, এটি ঈমানের অংশ। প্রযুক্তিনির্ভর এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো স্ক্রিনে আসক্তি। দীর্ঘ সময় গেম বা ভিডিও দেখায় শিশুদের দৃষ্টিশক্তি ও মানসিক স্থিতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহিংস গেম তাদের চরিত্রে কঠোরতা ও রূঢ়তা তৈরি করছে। অন্যদিকে ইন্টারনেটের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে অশ্লীলতা ও অনৈতিক বিষয়বস্তুর অনুপ্রবেশ শিশুদের কোমল মনের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।
আরেকটি দিক হলো পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা। প্রযুক্তির ভার্চুয়াল জগতে নিমগ্ন শিশুরা পরিবার থেকে মানসিকভাবে দূরে সরে যাচ্ছে, হারাচ্ছে বাস্তব সম্পর্কের উষ্ণতা। আত্মকেন্দ্রিকতা ও অমনোযোগ তাদের জীবনের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট করছে। ইসলাম এসব সমস্যার সমাধান দেয় ভারসাম্য ও দায়িত্ববোধের মধ্য দিয়ে।
প্রথমত, সময় বণ্টনের শৃঙ্খলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট সময়ের বেশি স্ক্রিন ব্যবহারে সীমা আরোপ করতে হবে এবং নামাজ, খাবার ও ঘুমের সময় ডিভাইস দূরে রাখতে হবে। খেলাধুলা, বই পড়া ও প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা শিশুর মন ও শরীরকে সজীব রাখে।
দ্বিতীয়ত, নৈতিক চরিত্র গঠনে অভিভাবকের ভূমিকাই মুখ্য। নবী-রাসুলদের জীবনের গল্প, তাদের দয়া, ধৈর্য ও ন্যায়পরায়ণতার উদাহরণ শিশুর মনে আলোকিত ছাপ ফেলে।
তৃতীয়ত, প্রযুক্তি ব্যবহারে স্বচ্ছতা জরুরি। ইন্টারনেটের ব্যবহার অভিভাবকের নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে; তবে ভয় নয়, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের সম্পর্কেই তা হওয়া উচিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, শিশুর মনে আল্লাহভীতি ও আল্লাহর ভালোবাসা জাগ্রত করা। নিয়মিত নামাজ, দোয়া ও আল্লাহর স্মরণ তাকে ভেতর থেকে শক্তিশালী করে তোলে। এতে সে বুঝতে শেখে, মানুষের চোখ ফাঁকি দেওয়া যায়, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টি সবসময় খোলা থাকে। প্রযুক্তির যুগে সন্তানের প্রতিপালন মানে কেবল তাকে আধুনিক শিক্ষায় গড়ে তোলা নয়; বরং তাকে এমন এক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা, যে জ্ঞানে আধুনিক, কিন্তু হৃদয়ে ঈমানদীপ্ত। এটাই বাবা-মায়ের জন্য প্রকৃত সাফল্য—এই দুনিয়ারও, পরকালেও।