বৈশ্বিক উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা পদক্ষেপ সত্ত্বেও চলতি শতক শেষে সারা বিশ্বের তাপমাত্রা ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে, যা বৈশ্বিক তাপমাত্রার ১.৫ ডিগ্রি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক বেশি। মঙ্গলবার জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ‘ইমেশনস গ্যাপ রিপোর্ট ২০২৫’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী বিশ্বের তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে লক্ষ্যমাত্রা ছিল, তা আগামী দশকেই ছাড়িয়ে যাবে। যদি বিশ্বের দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তা সত্ত্বেও ২১০০ সাল নাগাদ বিশ্বের তাপমাত্রা ২.৩ থেকে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে। তবে বর্তমানে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে ওই সময়ের মধ্যে তাপমাত্রা ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে।
ইউএনইপির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ইনগের অ্যানডারসন বলেন, প্যারিস চুক্তির অধীনে বিশ্বের দেশগুলো উষ্ণতা রোধে বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতির জন্য তিনবার উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই তারা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, যদিও বিশ্বের দেশগুলোর পরিবেশ পরিকল্পনায় কিছু উন্নতি হয়েছে, তবে এটির কোনো প্রভাব নেই এবং যথেষ্ট দ্রুতগতির নয়। যে কারণে আমাদের এখনো প্রচণ্ড নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশালাকারের নিঃসরণ কমাতে হবে।
ব্রাজিলে জাতিসংঘের আসন্ন পরিবেশ সম্মেলন ‘কপ৩০’র আগেই এ প্রতিবেদনটি এলো। প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালে আগের বছরের তুলনায় বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ ২.৩ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে ভারতে সবচেয়ে বেশি হারে নিঃসরণ বেড়েছে। এর পরের অবস্থানে রয়েছে চীন, রাশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।
তবে সম্মিলিতভাবে জি-২০ভুক্ত বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের তিন-চতুর্থাংশের জন্য দায়ী। শীর্ষ পরিবেশ দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়ন গত বছর গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়েছে।
এরই মধ্যে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকা পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে গেছে। আগামী বছরই প্যারিস চুক্তি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে দেশটি।
ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি অনুসারে, যদি আমেরিকা পরিবেশ সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন থেকে সরে যায়, তাহলে তা উষ্ণতা আরো এক ডিগ্রির দশ ভাগের এক ভাগ বাড়াবে বলে ইউএনইপির প্রতিবেদনে বলা হয়। এর ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতার বৃদ্ধি রোধ ঠিক রাখতে বাকি সব দেশকে আবশ্যিকভাবে দুই বিলিয়ন টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বন্ধ করতে হবে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, শিল্প-পূর্ব যুগের চেয়ে তাপমাত্রা যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়ে, তাহলে বিশ্বের জন্য তা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। তাই বিপর্যয়ের মাত্রা রোধ করতে এ অবস্থানেই তাপমাত্রাকে ধরিয়ে রাখতে হবে।
শিল্প-পূর্ব যুগের চেয়ে ১.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেই বিশ্ব বর্তমানে এত বেশি উষ্ণ হয়ে গেছে যাতে বেশিরভাগ ক্রান্তীয় প্রবাল প্রাচীরের অস্তিত্ব টেকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া মেরু ও পর্বতে জমে থাকা বরফ গলে যাচ্ছে এবং আমাজনের রেইনফরেস্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে পুরো পৃথিবীর ওপর।
জাতিসংঘের স্বতন্ত্র বৈজ্ঞানিক প্যানেলের ভাইস চেয়ার অ্যাডেল থমাস বার্তা সংস্থা এপিকে বলেন, ‘প্রতি ডিগ্রির এক-দশমাংশ বিশ্বের সম্প্রদায় ও ইকোসিস্টেমের ওপর প্রভাব ফেলবে।’
তিনি বলেন, ‘তাপপ্রবাহের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রের তাপমাত্রা ও প্রবাল প্রাচীরের ধ্বংসে এটি আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সমুদ্র উচ্চতা বাড়ার বিষয়টি বিবেচনা করলে এটি দীর্ঘমেয়াদেই গুরুত্বপূর্ণ।’
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ১৯৫টির মধ্যে মাত্র ৬০টি দেশ ২০৩৫ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনার নতুন পরিকল্পনা জমা দিয়েছে। এই দেশগুলো বিশ্বের মোট গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ৬৩ শতাংশের জন্য দায়ী। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে এ পরিকল্পনা জমা দেওয়ার ডেডলাইন ছিল।
প্রতিবেদনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমিত রাখতে বিশ্বের নেতাদের ‘ত্বরিত ও চূড়ান্ত’ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
প্রতিবেদনটির বিষয়ে পরে এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেন, ‘বিজ্ঞানীরা আমাদের বলছেন ১.৫ ডিগ্রির ওপর সাময়িক তাপমাত্রা ছাড়ানো এখন অনিবার্য, যা ২০৩০ সালেই ছাড়াতে পারে। এর ফলে দিনে দিনে বাসযোগ্য ভবিষ্যতের পথ খাড়া হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে আত্মসমর্পণ করতে হবে। এটি বরং উদ্যোগ নেওয়ার ও দ্রুতগতিতে কাজ করার কারণ। চলতি শতক শেষে ১.৫ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই আমাদের লক্ষ্য। তবে এক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ স্পষ্ট, লক্ষ্য এখনো অর্জনের মধ্যে রয়েছে। তবে এর জন্য আমাদের উদ্যোগ অর্থপূর্ণভাবে বাড়াতে হবে।’