হোম > বিশ্ব

ভারতে গরুর মাংস খাওয়ায় হত্যা, মামলা প্রত্যাহারে সরকারের চাপ

আমার দেশ অনলাইন

ছবি: বিবিসি

গরুর মাংস খাওয়া ও বাড়িতে রাখা হয়েছে সন্দেহে ভারতের উত্তর প্রদেশে মোহাম্মদ আখলাক নামে এক ব্যক্তিকে ২০১৫ সালে পিটিয়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল।

ওই ঘটনায় যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তাদের সবার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার অনুমতি চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন জানিয়েছে রাজ্য সরকার। গত মাসে গ্রেটার নয়ডার একটি আদালতের কাছে উত্তর প্রদেশ সরকার ওই আবেদন দায়ের করেছে।

নিহত মোহাম্মদ আখলাকের পরিবারের সদস্যরা অবশ্য জানিয়েছেন, বিচারের জন্য এই লড়াই তারা আদালতে চালিয়ে যাবেন।

ঘটনাটি উত্তর প্রদেশের দাদরির বিসাহরা গ্রামের। সে সময় মোহাম্মদ আখলাকের বয়স ছিল ৫০ বছর।

২০১৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পড়ে আখলাকের বাড়িতে গোমাংস রাখা আছে এবং তিনি তা খেয়েছেনও। যদিও তার পরিবার প্রথম থেকেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে।

ভারতে গোহত্যা একটি স্পর্শকাতর বিষয়। হিন্দু সম্প্রদায় গরুকে পবিত্র বলে মনে করে। উত্তর প্রদেশ ভারতের সেই ২০টি রাজ্যের মধ্যে একটি যেখানে গোহত্যার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে।

প্রসঙ্গত, গোহত্যা বা গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে সহিংসতা নিয়ে এটিই প্রথম ঘটনা যা গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই মামলার পরই, ‘মবলিঞ্চিং’ বা গণপিটুনি শব্দটিও ব্যাপকভাবে ব্যবহার হওয়া শুরু হয়।

সেই সময় ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে ৪৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দাদরিতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাটি সারা দেশে বিক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল।

১৮ জন অভিযুক্তের সবাই জামিনে:

মোহাম্মদ আখলাকের পরিবারের আইনজীবী মোহম্মদ ইউসুফ সাইফি বিবিসি হিন্দিকে বলেছেন, এই মামলায় অভিযুক্ত হিসেবে এখন ১৮ জনের নাম রয়েছে এবং তারা সবাই এখন জামিনে রয়েছেন।

ঘটনার ১০ বছর পরে, সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ সরকার আদালতে একটি আবেদন দায়ের করেছে, যেখানে বলা হয়েছে যে এই মামলায় সাক্ষীদের বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে এবং সরকার ‘সামাজিক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার’ করার জন্য (আদালতের কাছে) এই মামলাটি প্রত্যাহারের অনুমতি চাইছে।

এই মামলার পরবর্তী শুনানি নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ১২ই ডিসেম্বর।

নিহত মোহাম্মদ আখলাকের ছোট ভাই জান মোহাম্মদের সঙ্গে এই নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি হিন্দি। মামলা প্রত্যাহারের জন্য দায়ের করা এই আবেদনকে ‘মর্মান্তিক’ বলে আখ্যা দিয়েছেন তিনি।

বিবিসির সঙ্গে কথোপকথনের সময় তিনি বলেছেন, ‘আমরা কখনোই ভাবিনি যে ন্যায়বিচারের জন্য আমাদের ১০ বছরের এই লড়াইকে এভাবে শেষ করার জন্য চেষ্টা চালানো হবে’।

জান মোহাম্মদ জানিয়েছেন ওই ঘটনার পর কীভাবে আখলাক মোহাম্মদের পুরো পরিবার গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছিল। তারপর কখনো সেই গ্রামে ফিরে আসেননি তারা।

জান মোহাম্মদের কথায়, ‘আমরা এখন আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে আরও বেশি চিন্তিত। এই পদক্ষেপ কি অপরাধীদের মনোবলকে বাড়িয়ে তুলবে না?’

কী ঘটেছিল দাদরির ওই গ্রামে?

পুলিশের কাছে যে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন আখলাক মোহাম্মদের স্ত্রী ইকরামন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ‘২০১৫ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর রাতের বেলায় পরিবারের সবাই ঘুমাচ্ছিলেন। আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ একদল লোক, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন, তারা লাঠি, লোহার রড, তলোয়ার ও পিস্তল নিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে’।

‘তারা আখলাক আর তার ছেলের বিরুদ্ধে গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণের অভিযোগ তুলতে থাকে। এই ঘটনায় আখলাকের মৃত্যু হয় এবং তার বছর ২২-এর ছেলে দানিশ গুরুতর আহত হয়’।

মোহাম্মদ আখলাকের পরিবার বলেছে, তারা পরে জানতে পারে বাড়িতে এই হামলা চালানোর আগে একটি মন্দির থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল কেউ গোহত্যা করেছে এবং গোমাংস ভক্ষণ করেছে।

আখলাকের ফ্রিজে মাংস পাওয়া গিয়েছিল। বলা হয়েছিল, এটিই প্রমাণ যে তার বাড়িতে গরুর মাংস ছিল। অন্যদিকে, তার পরিবারের দাবি সেটি ছিল খাসির মাংস।

দাদরির মামলার কথা প্রকাশ্যে আসার পর দেশে ক্ষোভ জন্মায়। এর কয়েকদিন পর কয়েকজন ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়।

সেই সময় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। সমালোচকরা বলেন, এই ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগেছে।

পাশাপাশি ভারতীয় জনতা পার্টির কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত হামলাকারীদের রক্ষা করার অভিযোগও ওঠে।

একজন নেতা এই হত্যা মামলাকে দুর্ঘটনা বলে অভিহিত করেছিলেন বলে অভিযোগ। আবার অন্য এক নেতাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, গোমাংস ভক্ষণের বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের এই মন্তব্যকে ঘিরেও সমালোচনা হয়।

এরপর ওই বছর ডিসেম্বর মাসে পুলিশ চার্জশিট জমা দেয়। সেখানে এই ঘটনায় অভিযুক্ত হিসেবে ১৫জনকে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই তালিকায় একজন নাবালক এবং এক স্থানীয় বিজেপি নেতার ছেলের নামও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

পরে অবশ্য এই মামলায় অভিযুক্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১৯ জনে।

পরের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালে জেলে থাকাকালীন অভিযুক্তদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়। রবিন সিসোদিয়া নামে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর পর বিসাহরা গ্রামে ব্যাপক উত্তেজনা দেখা গিয়েছিল।

কেউ কেউ তাকে ‘শহিদ’ বলে অভিহিত করেন। পরিবারের সদস্যরা তার লাশ সৎকার করতে অস্বীকার করেছিলেন। সিসোদিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ তোলা হয় যে তার মৃত্যুর নেপথ্যে ষড়যন্ত্র রয়েছে।

অন্যদিকে কর্মকর্তারা জানান ‘অর্গান ফেইলিওরের’ কারণে রবিন সিসোদিয়ার মৃত্যু হয়েছে।

রবিন সিসোদিয়ার লাশ তেরঙ্গায় (ভারতের পতাকায়) মোড়ানো হয়। পরিবার দাহ করতে অস্বীকার করায় এরপর কয়েকদিন গ্রামেই রাখা হয়েছিল তার লাশ।

এরপর রাজ্য সরকার এবং দুই বিজেপি নেতা তার পরিবারকে ক্ষতিপুরণের প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরই দেহ সৎকার করা হয়।

মোহাম্মদ আখলাক হত্যা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০২১ সালে। পরিবারের পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ ইউসুফ সাইফি জানিয়েছেন, আদালতে এখন পর্যন্ত শুধু একজন সাক্ষীর জবানবন্দিই পেশ করা হয়েছে।

মামলা প্রত্যাহারের আবেদনে কী বলে হয়েছে?

উত্তর প্রদেশ সরকার গত মাসে আদালতে যে আবেদন দায়ের করেছে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, আখলাকের পরিবারের সদস্যদের বক্তব্যে অসঙ্গতি রয়েছে। তাদের একজনের বক্তব্য অন্যজনের সঙ্গে মিলছে না।

সরকারের তরফে জানানো হয়েছে, মোহাম্মদ আখলাকের স্ত্রী ইকরামন তার অভিযোগে ১০ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছিলেন, তার মেয়ে সাইস্তা ১৬ জন অভিযুক্তের নাম উল্লেখ করেছেন এবং ছেলে দানিশ অভিযুক্ত হিসেবে ১৯ জনের নাম বলেছিলেন।

সরকারের পক্ষ থেকে দায়ের করা আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘একই গ্রামের বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও, বাদী এবং অন্যান্য সাক্ষীরা নিজেদের বক্তব্যে অভিযুক্তদের সংখ্যা বদলেছেন’।

এই প্রসঙ্গে আখলাকের পরিবারের আইনজীবী মহম্মদ ইউসুফ সইফি জানিয়েছেন, এমন হতেই পারে যে সময় ঘটনাটি ঘটে তখন সব সাক্ষী সব অভিযুক্তকে দেখতে পাননি।

এই আইনজীবী পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ‘যেটি দেখার বিষয় সেটি হলো যে কয়জনের নাম (অভিযুক্তদের) উল্লেখ করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ মিলেছে কি না’।

সরকারের তরফে দায়ের করা আবেদনে আরো বলা হয়েছে যে পুলিশ অভিযুক্তদের কাছ থেকে পাঁচটি লাঠি, লোহার রড এবং ইট উদ্ধার করেছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে কোনো পিস্তল বা তলোয়ার উদ্ধার হয়নি।

যদিও পুলিশের কাছে দায়ের হওয়া অভিযোগে নিহত মোহাম্মদ আখলাকের স্ত্রী ইকরামন পিস্তল এবং তলোয়ারের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

নিহতের পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা:

ঘটনাস্থল থেকে যে মাংস উদ্ধার করা হয়েছিল সেটি গোমাংস বলে ফরেনসিক রিপোর্টে বর্ণনা করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রাজ্য সরকারের আবেদনে। আখলাকের পরিবার অবশ্য ওই অভিযোগ ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে এসেছে।

প্রসঙ্গত, মোহাম্মদ আখলাকের পরিবারের বিরুদ্ধে গোহত্যা বিরোধী আইনের আওতায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। এই মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে।

আইনজীবী মোহম্মদ ইউসুফ সাইফি অভিযোগ করেছেন যে পরিবারের উপর ‘চাপ সৃষ্টি’ করার জন্যই এই মামলাটি দায়ের করা হয়েছিল।

তিনি জানিয়েছেন স্থানীয় এক পশুচিকিৎসকের প্রাথমিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, উদ্ধার হওয়া ওই মাংস গরুর মাংস ছিল না, সেটি ছিল খাসির মাংস।

মোহম্মদ ইউসুফ সাইফির মতে, রাজ্য সরকারের পেশ করা ওই সাম্প্রতিক আবেদন গ্রহণ করা হবে কি না, তা নির্ভর করছে আদালতের উপর।

তবে উত্তরপ্রদেশ সরকারের তরফে এই আবেদন সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন এই আইনজীবী। তার কথায়, ‘গণপিটুনির মতো গুরুতর মামলা কি প্রত্যাহার হবে?’

মোহাম্মদ আখলাকের পরিবারও ন্যায়বিচারের বিষয়ে আশাবাদী। জান মোহাম্মদ বলেছেন, ‘আদালতের ওপর আমার এখনো আস্থা আছে। আমি নিশ্চিত, যে একদিন আমরা ন্যায়বিচার পাবই’।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ করল আম্বানির রিলায়েন্স

ব্যাংক কর্মকর্তা পরিচয়ে ১০ কোটি টাকা লুট

ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের ঝুঁকি এখনো আছে: পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী

কলম্বিয়ায় ১৪ টন কোকেনের চালান জব্দ

শান্তি পরিকল্পনা মেনে নিতে ইউক্রেনকে ট্রাম্পের আল্টিমেটাম

রাশিয়াকে পরাজিত করার বিভ্রমে আছে ইউরোপ-ইউক্রেন: পুতিন

যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ৬৭ শিশু নিহত: ইউনিসেফ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা, কী আছে তাতে

পরস্পরের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ট্রাম্প-মামদানি

যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন হারানোর ঝুঁকিতে ইউক্রেন: জেলেনস্কি