‘দাদা কোথায় পালাচ্ছেন… আপনি বাংলাদেশি … আপনি বাংলাদেশি’ এরকম বলতে বলতে এক নারী সাংবাদিক হাতে মাইক নিয়ে দৌড়চ্ছেন-এরকম একটি ভিডিও ক্লিপ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে গত কয়েকদিনে।
আবার কোনো বস্তির তালাবদ্ধ ঘরের ভিডিও দেখিয়ে দাবি করা হচ্ছে যে সেগুলোতে বাংলাদেশিরা থাকতেন, এখন পালিয়ে গেছেন।
অনেক ভিডিও ক্লিপও ছড়িয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, যেখানে দাবি করা হচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর শুরু হতেই ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে’। সেই সব ক্লিপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে সেগুলো ভুয়া।
আবার ইউটিউবার ও গণমাধ্যমের একাংশ ‘বাংলাদেশি’ কি না, বা বৈধ নথি আছে কি না, সেসব জানতে চাইলে কয়েকটি ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের গালিগালাজ করছেন, এরকম ভিডিও-ও দেখা গেছে।
এই ক্লিপগুলো ছাড়া আরো কয়েকটি ঘটনা জানা যাচ্ছে, যেখানে বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গা খুঁজতে দেখা যাচ্ছে কলকাতার গণমাধ্যমের একাংশ এবং বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেলের সাংবাদিককে।
ওইসব সামাজিক মাধ্যমে অভিযোগ তোলা হচ্ছে যে ভারতের নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকায় যে নিবিড় সংশোধন বা এসআইআর প্রক্রিয়া চালাচ্ছে, তারই প্রেক্ষিতে অবৈধভাবে ভারতে আসা বাংলাদেশি এবং রোহিঙ্গারা ‘পালিয়ে’ চলে গেছেন।
ইউটিউবার এবং সিনিয়র সাংবাদিকদের একাংশ বলছেন যে এরকম নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে নিজেদের ‘ভিউ’ বাড়াতে- যা আসলে তাদের রোজগারের পথ।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে যে কে বাংলাদেশি, কে রোহিঙ্গা, কার কাছে বৈধ নথি আছে, কার নেই, সেসব যাচাই করার অধিকার সংবাদ মাধ্যমের আদৌ আছে কি না।
সিনিয়র সাংবাদিক ও ইউটিউবারদের একাংশ বলছেন, সাংবাদিকদের এটা কাজ নয়। আবার অন্য একটি মত হলো স্বাধীনভাবে কেউ যদি কাজ করতে গিয়ে কিছুটা নাটকীয় উপস্থাপনা করেন এবং মানুষ যা দেখতে চাইছেন, সেরকম ভাষ্য দেখানো হয়, তাহলে আপত্তির কী আছে?
ভারতের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের একাংশ, বাংলাদেশি অভিবাসী ও রোহিঙ্গাদের এক করে ফেলছেন। তারা যে দুটো ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী এটা তারা বুঝতে পারছেন না বলে তাদের লেখা ও কথায় প্রতিয়মান হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী। জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়ে তাদের একটি বড় অংশ মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশের কক্সবাজার এলাকায় আশ্রয় নিয়ে আছে।
অনেক রোহিঙ্গা ভারত, মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশেও অবস্থান করছে। বাংলাদেশি হিসেবে রোহিঙ্গাদের ভুয়া পরিচয় ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে অনেক আগে থেকে।
এছাড়া আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের পরিচয়পত্র নিয়ে ৫০ হাজারের মতো রোহিঙ্গা ভারতে বসবাস করছে।
‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গাদের পালানোর’ খবর যেখানে হচ্ছে:
কলকাতা লাগোয়া নিউ টাউনের ঘূর্ণি অঞ্চলে যে অনেক বাংলাদেশি ‘অবৈধভাবে’ বসবাস করেন, তা নতুন কিছু নয়।
একই সঙ্গে সেখানকার বেশিরভাগই ভারতীয় নাগরিক-যারা হয় ওই এলাকারই আদি বাসিন্দা অথবা অন্যান্য জায়গা থেকে কাজের সূত্রে নিউ টাউন এলাকায় এসেছেন।
সেখানকার এক পুরানো বাসিন্দা বিবিসিকে বলছিলেন, ‘এখানে যে বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে এসে বাস করেন, সেটা তো আপনি জানেন। এই ভোটার তালিকা নিয়ে এসআইআর শুরু হওয়ার আগে আমাদের এলাকা থেকে প্রায় শখানেক পরিবার চলে গেছে- যারা সত্যিই অবৈধভাবে এসেছিল। কিন্তু এখানে তো মানুষ মূলত শ্রমজীবী-তাই সাংবাদিকরা যখন এখানে আসছেন, অনেক বাসিন্দাই কাজে বেরিয়ে গেছেন। তাদের বাড়িতে তালাবন্ধ দেখে বলে দেওয়া হচ্ছে যে বাংলাদেশিরা পালিয়ে গেছে।’
ঘূর্ণি এলাকার ওই বাসিন্দা বলেন, ‘তবে যে ভিডিওটা ভাইরাল হয়েছে, সেই জমিটা একজন ভারতীয়র। তার সঙ্গে ওই নারী সাংবাদিকের কথা কাটাকাটি হয়-তাকে প্রশ্ন করে যে কেন তার ব্যক্তিগত জমিতে প্রবেশ করে ভারতীয় হওয়ার নথি দেখতে চাইছেন ওই সাংবাদিক।’
আবার অনেক বিহারের বাসিন্দাও কলকাতা বা লাগোয়া অঞ্চলে কাজ করেন, দোকান চালান। এই অংশের মানুষ প্রথমে ছট পুজো, তারপরে বিহারের নির্বাচনে ভোট দিতে সে রাজ্যে গেছেন। তাদের ঘর তো তালাবন্দি থাকবেই।
যেসব ইউটিউ চ্যানেল বা গণমাধ্যমে ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গাদের পালানোর’ খবর দেখানো হচ্ছে, সেগুলির প্রায় সবই নিউ টাউন অঞ্চলের ঘূর্ণি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার।
ভুয়া ভিডিও:
এসআইআর শুরু হওয়ার পরে ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে’ বলে এক শ্রেণির ইউটিউবার এবং গণমাধ্যম যে-সব খবর দেখাচ্ছে, তার বাইরে সামাজিক মাধ্যমে ওই একই শিরোনামে দেখা যাচ্ছে এমন অনেক ভিডিও, যা চোখে দেখেই বোঝা যায় যে তা ভুয়া।
এমনই একটি ভিডিও ছড়ানো হচ্ছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে সীমান্তের তারকাঁটার বেড়ার সংলগ্ন লোহার গেট খুলে দেয়ার পরে অনেক নারী-পুরুষ বেরিয়ে আসছেন।
এই ভিডিওতে বলা হচ্ছে যে বিএসএফ গেট খুলে দিয়েছে যা দিয়ে ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গারা পালাচ্ছে’। ভিডিওটি দেখেই বোঝা সম্ভব যে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী এভাবে কাউকে ‘পালিয়ে’ যেতে দেবে না।
আসলে ভিডিওটি হলো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যে সব চাষের জমি বেড়ার বাইরে আছে, সেই সব ভারতীয় চাষীদের সেখানে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে বিএসএফ গেট খুলে দেয়। এটি সেরকমই একটি ভিডিও।
অন্যদিকে, ‘বাংলাদেশি’ এবং ‘রোহিঙ্গাদের’ মধ্যে পার্থক্য না জেনে সবাইকে একাসনে বসিয়ে দিয়ে ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গা’ বলা হচ্ছে নানা ভিডিওতে।
আবার বেনাপোল-পেট্রাপোলের সীমান্ত দিয়ে প্রচুর বাংলাদেশি ‘পালাচ্ছে’ বলে দেখানো হচ্ছে আরেকটি ভিডিওতে। সীমান্তচৌকি দিয়ে যারা যাতায়াত করেন, তাদের তো ‘পালাতে’ হয় না, তারা তো বৈধভাবেই যাতায়াত করবেন।
এরকম আরো বেশ কিছু ভিডিও-ও সামাজিক মাধ্যমে ছড়াচ্ছে।
নথি যাচাই সাংবাদিকের কাজ নয়:
যেভাবে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল কোনো ব্যক্তিকে নির্দিষ্ট করে ‘বাংলাদেশি’ বলে চিহ্নিত করছেন, বা কারো তালাবন্ধ ঘর দেখিয়ে বলছেন যে সেখানে ‘বাংলাদেশি রোহিঙ্গা’ থাকতেন, এসআইআর শুরু হওয়ার পরে পালিয়ে গেছেন, তা নিয়ে অনেকেই আপত্তি জানাচ্ছেন সামাজিক মাধ্যমেই।
এদের মধ্যে সাধারণ মানুষ যেমন আছেন, তেমনই রয়েছেন সাংবাদিকরাও।
সর্বভারতীয় গণমাধ্যম নেটওয়ার্ক ১৮-এর এডিটর-ইস্ট বিশ্ব মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘এই কাজটা তো আমাদের নয়। আমরা খবর তুলে ধরব- সেটাই দায়িত্ব। আবারো অবশ্যই মতামতও ব্যক্ত করতে পারি। কিন্তু কার কাছে নথি আছে, কার নেই- তা জানতে মানুষকে ধাওয়া করা, তাদের বাড়ির ভেতরে ঢুকে গিয়ে তাড়া করা- এর দায়িত্ব তো সাংবাদিকের নয়’।
বিশ্ব মজুমদার বলেন, ‘পাল্টা যদি সেই ব্যক্তি প্রশ্ন করেন যে আপনি কে-কেন আমরা নথি দেখতে চাইছেন-আপনার নথি দেখান-তাহলে? আমি নিজে পশ্চিমবঙ্গের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কমিটির চেয়ারম্যান, তাই নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি যে এসব কাজ যারা করছে, তাদের নিজেদের সাংবাদিকতার জন্য সরকারি কার্ড নেই।’
তার কথায়, যারা দীর্ঘদিন ধরে সাংবাদিকতা করছেন, তাদের কাছে ইউটিউবারদের এভাবে, তার কথায়, ‘এজেন্ডা ভিত্তিক’ সংবাদ পরিবেশন বেদনাদায়ক এবং এ ধরনের ইউটিউবার ও ‘এজেন্ডা ভিত্তিক’ খবর পরিবেশনের জন্য পুরো সাংবাদিক মহলই সাধারণ মানুষের কাছে মর্যাদা হারিয়েছে।
তবে নারী ইউটিউব সাংবাদিকদের যেভাবে গালিগালাজ করা হচ্ছে বা গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, সেটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলে মনে করেন সিনিয়র সাংবাদিক পিণাকপানি ঘোষ। তিনি এখন প্রাতিষ্ঠানিক সাংবাদিকতা ছেড়ে নিজের ইউটিউব চ্যানেল চালান।
তিনি বলছিলেন, ‘আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছি প্রায় তিন দশক আগে, তখনকার থেকে এখন অবস্থা বদলেছে। এখন মানুষ সাংবাদিকদের কাছ থেকে একটা ভাষ্য দেখতে বা শুনতে চায়। বড় সংবাদমাধ্যমের পক্ষে নিজেদের ভাষ্য দেয়ার সমস্যা থাকে – নানা বাধ্যবাধকতা থাকে তাদের। একটা নীতির মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়’।
তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমরা যারা স্বাধীনভাবে ইউটিউব চ্যানেল চালাই, আমাদের ক্ষেত্রে কতটা স্বাধীনতা নেব – সেটা আমাদের নিজেদের ওপরে নির্ভর করে। অন্যদিকে যেভাবে নারী সাংবাদিকদের গায়ে হাত তোলা হচ্ছে, কেউ বলছেন গায়ে গরম জল ঢেলে দেবে, গালিগালাজ করা হচ্ছে – সেটা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা তো বটেই’।
তিনি আরো বলেন, ‘এটাও মাথায় রাখতে হবে যে কোনো খবর কারো পছন্দ হচ্ছে না বলে পেছন থেকে রাজনৈতিক দলগুলোই কিন্তু সাংবাদিক বা কন্টেন্ট ক্রিয়েটারদের ওপরে হামলা করাচ্ছে – বাইরে বলা হচ্ছে যে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে এসব করছে।’
কলকাতার আরেক ইউটিউবার মানব গুহর কথায়, ‘এখন বেশিরভাগ তথাকথিত ইউটিউবারের সাংবাদিকতার ন্যূনতম জ্ঞানটাও নেই। আমিও তো নিয়মিত সরকার-বিরোধী খবর করি আমার চ্যানেলে। কিন্তু কোন খবরটা কীভাবে করতে হবে, কতদূর নাটকীয়তা করব, কীভাবে তথ্য যাচাই করব, সেই বোধটা তো থাকতে হবে! যে কেউ এখন হাতে একটা মাইক আর মোবাইল ফোন নিয়ে সাংবাদিকতায় নেমে পড়লে এ ধরনের ঘটনাই হবে’।
সূত্র: বিবিসি বাংলা