দাসদের খাবার থেকে রাজকীয় পাতে রসুন, গুণাগুণ কতটা?

আমার দেশ অনলাইন
প্রকাশ : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ৩৭
আপডেট : ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১৪: ৪০

হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মানুষ রসুন খেয়ে আসছে। শুধু স্বাদের জন্য নয়, বরং এর ওষুধি গুণাগুণের কারণেও।

অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল বা জীবাণুনাশক এবং অ্যান্টিভাইরাল বা ভাইরাস প্রতিরোধী হিসেবে পরিচিত রসুন রান্না ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে একটি অপরিহার্য উপাদান হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এর উৎপত্তি মূলত এশিয়ায় হলেও অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মাধ্যমে রসুন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রেও ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রসুন উৎপাদক।

রসুনের সমৃদ্ধ ইতিহাস, সাংস্কৃতিক গুরুত্ব এবং রসুন সত্যিই আমাদের জন্য ভালো কি না সেই প্রশ্নের অনুসন্ধান করেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের ফুড চেইন প্রোগ্রাম।

রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান:

অসংখ্য রান্নায় অপরিহার্য এই রসুন। ড্যানিশ শেফ পল এরিক জেনসেন, যিনি ফ্রান্সে তার ফ্রেঞ্চ ডাইনিং স্কুলে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও এশিয়ার শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেন, তিনি জানান এমন কোনো শিক্ষার্থী তিনি কখনো দেখেননি যে রসুন চেনে না।

তিনি বিশ্বাস করেন, রসুন খাবারের স্বাদকে নাটকীয়ভাবে উন্নত করে।

রসুন ছাড়া ফরাসি রান্না আদৌ কেমন হতো এমন প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি না ফরাসিরা রসুন ছাড়া কোনো ঝাল বা নোনতা খাবার কল্পনাই করতে পারে। স্যুপ থেকে শুরু করে সবজির বা মাংসের পদ—কোথাও না কোথাও অবশ্যই একটা রসুন থাকে। রসুন ছাড়া রান্না করা একেবারেই অকল্পনীয়’।

কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে ডেনমার্কের গ্রামে বড় হওয়া জেনসনের জন্য রসুন তখন প্রায় অচেনা ছিল। তিনি স্মৃতিচারণ করেন, তখন তীব্র গন্ধের কারণে রসুন অনেকটা কুখ্যাতই ছিল।

পরে তুর্কি শ্রমিকরা ডেনমার্কে আসতে শুরু করলে রসুনের ব্যবহার বাড়ে। শেফ জেনসেন ইতালিয়ান পিৎজার মাধ্যমেও রসুনের সঙ্গে পরিচিত হন এবং এখন তিনি একে শীতকালীন প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করেন।

তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গী আর আমি সকালে এক কাপ স্যুপ খাই, প্রতিটি কাপে একটা করে পিষে দেওয়া রসুন থাকে। আমাদের কোনো সর্দি-কাশি বা ফ্লু হয়নি—আমি নিশ্চিত এটা রসুনের কারণেই’।

দাসদের পাত থেকে রাজরাজরার থালায় - এক দীর্ঘ যাত্রা:

রসুনের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব হাজার বছর ধরে বিস্তৃত। প্রাচীন গ্রীকরা জাদুবিদ্যার দেবী এবং গৃহপালিতদের রক্ষাকর্তা হেকাটিকে উৎসর্গ করে চৌরাস্তার মোড়ে রসুন রেখে যেত।

মিশরে বিখ্যাত ফারাও তুতেনখামুনের সমাধিতেও রসুন পাওয়া গেছে, যা পরকালে তাকে রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করা হতো।

চীনা ও ফিলিপিনো লোককাহিনীতে রসুন ব্যবহার করে রক্তচোষা প্রাণী বা ভ্যাম্পায়ার তাড়ানোর গল্পও আছে।

‘গার্লিক: অ্যান এডিবল বায়োগ্রাফি’ বইয়ের লেখক রবিন চেরি বলছেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো রেসিপি হলো এক মেসোপটেমীয় স্ট্যু, যার বয়স প্রায় তিন হাজার ৫০০ বছর এবং তাতে রসুনের দুটো কোয়া ছিল’।

তিনি আরো বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে রসুনের ব্যবহারের কথা উল্লেখ রয়েছে প্রায় তিন হাজার ৫০০ বছর আগে।’

একে এবার্স প্যাপিরাস বলা হয় এবং অসুস্থতা থেকে শুরু করে পরজীবী, হৃদরোগ বা শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিরাময়ে কীভাবে রসুন ব্যবহার করা যায় তার উল্লেখ রয়েছে।

চেরি জানান, প্রাচীন গ্রিক চিকিৎসক ও দার্শনিক হিপোক্রেটাস নানা চিকিৎসায় রসুন ব্যবহার করতেন।

তাছাড়া, অ্যারিস্টটল এবং অ্যারিস্টোফেনিসের মতো বিশিষ্ট চিন্তাবিদ এবং লেখকরাও ওষুধি গুণাবলীর জন্য রসুনের কথা উল্লেখ করেছেন।

দাসদের খাবার থেকে শুরু করে রাজপরিবার পর্যন্ত, প্রাচীন মেসোপটেমিয়া, মিশর, গ্রীস, রোম, চীন এবং ভারতে রসুন ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।

রোমান সেনারা বিশ্বাস করতেন রসুন তাদের সাহস ও শক্তি বাড়ায়, তাই তাদের যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে রসুন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

যদিও খাদ্য ও ওষুধ দুই হিসেবেই রসুন ব্যবহার হতো, তবে রান্নায় এর ব্যবহার মূলত নিম্নবিত্ত শ্রেণিতেই সীমাবদ্ধ ছিল।

চেরি বলেন, ‘রসুন মূলত দরিদ্র মানুষের খাবার ছিল। মিশরে যারা পিরামিড তৈরি করছিল সেসব দাসেরা, বা রোমান নাবিকরা, তাদের শক্তি জোগাতে এটা দেওয়া হতো। এটি ছিল সস্তা, আর খারাপ খাবারের গন্ধ ঢাকতে পারত। তাই এটা ‘গরিবদের খাবার’ হিসেবে বিবেচিত হতো।’

রেনেসাঁ যুগে, অর্থাৎ ১৪ থেকে ১৬ শতকের ইউরোপে, রসুনের ভাবমূর্তি বদলাতে শুরু করে। এ সময়টা ছিল শিক্ষা, শিল্প ও বিজ্ঞানের নবজাগরণের যুগ।

চেরি বলেন, ‘ফ্রান্সের রাজা চতুর্থ হেনরি'কে রসুন দিয়ে ব্যাপটাইজ করা হয়েছিল এবং তিনি প্রচুর রসুন খেতেন। এর ফলে রসুন কিছুটা জনপ্রিয়তা পায়। উনবিংশ শতকে ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডেও রসুনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়’।

যদিও যুক্তরাষ্ট্রে রসুন পৌঁছায় আরো অনেক পরে, ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে, অভিবাসীদের মাধ্যমে। এতে রসুন নিয়ে নেতিবাচক ধারণা বদলাতে শুরু করে।

চেরি বলেন, ‘আসলে ‘রসুনখেকো’ শব্দটি একসময় ইহুদি, ইতালীয় ও কোরিয়ানদের প্রতি অবমাননাকর অর্থে ব্যবহার করা হতো’।

ওষুধ হিসেবে রসুন:

বর্তমানে বিশ্বে ৬০০-রও বেশি প্রজাতির রসুন রয়েছে। এর মধ্যে কিছু, যেমন মধ্য এশিয়ার উজবেকিস্তান বা ককেশাসের জর্জিয়া থেকে উৎপন্ন রসুন, সম্প্রতি বিশ্ববাজারে পাওয়া যাচ্ছে।

আধুনিক রান্নায় ব্যবহারের পাশাপাশি, রসুন সাধারণত সর্দি-কাশি বা ঠান্ডার উপসর্গ কমাতে ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল গবেষণায় রসুনের রক্তচাপ, কোলেস্টেরল এমনকি ক্যান্সারের ওপর প্রভাব দেখতে পরীক্ষা করা হয়েছে, তবে ফলাফল মিশ্র।

ইরানে পরিচালিত একটি ছোট গবেষণায় দেখা গেছে, ছয় সপ্তাহ রসুন ও লেবুর রস খেলে কোলেস্টেরল ও রক্তচাপ কিছুটা কমাতে সাহায্য করে।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ জন সুস্থ ব্যক্তির ওপর ছয় মাসব্যাপী গবেষণায় কোলেস্টেরল কমার কোনো উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

অস্ট্রেলিয়ার সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় রসুনের শক্তিশালী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল, অ্যান্টিভাইরাল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল বৈশিষ্ট্য নিশ্চিত করা হয়েছে।

ব্রিটিশ ডায়েটেটিক অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র এবং একজন শিশু ডায়েটিশিয়ান বাহি ভ্যান ডি বোর বলেন, ‘রসুনে উচ্চ মাত্রায় পটাসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, সালফার এবং মাঝারি পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ এবং আয়রন রয়েছে। এটি একটি বিস্ময়কর খাবার।’ তিনি বলেন, ‘রসুনে অ্যালিসিন নামে সালফারযুক্ত যৌগ আছে। এটি প্রিবায়োটিক ফাইবারে সমৃদ্ধ, যা আমাদের অন্ত্রের জন্য খুব উপকারী। এতে জীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে’।

তিনি আরো বলেন, রসুনের ফাইবার অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পুষ্টি দেয় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য ও পেট ফাঁপার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।

প্রতিদিন এক থেকে দুই কোয়া কাঁচা রসুন খাওয়া প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিরাপদ বলে ধরা হয়।

তবে আমেরিকান ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ক্লিনিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত রসুন গ্রহণ, বিশেষ করে খালি পেটে, হজমে অস্বস্তি, গ্যাস, এবং অন্ত্রের জীবাণুসমূহের ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটাতে পারে।

গবেষণাপত্র অনুসারে, অতিরিক্ত পরিমাণে গ্রহণ, বিশেষ করে খালি পেটে, গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল বিপর্যয়, পেট ফাঁপা এবং অন্ত্রের উদ্ভিদের পরিবর্তনের কারণ হতে পারে।

ফলে অন্য সবকিছুর মতোই পরিমিতিবোধ থাকতে হবে রসুনের বেলাতেও।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত