৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন, কতটুকু প্রস্তুত ছাত্র সংগঠনগুলো?

এস এম তাওহীদ, জাবি
প্রকাশ : ০৪ জুন ২০২৫, ২০: ৩৯
আপডেট : ০৪ জুন ২০২৫, ২০: ৫৯

দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আগামী ৩১ জুলাই অনুষ্ঠিত হবে বহুল প্রতীক্ষিত এই নির্বাচন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, সব জায়গায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন জাকসু নির্বাচন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠনগুলোর দাবি, জুলাই অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া স্বৈরাচারের দোসরদের (শিক্ষক-শিক্ষার্থী) বিচার যেন জাকসু নির্বাচনের আগেই নিশ্চিত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী বিচার কাজের রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে প্রশাসনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী বিচার কার্য সম্পন্ন হওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীদের মনে রয়েছে সংশয়। তবে সবকিছু ঠিক থাকলে আর মাত্র ৫৭ দিন পরে অনুষ্ঠিত হবে জাকসু নির্বাচন। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, জাকসু নির্বাচনের জন্য কতটুকু প্রস্তুত ছাত্র সংগঠনগুলো?

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র অধিকার পরিষদের কমিটি রয়েছে। তাছাড়া কমিটি না থাকলেও কার্যক্রম পরিচালনা করছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। একইসাথে ৫ আগস্ট পরবর্তী পদত্যাগকৃত সমন্বয়কদের দ্বারা গঠিত ক্যাম্পাসভিত্তিক সংগঠন গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে কাজ করে আসছে।

জাকসু নিয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর প্রস্তুতি জানার চেষ্টা করেছেন এ প্রতিবেদক।

ছাত্রদল: দীর্ঘ নয় বছর পর গত ৮ জানুয়ারি ৩০ দিন মেয়াদী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের ছাত্রত্ব প্রায় দশ বছর আগে শেষ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের সমালোচনার মুখে। তবে কমিটি গঠনের পর একাধিক শিক্ষার্থী বান্ধব কাজের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে ছাত্রদল। তবে গত মাসে ভ্যাকসিন কেলেঙ্কারির ঘটনা প্রকাশিত হলে শিক্ষার্থীদের মাঝে বিরূপ প্রভাব ফেলে। যদিও তারা এই ঘটনাকে অপপ্রচার দাবি করেছে। জাকসুর তফসিল ঘোষণার পর পদের ক্রমে সিনিয়র নেতাদের কারোই ছাত্রত্ব না থাকায় কে প্রার্থী হবেন তা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। এখন পর্যন্ত পরিচিত কোনো মুখই সামনে আসেনি জাকসু নির্বাচনকে সামনে রেখে।

জাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহিরউদ্দিন মোহাম্মাদ বাবর বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঘোষিত সময়ে জাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সবধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে জাকসু এবং হল সংসদ নির্বাচনের জন্য সম্ভাব্য খসড়া তালিকা সম্পূর্ণ করেছি। পরবর্তীতে যোগ্যদের দিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এখনো জুলাই-অগাস্টে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারী সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ এবং হামলার মদদ দাতা ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারের আওতায় আনেনি। ফ্যাসিবাদের দোসর শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আসীন রয়েছে। এই অবস্থায় আমরা মনে করি, সবার অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়।’

ছাত্রশিবির: দীর্ঘ পঁইত্রিশ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে ইসলামি ছাত্র শিবির। গত বছরের ৩০ অক্টোবর প্রকাশ্যে আসে জাবি শাখা ছাত্র শিবির। এরপর থেকে শিক্ষার্থী বান্ধব কাজ করে যাচ্ছে। শিবিরের প্রকাশ্যে রাজনীতি করা নিয়ে শুরুতে বিরোধিতা করে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলো। তবে শিক্ষার্থীদের মাঝে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ায় তাদের বিরোধিতা তেমন প্রভাব ফেলেনি শিবিরের রাজনীতিতে। ইতোমধ্যে শিবির বেশ কিছু শিক্ষার্থী বান্ধব কার্যক্রম পরিচালনা করে শিক্ষার্থীদের মাঝে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে। তবে ছাত্র শিবিরের সভাপতি ও সেক্রেটারির ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে গত বছর। তাই তারা অংশ নিতে পারবেন না আসন্ন জাকসু নির্বাচনে। তবে শিবিরে একাধিক নেতা-কর্মীর সাথে কথা বলে জানা যায়, শাখা শিবিরের অফিস ও প্রচার সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম রয়েছেন ভিপি প্রার্থীর তালিকায়।

নির্বাচনে প্রস্তুতির বিষয়ে জাবি শাখা সভাপতি মহিবুর রহমান মুহিব বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল জাকসু নির্বাচন। ইতোমধ্যে জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। আমরা হল সংসদ ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য ইতোমধ্যে নিজেদের প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি। কোন পদে কে নির্বাচন করবে তা মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে আমরা এখনই ঘোষণা করতে চাই না। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা জানিয়ে দেব। আমরা আশা করছি প্রশাসন একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবে। আর সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অবশ্যই প্রশাসনকে জুলাইয়ের শিক্ষার্থীদের উপর হামলাকারী নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ও মদদ দাতা শিক্ষকদের বিচার করতে হবে।’

নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তবে গত বছরের ৩ অক্টোবর ১৭ জন সমন্বয়ক একযোগে পদত্যাগ করলে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তারা। তবে বর্তমানে আবার শক্তিমত্তা বৃদ্ধি পেয়েছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী বান্ধব নানা কর্মসূচী পালন করছে তারা। তাদের ভিপি প্রার্থী হিসেবে অনেকটাই চূড়ান্ত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জান উজ্জ্বল বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র। নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন জাবি শাখার আহ্বায়ক আরিফুজ্জান উজ্জ্বল বলেন, ‘আমরা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত রয়েছি। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছি। আমরা আশা করছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ঘোষিত সময়ের মধ্যে বিচার কাজ শেষ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেবে।’

ছাত্র ইউনিয়ন: ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে দুইটি গ্রুপ হওয়ার পর থেকেই ক্যাম্পাসে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল অবস্থায় রয়েছে তারা। ছাত্র ইউনিয়নের দুই অংশের কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থী বান্ধব নানা কর্মসূচী পালন করছে তারা। নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জাবি ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি অমর্ত্য রায় বলেন, ‘তেত্রিশ বছর পর জাকসু হচ্ছে, এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার। শিক্ষার্থীদের কাছে, রাজনৈতিক সংগঠনে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য জাকসু নির্বাচন বহুল প্রত্যাশিত ব্যাপার। জাকসুর প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের কার্যনির্বাহী সংসদের আলাপ-আলোচনা এখনো চলমান। জোটগতভাবে এবং অনেককে যুক্ত করে নির্বাচন করার ব্যাপারেও প্রাথমিক আলোচনা চলছে। সেগুলো পরবর্তী ধাপে অতিক্রম করার পর আমরা আরো সুস্পষ্টভাবে জানাতে পারবো বলে আশা রাখছি।’

গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন: পদত্যাগকৃত সমন্বয়কদের সংগঠন ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ও নির্বাচনের দৌড়ে বেশ এগিয়ে আছে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ে শুরু থেকেই তাদের দেখা গেছে। তাদের ভিপি প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন সংগঠনটির আহ্বায়ক আবদুর রশিদ জিতু। নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে জিতু বলেন, ‘শুরু থেকেই আমরা ছাত্রসংসদ নির্বাচনের দাবি করে আসছি। আমরা চাই, একটি স্বচ্ছ, কার্যকর ও অংশগ্রহণমূলক ছাত্রসংসদ, যেখানে শিক্ষার্থীদের মতামত ও স্বার্থ গুরুত্ব পাবে। ছাত্রসংসদ হবে অধিকার প্রতিষ্ঠার শক্তিশালী কণ্ঠস্বর। নির্বাচনের এই সময়ে, ক্যাম্পাসজুড়ে মতবিনিময় করব, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলব। আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনী ইশতেহার হতে হবে শিক্ষার্থীদের চাওয়া-পাওয়ার প্রতিফলন। তাই সবাইকে সম্পৃক্ত করেই তা প্রস্তুত করব।’

ছাত্র অধিকার পরিষদ: ছাত্র অধিকার পরিষদের কমিটি থাকলেও তাদের তেমন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায় না বিশ্ববিদ্যালয়ে। অনেকটা নিস্তেজ অবস্থায় রয়েছে গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে।

সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট: সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের দু’অংশের একটিরও কমিটি নেই। নেতাকর্মীর সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকজন।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত