কবিগুরু আলাওল

ধূসর জগৎ থেকে যুগের আলোয়

গুলজার গালিব খান
প্রকাশ : ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫: ১৬

মুসলমান সুলতানদের রাজকীয় আনুকূল্য বাংলা কাব্যের উন্মেষ-বিকাশে প্রধান ভূমিকা রেখেছিল মধ্যযুগে। তখন মুসলমান কবি ও পদকর্তারা কাব্য রচনা করছেন জীবন উপজীব্য করে। ধর্মীয় অলৌকিকতা অতিক্রম করে তারা কাব্যের উপাদান হিসেবে গ্রহণ করছেন মানবিক অনুভূতি, জীবনাবেগ ও সৌন্দর্যচেতনা। হিন্দু কবিরা তখন ধর্মীয় আবেগ ও দেবতার কাছে সমর্পণের আকুতিতে নিবদ্ধ। মুসলমান কবিরা রচনা করছেন রোমান্টিক প্রণয়কাব্য, হিন্দু কবিরা দেবদেবীর স্তুতি।

বিজ্ঞাপন

মুসলমান কবিসমাজের এ অগ্রগামিতা সম্ভব হয়েছিল ফার্সি সাহিত্যে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও আন্তরিক মনোযোগের ফলে। তখন বাংলার রাষ্ট্রীয় বা রাজকীয় ভাষা ছিল ফার্সি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই ফার্সির সঙ্গে পরিচিত ও অভ্যস্ত ছিলেন। কিন্তু ফার্সি কাব্যসাহিত্যের রোমান্টিক রস কেবল মুসলমান কবিদের পক্ষে সমাদর করা সম্ভব হলো। জাগতিক জীবনের আনন্দ-বেদনা বাংলা কাব্যে তারা স্থান দিলেন। মধ্যযুগের বাংলা কাব্যে মানুষ বিষয় হয়ে উঠল এই প্রথম। ফার্সির সঙ্গে সমানভাবে সম্পর্কিত থাকার পরও হিন্দু কবিদের এই স্থবিরতার কারণ অনুদার মনোভাব বলে অনুমিত হয়।

মধ্যযুগের সাহিত্যের প্রধান প্রবণতা অনুবাদ। হিন্দি ও ফার্সি গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ বাংলা সাহিত্যে প্রাধান্য পেয়েছে। আরবি-সংস্কৃত থেকেও অনুবাদ হয়েছে। বিষয় বিবেচনায় ধর্মীয় ও ইতিহাসাশ্রিত উপাখ্যান বেশি। শব্দানুগত অনুবাদ সম্ভবত সচেতনভাবেই করতে চাননি কবিরা। আখ্যান বর্ণনায় স্বাধীন ভাবের অনুসরণ এবং বাঙালির সমাজ চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আত্তীকরণ এর বিশেষ প্রমাণ। হিন্দি-ফার্সি প্রণয়কাহিনিগুলো ছিল রূপক প্রণয়ের, বাংলায় সেসব লাভ করেছে লৌকিক-মানবিক প্রণয়রূপ। মুসলমান কবিদের কাব্যে এই রোমান্টিক-মানবিক ধারা তখন উজ্জ্বলতর।

বাংলা-ভারতীয় সাহিত্যে শাহ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জোলেখা’ কাব্য সম্ভবত প্রথম রোমান্টিক-মানবিক প্রণয়োপাখ্যান। রচিত হয়েছিল পনেরো শতকে। দৌলত উজির বাহরাম খানের ‘লাইলী মজনু’, মুহম্মদ কবীরের ‘মধুমালতী’ শাহ বারিদ খানের ‘বিদ্যাসুন্দর’ প্রভৃতি ষোলো শতকে রচিত। সতেরো শতকের উল্লেখযোগ্য কাব্য আলাওলের ‘পদ্মাবতী’, ‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’, ‘সপ্তপয়কর’ ইত্যাদি।

আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সীর পদুমাবতের অনুবাদ। কিন্তু শব্দানুগত অনুবাদের বদলে এতে অনুসরণ করা হয়েছে স্বাধীন ভাবানুগত সৃজনশীল ধারা। এটি ‘পদ্মাবতী’কে বিশিষ্টতা দিয়েছে। তত্ত্ব ও রূপকের অনুসরণ না করে আলাওল এতে গ্রহণ করেছেন গেরস্থালি, সমাজঘনিষ্ঠতা, ব্যক্তিবোধ ও মানব-মানবীর আত্মিক অনুভূতি।

পদ্মাবতীর রূপের বিবরণ দেন আলাওল—

পদ্মাবতী—রূপ কী কহিব মহারাজ।

তুলনা দিবারে নাহি ত্রিভুবন মাঝ।।

আপাদ লম্বিত কেশ কস্তুরি সৌরভ।

মহা অন্ধকারময় দৃষ্টি-পরাভব।।

আলাওল বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের অন্যতম কবি, মুসলিম কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের সবচেয়ে বড় সংগ্রাহক আব্দুর করিম সাহিত্যবিশারদ আলাওলকে সতের শতকের রবীন্দ্রনাথ হিসেবে অভিহিত করেন।

গৌড়বাসী রৈল আসি রোসাঙ্গের ঠাম।

কবিগুরু মহাকবি আলাওল নাম।।

আলাওলকে ‘কবিগুরু’ ও ‘মহাকবি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন আঠারো শতকের কবি মুহম্মদ মুকীম। মহাকাব্যের রচয়িতা অর্থে ভারতবর্ষের ব্যাসদেব, বাল্মীকি, গ্রিসের হোমার, ইলিয়াড, ব্রিটেনের মিল্টন, ইতালির দান্তে ও বাংলার মধুসূদন দত্ত মহাকবি ছিলেন। সেকালের একজন উচ্চ মানের প্রতিভাধর ও অনুসরণযোগ্য কবি হিসেবে মুহম্মদ মুকীম আলাওলকে কবিগুরু ও মহাকবি অভিহিত করেছেন।

আলাওল প্রায় গোটা জীবন অতিবাহিত করেছেন রোসাঙ্গ বা আরাকানের রাজদরবারে। আরাকানের রাজদরবারে মুসলমান আমিরদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। কোরেশী মাগন ঠাকুর, সৈয়দ মুছা, ছোলেমান, সৈয়দ মুহম্মদ খান, সৈয়দ ছউদ শাহ, মজলিশ প্রভৃতি আমিররা রাজদরবারে উচ্চপদে আসীন ছিলেন। তাদের আগ্রহ, আনুকূল্য ও অনুরোধে আলাওল কাব্য রচনা করেছিলেন। কবিগুরু আলাওলের সকল কাব্যগ্রন্থই অনুবাদ। অনুবাদে আলাওলের কৃতিত্ব তুলনাহীন। তার কাব্যগ্রন্থ অনুবাদের সীমানা অতিক্রম করে অভিনব সৌন্দর্যে সমাদৃত।

‘পদ্মাবতী’ আলাওলের প্রথম ও প্রধান রচনা। হিন্দি ভাষার প্রাচীন কবি মালিক জায়সী পদুমাবৎ নামক কাব্য রচনা করেন। আলাওল সেটিকে পদ্মাবতী নামে বাংলায় অনুবাদ করেন। আরাকানের রাজা থাদো মিন্তারের রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রী কোরেশী মাগন ঠাকুরের আদেশে এটি রচনা করেন আলাওল।

পদ্মাবতী কাব্যে দুটি পৃথক রসের প্লট দেখা যায়। প্রথম পর্বে মিলনাত্মক সমাপ্তি দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয় অংশটি ইতিহাসকেন্দ্রিক। এই অংশে আছে বীরত্ব ও যুদ্ধের বিবরণ। কাহিনি ট্র্যাজিক পরিণতির পরিবর্তে মিলনাত্মক পরিসমাপ্তি লাভ করে।

‘সতীময়না-লোর-চন্দ্রানী’ আলাওলের অন্যতম রচনা। আরাকান রাজসভার সামরিক সচিব আশরাফ খানের আদেশে দৌলত কাজী এটি রচনা শুরু করেন। শেষ হওয়ার আগেই কবি মারা যান। তখন রাজদরবারের প্রধান অমাত্য সোলেমানের আদেশে আলাওল এ অসমাপ্ত কাব্য সমাপ্ত করেন।

‘সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল’ বাংলা ভাষার রোমান্টিক কাব্যধারার বিশিষ্ট কাব্য। গ্রন্থটি দোনাগাজী, পরবর্তীতে আলাওল ও মালে মুহম্মদ লিখেছেন। তিন রচয়িতার মধ্যে গবেষকরা আলাওলের রচনাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।

আরাকান রাজসভার সান্দ থুধর্ম্মার আমলে সমর-সচিব সৈয়দ মুহম্মদের আদেশে আলাওল ফার্সি কবি নিজামি গজনবির ‘হপ্ত পয়কর’ কাব্য বঙ্গানুবাদ করেন ‘সপ্তপয়কর’ নামে। ‘তোহফা’ রচনা করেন কবি ইউসুফ গদা রচিত তোহফা গ্রন্থ থেকে। রাজসভার মন্ত্রী সুলাইমানের আদেশে আলাওল এটি অনুবাদ করেন।

আলাওলের একটি বিশিষ্ট রচনা ‘সেকান্দারনামা’। অনুবাদের আদেশ করেন রাজমন্ত্রী নবরাজ মজলিশ। সেকান্দারনামায় কবি নেজামী আরবি, ফার্সি, ইংরেজিসহ পাঁচটি ভাষার ব্যবহার করেছিলেন। সে কারণে এটির অনুবাদ ছিল অত্যন্ত দুরূহ। তবে অসাধারণ পাণ্ডিত্য ও বহু ভাষার অধিকারী হওয়ায় আলাওল এই গ্রন্থের অনুবাদ করেন সাফল্যের সঙ্গে। আলাওলের কবিখ্যাতি এই অনুবাদের মাধ্যমে আরও বিস্তৃত হয়।

রচনার পরিমাণ ও শিল্পমূল্য বিচারে আলাওল বাংলা সাহিত্যে সমাদৃত। তার যুগন্ধর প্রতিভা ও সাহিত্যকর্মের বৈশিষ্ট্য তাকে অনন্যতা দিয়েছে। মধ্যযুগের কবিদের মধ্যে তিনি সর্বাধিক সংখ্যক কাব্য রচনা করেন। সর্বাধিক সংখ্যক ভাষাজ্ঞানের অধিকারী ছিলেন। পণ্ডিত-কবি হিসেবে তিনি স্বীকৃত। তার বাগবৈদগ্ধ্য, রস-রুচি ও সৌন্দর্যবোধ ছিল উচ্চমার্গীয়। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সংস্কৃতির প্রতি সমান গুরুত্ব তার রচনায় আবিষ্কার করা যায়।

মধ্যযুগের ধূসর জগৎ থেকে আলাওলকে উদ্ধার করে মুদ্রণযন্ত্রের সহায়তায় আলোর জগতে আনেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। তার প্রথম আবিষ্কার আলাওলের পদ্মাবতী কাব্য।

আলাওলের জন্ম আনুমানিক ১৫৯৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রাচীন গৌড়ের ফতেহাবাদে। মৃত্যু ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। আলাওলের পিতা ফতেহাবাদ মজলিশ কুতুবের অমাত্য ছিলেন। পিতার সঙ্গে জলপথে আরাকান যাওয়ার পথে পর্তুগিজ জলদস্যুরা আক্রমণ করে। পিতাসহ অন্যরা নিহত হলে বেঁচে যান আলাওল। তখন আরাকান রাজসভায় অনেক বাঙালি অমাত্য গুরুত্বপূর্ণ পদ অলংকৃত করে ছিলেন। আলাওল রাজসভায় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। এ পৃষ্ঠপোষণ আলাওলের কবিপ্রতিভা বিকাশে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত