নাদিয়া কোমানিচির দেশে

তাহমিনা খাতুন
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১১: ৪৫

নাদিয়া কোমানিচির নাম শোনেননি-এমন ক্রীড়ানুরাগী মানুষ বিশ্বে খুঁজে পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ! ১৯৭৬ সালের কানাডার মন্ট্রিয়ল শহরে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসে তিনি সর্বকনিষ্ঠ ‘জিমন্যাস্ট’। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে সর্বোচ্চ ১০ স্কোর পেয়েছিলেন এবং জিমন্যাস্টিকসে তিনটি স্বর্ণ, একটি রৌপ্য ও একটি ব্রোঞ্জপদক লাভ করেছিলেন! বহু বছর পেরোলেও নাদিয়া কোমানিচির ক্রীড়ানৈপুণ্যের কথা মানুষের স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে আজও। নাদিয়া কোমানিচি নামের সঙ্গে তার দেশ রোমানিয়াও যেন একাকার হয়ে গিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

দেশটি ভৌগোলিক বৈচিত্র্যের এক লীলাভূমি! এ দেশে যেমন রয়েছে সুউচ্চ পর্বতমালা, তেমনি রয়েছে দিগন্তবিস্তৃত সমতল মাঠ, নদী, হ্রদ ও বনভূমি। রোমানিয়াকে ড্রাকুলা বা ভ্যাম্পায়ারের দেশ বলা হয়। এই আধুনিক যুগেও এ দেশের মানুষ কালো জাদুতে বিশ্বাস করে। কালো জাদুকে এ দেশে রীতিমতো আইন করে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

ইউরোপের যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বনভূমি রোমানিয়াতে। এসব বন বিভিন্ন বন্যপ্রাণী-সমৃদ্ধ। রোমানিয়ার জাতীয় পতাকার রঙ নীল, হলুদ ও লাল। ১৮২১ সাল থেকে এই রঙগুলো বিভিন্ন পরিচয় বহন করছে। নীল রঙ স্বাধীনতার, হলুদ রঙ ন্যায়বিচারের এবং লাল রঙ ভ্রাতৃত্বের পরিচয় বহন করে। এখানকার ভবনগুলোর নির্মাণশৈলী ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত।

Nadia-3

১৮৭৭ সালে অটোমান শাসকদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পর ‘কিংডম অব রোমানিয়া’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এমন একটা দেশ দেখার আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আগেই। রোমানিয়া দেখার সুযোগও পেয়ে গেলাম। আমার মেয়ে সঞ্চিতার সহকর্মী কৌশিক রোমানিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। কৌশিকের আমন্ত্রণে রোমানিয়া দেখতে যাওয়া হলো।

জেনেভা থেকে রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট প্রায় দুই ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের ফ্লাইট টাইম। কৌশিক এয়ারপোর্ট থেকে আমাদের ওর বাসায় নিতে এলো।

তবে বাসায় যাওয়ার আগে প্রথমেই আমাদের নিয়ে গেল রোমানিয়ার পার্লামেন্ট ভবন দেখাতে। রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টের বেশ উঁচু ‘ডাম্বোভিটা’ নামের এক পাহাড়ের ওপর রোমানিয়ার পার্লামেন্ট ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছে। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পার্লামেন্ট ভবন। তবে রোমানিয়ার পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এই ভবন নির্মাণ করা হয়নি। এটির নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল রোমানিয়ার একসময়কার প্রতাপশালী কম্যুনিস্ট শাসক নিকোলাই চসেস্কুর সময়ে তার বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করার জন্য। নাদিয়া কোমানিচির নাম রোমানিয়াকে যেভাবে গৌরবান্বিত করেছে, একইভাবে নিকোলাই চসেস্কুর নাম রোমানিয়ার ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে!

তিনি ১৯৬৭ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রোমানিয়ার স্টেট কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট এবং একই সঙ্গে ১৯৭৪ থেকে ১৯৮৯ সালের ডিসেম্বরে সংঘটিত রোমানিয়ার বিপ্লবে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হওয়া পর্যন্ত রোমানিয়া প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন! ক্ষমতার অপব্যবহার একজন শাসককে কীভাবে স্বৈরশাসকে পরিণত করে এবং তার করুণ পরিণতি কী হয়েছিল, তা প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ব। নিকোলাই চসেস্কুর শাসনকাল রোমানিয়ার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়! এক টুকরো রুটি পেতে মানুষকে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। চসেস্কু খেয়ালখুশিমতো দেশ পরিচালনা করতেন। নিজের বসবাসের জন্য তিনি এক রাজকীয় প্রাসাদ তৈরি করেন। সেই প্রাসাদই পরবর্তী সময় থেকে রোমানিয়ার পার্লামেন্ট ভবন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে! বর্তমানে এটি বিশ্বের বৃহত্তম প্রশাসনিক ভবন।

নিজের খেয়াল, ব্যক্তিগত স্বার্থ, বিলাসিতা, স্বজনপ্রীতি, শ্রমশিবিরে নির্যাতন, গুপ্তহত্যা, প্রহসনমূলক বিচারে কয়েক লাখ মানুষকে হত্যা প্রভৃতি কারণে চসেস্কুকে ‘কাপের্থিয়ানের কসাই’ বলা হয়। চসেস্কুর এসব অন্যায় কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র জনরোষ সৃষ্টি হয় এবং একপর্যায়ে রোমানিয়ার সাধারণ মানুষ পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলির মুখে অকাতরে বুক পেতে দেয়! বুখারেস্টের মানুষ চসেস্কুর বাসভবন আক্রমণ করলে তিনি সস্ত্রীক হেলিকপ্টারে করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন; কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হন। তাদের দুজনকে সংক্ষিপ্ত এক বিচারে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। দুজনের মৃত্যুদণ্ড ফায়ারিং স্কোয়াডে কার্যকর করা হয়।

পার্লামেন্ট ভবন দেখা শেষ করে কৌশিক আমাদের ওর বাসায় নিয়ে গেল। রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টের কেন্দ্রস্থলে কৌশিকের বাসা। ঘন বড় বড় গাছপালায় ঘেরা মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে বাড়িটি। দেখে মন জুড়িয়ে গেল। কৌশিকের স্ত্রী জুয়েনা মজাদার সব খাবার রান্না করে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। দুপুরের খাবার খাইয়ে কৌশিক আমাদের নিয়ে ছুটল কৃষ্ণ সাগরের পাড়ে।

বুখারেস্ট শহরটি অসংখ্য গাছপালায় ছাওয়া। রাস্তাগুলো যেন বোটানিক্যাল গার্ডেন! বিশ্বের বেশ অনেকগুলো শহরে যাওয়া হয়েছে। মূল শহরে এত গাছপালা খুব কম শহরেই চোখে পড়েছে।

বুখারেস্ট থেকে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার ড্রাইভ কৃষ্ণ সাগরের পাড়। গাড়ি ছুটে চলার সময় সড়কের দুপাশে মাইলের পর মাইল সমতল মাঠজুড়ে হলুদ সরষে ক্ষেত যেন হলুদ সরষে ফুলে ছাওয়া সমতল বাংলাদেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়। রাস্তার দুপাশের সরষে ক্ষেত অপরূপ সৌন্দর্যে ভরপুর।

কৃষ্ণ সাগর হলো একটি আন্তঃমহাদেশীয় সমুদ্র। ইউরোপের দক্ষিণ-পূর্বে এর অবস্থান। কৃষ্ণ সাগরের পানি কেন কালো দেখায়, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। সমুদ্রবিজ্ঞান নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের মতে, জাহাজ থেকে কোনো ধাতব বস্তু, প্রাণিজ পদার্থ বা মৃত উদ্ভিদ প্রায় ৭০ মিটারের বেশি নিচে ডুবে যাওয়ার পর সেখানে বেশ কিছুক্ষণ ওই অবস্থায় থাকে। অক্সিজেনের ঘাটতির কারণে কৃষ্ণ সাগরে সালফাইডের ঘনত্ব তৈরি হয় এবং সালফাইডের ঘনত্বের কারণে কৃষ্ণ সাগরের পানি কালো দেখায়। আবার এই সমুদ্রে চলাচলরত জাহাজের নাবিকদের মতে, কৃষ্ণ সাগরের ওপরে আকাশে বছরের অধিকাংশ সময় মেঘের আনাগোনা থাকার কারণে এই সাগরের পানি কালো দেখায়।

পরদিন কৌশিক আমাদের নিয়ে গেল রোমানিয়ার আরো একটি আশ্চর্যজনক জায়গায়। আর তা হলো ‘স্যালাইন মাইন’ বা লবণের খনি। গাড়ি থেকে নেমে অপেক্ষারত মিনি বাসে উঠলাম। মিনি বাস অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে প্রায় ৪৫ মিনিট চলার পরে আমাদের লবণখনির প্রবেশমুখে নামিয়ে দিল। এরপর ঢালু রাস্তা ধরে আরো অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে ‘স্লানিক’ লবণখনির অভ্যন্তরে প্রবেশ করা গেল।

খনির অভ্যন্তরের তাপমাত্রা সবসময়ই ১২-১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। গ্রীষ্মেও গরম কাপড় সঙ্গে নিয়ে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।

লবণখনির ভেতরে প্রবেশের পর মনে হলো, এ যেন এক অন্য জগৎ! ওপরে-নিচে, সামনে, ডানে-বাঁয়ে—যেদিকেই চোখ যায় সাদা লবণের রাজ্য! দেয়াল থেকে শুরু করে সব জায়গাতেই লবণ আর লবণ। কৌতূহলবশত দর্শনার্থীরা দেয়াল থেকে চিমটি দিয়ে লবণ নিয়ে জিভে পরখ করে দেখেন।

Nadia-2

সাদা লবণের ওপর বাতির আলো পড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা। লবণখনির ভেতরে লবণ দিয়ে তৈরি করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপত্য এবং মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি। এ ছাড়া যেসব যন্ত্রপাতির সাহায্যে খনিতে কাজ করা হতো, সেসব যন্ত্রপাতিও প্রদর্শনের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে। লবণখনির ভেতরেই রয়েছে দারুণ সুন্দর এক লেক ও ফোয়ারা! বিশাল লবণখনির এক কোণ দিয়ে কুলু রবে পানির ফোয়ারা নেমে লেকের পানিতে মিশে যাচ্ছে! দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল!

পরদিন যাওয়া হলো বুখারেস্টের ১৫০ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী রেস্তোরাঁ কারু কা বেরে (Karu ka bere) দেখতে। গথিক (মধ্যযুগের রোমান স্থাপত্যরীতিতে তৈরি অট্টালিকা বা ভবন) রোমানিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র। যেকোনো উন্নত দেশের তুলনায় রোমানিয়ায় লেখাপড়ার খরচও অনেক কম। এছাড়া বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে।

নিকোলাই চসেস্কুর দুঃশাসন শেষ হওয়ার পর রোমানিয়ায় দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করেছে। চসেস্কুর শাসনকালে যে দেশটির মানুষকে এক টুকরো রুটি জোগাড় করতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সেই দেশটি রীতিমতো উন্নত দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে!

কয়েক দিন কৌশিক ও জুয়েনার উষ্ণ আতিথেয়তা উপভোগ করে ফিরে গেলাম জেনেভায়।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত