ঝালমুড়ি বিক্রি করেই চলে জান্নাতের জীবন

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ১৪ আগস্ট ২০২৫, ১১: ২০

মেয়েটির নাম জান্নাতুল ফেরদৌস, ডাকনাম জান্নাত। পড়ালেখা করছেন নরসিংদীর শিবপুরের শহীদ আসাদ কলেজে। তিনি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়ার বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান। তার এইচএসসিও একই কলেজে ছিল। আর স্কুল ছিল মজলিশপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়।

বিজ্ঞাপন

নরসিংদীর এই মেয়ে জান্নাতুলের বাবা কৃষিকাজ করেন। তারা চার বোন। তবে বাবার আয়ে এখন আর তারা পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারছেন না। তাই পার্ট টাইম কাজ করেছেন। তবে জান্নাত বলেছেন, ‘চাকরিবাকরিতে সুবিধা পাই না, নিরাপত্তাও পাই না। যে স্যালারি দেয় তাতে ভালোভাবে চলা যায় না। বাড়িতে থেকেও কোনো কাজ হয় না।’ তাই তারা দুই বোন মাইমুনা জান্নাত মাওন ও জান্নাতুল ফেরদৌস ঢাকায় চলে এসেছেন। ঢাকায় তারা শনির আখড়ায় থাকেন।

তিনি গ্রাম থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেছেন। কিছুদিন হলো ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন জান্নাত। এর আগে তিনি আনারস, আম ও পেয়ারামাখা বিক্রি করতেন। সে সময় হাতে চার হাজার টাকা ছিল। সেই টাকাগুলোই বিনিয়োগ করেছেন। পরে মা আবার বাড়তি তিন হাজার টাকা পাঠিয়েছেন। চার হাজার টাকা দিয়ে প্রথমে যাত্রাবাড়ী আড়ত থেকে আম, পেয়ারা ও আনারস কিনে এনে কাজ শুরু করেছেন। ৩০ টাকা প্লেট ছিল। কোনোদিন ১ হাজার ৫০০, কোনোদিন ১ হাজার ২০০, কোনোদিন ৮০০, আবার কোনোদিন ৬০০ টাকা বিক্রি হতো। আর এখন ঝালমুড়ি বিক্রি করছেন তিন মাস ধরে। এখানে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকার মতো মাসে খরচ হচ্ছে। সবকিছু বাদ দিয়ে মাসে ২৬ থেকে ২৭ হাজার টাকার মতো থাকছে। ব্যবসা করার বুদ্ধি তার নিজের। আর বোন জান্নাতুলকে ঝালমুড়ি বানাতে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করে মাইমুনা। সে মজলিশপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে পড়ে।

জীবনের প্রয়োজনে জান্নাতকে এ বয়সেই কর্মক্ষেত্রে নামতে হয়েছে। তিনি সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিও করেছেন বসুন্ধরা শপিং মলে। সেখানে নিরাপত্তা বিভাগে পাঁচ মাস প্রহরীর কাজ করেছেন। ওই কাজে যোগ দিয়েছিলেন ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে। বেতন পেতেন সাড়ে ১০ হাজার টাকা। নিরাপত্তার অভাব বোধ করে ছেড়ে দিয়েছেন। তার পর থেকে নিজে ব্যবসা করছেন। এখন যে ঝালমুড়ির ব্যবসা করছেন তাতে ছয়-সাতশ টাকা দৈনিক পুঁজি খাটছে তার। দিনে লাভ হয় ভালো। বিক্রি হলে কমবেশি এক হাজার টাকা লাভ থাকে। নিজের এই ব্যবসার টাকা দিয়ে তিনি তার লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছেন, বাসাভাড়া দিচ্ছেন। আবার ঢাকায় চলাফেরা ও খাওয়া-খরচও জোগাড় হচ্ছে এই ব্যবসার টাকায়। বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠান।

তিনি বলেন, বাড়িতে মনমতো টাকা পাঠাই মা-বাবাকে। ওখানে আমার এক বোন থাকে। আরেক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। তার পরিকল্পনা আছে লেখাপড়া শেষ করে একটি সরকারি চাকরি করবেন।

তিনি সপ্তাহে এক দিন ক্লাস করতে নরসিংদী যান। সেটি হলো মঙ্গলবার। বাকি পাঁচ দিন ঢাকায় দোকান করেন, আর এক দিন কাজ থেকে ছুটি নেন। সেদিন বিশ্রাম করেন। তার মা-বাবা এখনো জানেন না, তিনি এই ব্যবসা করছেন। একে তো গ্রামের মানুষ, তার ওপর আগের জমানার—উল্টোপাল্টা ভাবতে পারেন বলে এখনো জানাননি। ইচ্ছা আছে পরিবেশ অনুকূলে এলে সবকিছু জানাবেন।

দুই মাস হলো শনির আখড়ায় বাসা নিয়ে আছেন দুই বোন। বাড়িভাড়া মাসে পাঁচ হাজার টাকা। ঝালমুড়ি বিক্রির টাকাতেই চলছে তাদের জীবন। ঢাকায় তারা আছেন ১১ মাস ধরে। তিন মাস ফল বিক্রি করেছেন। আর বর্তমানের ব্যবসায় আছেন দুই মাস। এর মধ্যে জান্নাত নিজের ভাগ্যকে আরো এগিয়ে রেখেছেন। যাত্রাবাড়ী পার্কের পাশে দোকান কিনে রেখেছেন তিন হাজার টাকা দিয়ে। সেখানে খাবারের আইটেমের দোকান দেবেন। তার পরিকল্পনা রয়েছে দু-এক মাসের মধ্যে চালু করবেন ওই দোকান। এখন যে খরচ, সেটি আর কুলাতে পারছেন না বলে দোকানটিও শুরু করতে পারছেন না।

তার খুব ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। সেখানে যোগদানের জন্য প্রয়োজনীয় শারীরিক সক্ষমতা আছে তার। লম্বা, গায়েও বল আছে। তিনি খেলাধুলায়ও পারঙ্গম। ২০২১ ও ২০২২ সালে তাদের দল ঢাকা বোর্ডে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারা থানা, জেলা ও জোন পর্যায়ে খেলেছেন। বিভাগগুলো ছিল অ্যাথলেটিকস, দৌড়, বর্শা নিক্ষেপ, লৌহগোলক নিক্ষেপ, ফুটবল, ভলিবল ও হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত