Ad T1

মধুর আমার মায়ের হাসি

আহমেদ প্রান্ত
প্রকাশ : ০৮ মে ২০২৫, ১১: ৩১

‘মা’ এই শব্দটির মধ্যে লুকিয়ে আছে ভালোবাসা, ত্যাগ আর অসীম মমতার গল্প। কিন্তু জীবনের কিছু মুহূর্তে মাকে নিয়ে কষ্টের ছায়া পড়ে। হয়তো মায়ের দূরে থাকা, তার অসুস্থতা বা তাকে হারানোর বেদনা—এসব অনুভূতি মনের গভীরে দাগ কাটে। জন্ম দেওয়া থেকে শুরু করে পরিপূর্ণ মানুষ হওয়ার যে প্রক্রিয়া পুরোটাই করেন মা।

১৯০৭ সালে আনা জারভিস তার মাকে নিয়ে স্মরণসভা করার পরের বছর থেকে ধীরে ধীরে অন্যান্য জায়গায়ও মা দিবস পালিত হতে থাকে। ১৯১০ সালে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়ায় সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়, আর ১৯১৪ সালে তো আমেরিকাজুড়েই এটি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়। তবে আরো বহুকাল আগে থেকে মাকে সম্মান দিয়ে আসছেন মুসলমানরা।

ইসলাম ধর্ম মাকে দিয়েছে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান। ইসলামের দৃষ্টিতে বাবার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিনগুণ বেশি। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে—হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী করিম (সা.)-এর খেদমতে উপস্থিত হয়ে জানতে চান, ‘হে আল্লাহর রাসুল! মানুষের মধ্যে আমার কাছে সর্বোত্তম সেবা লাভের অধিকার কার?’নবী করিম (সা.) বলেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবার জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবার জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার মায়ের।’ লোকটি আবারও জানতে চান, ‘তারপর কার?’ তিনি বললেন, ‘তোমার বাবার।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

তিন রকম দোয়া নিঃসন্দেহে কবুল হয়—মজলুমের দোয়া, মুসাফিরের দোয়া আর সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের দোয়া। [মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.)]।

পত্রপত্রিকায় মাকে নিয়ে সন্তানদের আবেগতাড়িত যত লেখা বের হয়, আমি সেগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি। মাকে নিয়ে লেখা কোনো গান কারো কণ্ঠে শুনলে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। তখন নিজেকে ধরে রাখতে পারি না। বুকের নীরব কান্নাগুলো চোখের পানিতে সরব হয়ে ওঠে। কেবলই মনে হয়, মাকে নিয়ে বুকের মধ্যে জমে থাকা সবটুকু ভাবাবেগ দিয়ে গানগুলো লেখা হলেও কোনোটাই মায়ের বাস্তব প্রতিরূপ হয়ে উঠতে পারেনি। আমার আরো মনে হয়, শিল্পীরা যতই দরদ দিয়ে গান না কেন গানগুলো, মাকে ঘিরে সন্তানের মনের আর্তি খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে তাতে। মাকে নিয়ে আমার অন্তহীন হৃদয়ানুভূতির কারণেই আমার কাছে এমনটা মনে হচ্ছে। জানি না আর সবার অনুভূতি এমন হয় কি না।

রাস্তায়-বাসে বা অন্য কোথাও আমার মা-বাবার বয়সি কোনো বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধাকে দেখলে আমার মা-বাবার মুখ দুটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে হয়, কেন বেঁচে থাকল না আমার মা-বাবা? আর যদি এই বয়সের কাউকে অন্যের কাছে হাত পাততে দেখি, কিংবা অন্য কোনোভাবে কষ্ট পেতে দেখি, তা হলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। তাদের এমন অবস্থা মেনে নিতে পারি না। তাদের সন্তান আছে কি না, থাকলে কোথায় কী অবস্থায় আছে—এসব প্রশ্নের উত্তরের তোয়াক্কা না করেই সেই সন্তানদের প্রতি আমার মনটা বিষিয়ে উঠে। তখন মনটা প্রচণ্ড রকম বিদ্রোহী হয়ে ওঠে । অথচ আমরা পাঁচ ভাইবোনের সবাই কিন্তু সমানভাবে আমার মা-বাবার দেখভাল করতে পারিনি, কারণ আমরা ছোট ছিলাম। তারপরও দেখতাম মা সবসময় উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। এই হচ্ছে মায়ের মন! সন্তানকে কখনো এপিঠ-ওপিঠ করে দেখতে পারেন না।

টিভিতে যখন বৃদ্ধ নিবাস দেখায়, তখন মনটা দুঃখ-ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। আহার-নিদ্রা, ভরণপোষণ, সেবাযত্ন—কোন দিক দিয়েই তারা বৃদ্ধ নিবাসে অবহেলিত নন। তা সত্ত্বেও বাইরের এই চাকচিক্যকে ভেদ করে আমি তাদের বুকের শূন্যতা হাতড়াতে গিয়ে মন বিমর্ষ ও ভারাক্রান্ত হয়ে যায়, অজান্তেই চোখ ভিজে যায়। আমার কেবলই মনে হয়, যত আদর-যত্নেই থাকুক না কেন নিজের সন্তান, নাতি-নাতনি কিংবা অন্যান্য আপনজনের সান্নিধ্যে পারিবারিক আবহে যে মানসিক সুখ তারা পেতেন, তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। বৃদ্ধ মানেই শিশু। তাই নাতি-নাতনিদের সান্নিধ্যে বৃদ্ধ মানুষদের সময় কাটে নিবিড় আনন্দ মুখরতায়। অথচ এই সুখ থেকে বঞ্চিত বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দারা। এখানে তাদের যত সুখ-সুবিধাই দেওয়া হোক না কেন একটা পারিবারিক জীবনের হাহাকার তাদের সব সময় তাড়া করে বেড়ায়। যে পরিবারকে বুকের স্বপ্ন-সাধ-ভালবাসা দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তারা, সেই পরিবারের কর্তা-কর্ত্রী ও সিদ্ধান্তদাতা ছিলেন তারাই। এখন সেই পরিবারটা হয়ে গেছে তাদের কাছে দূর অতীতের স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের করিডোরে আবারও নিজেকে দেখার জন্য তাদের মনে যে হাহাকার, আমার মনে হয় তাদের বুকে কান পাতলে সেই হাহাকার ধ্বনি বাইরে থেকে শোনা যাবে। তাদের বুকের এই কষ্ট যাদের উপলব্ধি করার কথা, তাদের সেই সন্তানরা কেউ হয়তো স্ত্রী-পরিজন নিয়ে বিলাসী জীবনযাপন করছে, কেউ হয়তো জীবনসিঁড়ির উচ্চ সোপানটাতে অধিষ্ঠিত হয়ে ভুলে গেছে বাবা-মায়ের প্রতি নিজের দায়িত্ব পালনের কথা। ভুলে গেছে, বাবা-মায়ের প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসা, শুভকামনা ও অনেক ত্যাগ না থাকলে তার পক্ষে এই সোপানটাতে পৌঁছানো কোনোদিনই সম্ভব হতো না। তারা মনে করতে চায় না, বুড়ো বয়সের অসহায়ত্বের কাছে নিজকে সঁপে দেওয়ার সময়টায় সন্তানের সান্নিধ্য একজন মানুষের কত প্রয়োজন! যদি একবারের জন্যও এই উপলব্ধিটা তাদের মনে আসত, তা হলে হয়তো কোনো সন্তানই তার বাবা-মাকে বৃদ্ধ নিবাসে রেখে সুখে জীবনযাপন করতে পারত না।

লেখাটা শুরু করেছিলাম আমার মায়ের প্রসঙ্গ দিয়ে। আসলে নিজের মা-বাবার জন্য গভীর মমত্ববোধ ও ভালোবাসা না থাকলে অন্যের মা-বাবার কষ্ট উপলব্ধি করা যায় না। যাদের ভেতর এই অনুভূতি নেই, তারা মা-বাবার স্নেহমধুর সান্নিধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়। আমি মনে করি, পৃথিবীতে চরম হতভাগা মানুষ তারা। মা-হীন পৃথিবীতে আমি যখন মায়ের স্নেহমাখা কোলের খোঁজে প্রায় দিশাহারা, তখন মনে হয় আমি অন্তত পেরেছিলাম আমার মায়ের নিবিড় স্নেহের সান্নিধ্যে নিজকে আবিষ্কার করতে। তা না হলে মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার জন্য এখনো কেন আমার মনটা এতটা বুভুক্ষু! মা একদিন হয়ে যাবে শুধুই স্মৃতি—এ কথাটা কখনোই ভাবে না কোনো সন্তান। আমার ভাবনার সীমাবদ্ধ প্রাচীর ডিঙিয়ে সেই কঠিন বাস্তবটাই আজ আমার জীবনে সত্যি হয়ে আছে।

আমার মা নেই। চলে গেছেন পরপারে আমাদের সব মায়ার বন্ধন কাটিয়ে। আমার মা এখন শুধুই স্মৃতি, স্মৃতির হীরা-চুনি-পান্না। আমার কাছে এখন মা মানে হৃদয়ের গভীর আকুলতা নিয়ে স্মৃতির জাবরকাটা। এটা যেমন সত্য, তেমনি আরেকটা সত্য হলো, মা-হীন পৃথিবীতে আমরা ঠিকই হেসেখেলে বেঁচে আছি। এটাকে ওই সত্যের উল্টোপিঠও বলা যেতে পারে। বললাম এ কারণে যে, আমি এই সত্যটা উপলব্ধি করেছি আগের সত্যটার পথ বেয়ে।

জানি না কেন এমন হয়! আমার অবসরের বেশিরভাগ মুহূর্তগুলো আজও মাকে ঘিরে মুখর হয়ে থাকে। বিশেষ করে মায়ের অসুস্থ থাকার সময়ের স্মৃতিগুলো আমাকে বড় বেশি আপ্লুত করে রাখে। একেবারে অবুঝ শিশুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন আমার মা। নানারকম বায়না করতেন আমার কাছে। মায়ের সেই কথাগুলো আজও আমার কানে বাজে। একবার মাঘ মাসের পূর্ণিমা রাতে বায়না ধরলেন উঠোনে বসে চাঁদ দেখবেন। গ্রামে এই সময়টায় শীত রীতিমতো জাঁকিয়ে বসে, বিশেষ করে রাতের বেলা। কিন্তু মায়ের ইচ্ছা বলে কথা! হাতে-পায়ে মোজা পরিয়ে, সোয়েটার-শাল গায়ে জড়িয়ে, কম্বল দিয়ে হুইলচেয়ারসহ ঢেকে আম্মাকে নিয়ে বসালাম উঠোনে। পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় তখন ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। হুইলচেয়ারে বসে আম্মা কিছুক্ষণ চাঁদের দিকে চেয়ে থাকলেন। এভাবে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে বসে ঘণ্টা খানেক ধরে চাঁদ দেখলেন আম্মা। তারপর আম্মাকে অনেকটা জোর করে ঘরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলাম।

আমি জানি না, আমার মা সেদিন চাঁদের মধ্যে কী খুঁজে পেয়েছিলেন? হয়তো কিছুই খুঁজে পাননি। মায়ের একটা অবিনশ্বর স্মৃতি আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য হয়তো বিধাতাই ইচ্ছা করে এমনটি ঘটিয়েছিলেন। তাই আজ আমি প্রতি পূর্ণিমার রাতে আকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে মায়ের মুখটি খুঁজে পাই। ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি আমি। ঝলঝলে পূর্ণিমার চাঁদটা আমার চোখের সামনে হয়ে যায় মায়ের উদ্ভাসিত মুখ। আমি হাত বাড়াই মায়ের মুখটি একবার ছুঁয়ে দেখার লোভে। কিন্তু বারান্দায় গ্রিলে আটকে যায় আমার হাত। তবুও কঠিন বাস্তব আমাকে তার কাছে টানতে পারে না। আমি আবারও ধ্যানমগ্ন হই। মায়ের সেদিনকার কথাগুলো কানে বাজে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলি, কোথায় হারিয়ে গেলে মা তুমি আমাকে একা ফেলে? ওই চাঁদের বুকে মুখ লুকালে বুঝি? সেজন্যই এত উজ্জ্বল ওই চাঁদ।

আমি টের পাই আমার বুকের কান্নাগুলো বৃষ্টির ধারা হয়ে নেমে আসছে দুগাল বেয়ে। আমি অনেকক্ষণ ধরে কাঁদি আর মনে মনে মাকে ডাকি। একসময় হালকা হয় বুকটা। কিন্তু আমি জানি মায়ের জন্য আমার এই দীর্ঘশ্বাস থামার নয়। আকাশে চাঁদ উঠবে চিরকাল; চিরকাল পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় ভাসবে রাত, সাজবে নব সাজে। আমি সেই রাতের বুকে আমার মায়ের অস্তিত্ব খুঁজে পাব চাঁদের হাসিতে। চাঁদ হাসবে, সঙ্গে সঙ্গে আমার মায়ের হাসিমাখা মুখটি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠবে। আমার মা আমার কাছে স্মৃতি হয়ে গেছে। তবে এমন ঝলঝলে আলোবিধৌত শাশ্বত স্মৃতি কটি হতে পারে! তাই তো স্মৃতি হয়ে গিয়েও আমার মা আমার চারপাশে জীবন্ত।

মাঝে মাঝে অদম্য হয়ে ওঠে আমার মনটা। মনে প্রশ্ন জাগে, আমার মাকে এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে উঠিয়ে না নিলে কি চলত না? কোনো উত্তর পাই না এই প্রশ্নের। নিজে নিজে সান্ত্বনা খুঁজি—অনেকের মা তো আরো আগে মারা যায়। তারা কি করে তখন? বিধাতার বিচার হচ্ছে সর্বোচ্চ ও সর্বশেষ বিচার। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন চলে না।

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সব জীবিত মাকে সুস্থ রাখুন এবং যারা পরলোকে চলে গেছেন তাদের সবাইকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উঁচু জায়গায় স্থান করে দিন। আল্লাহ তায়ালা সুরা বনি ইসরাইলের ২৪নং আয়াতে এরশাদ করেছেন, ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা’; অর্থাৎ, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার বাবা-মায়ের প্রতি দয়া করো, যেমন তারা দয়ামায়া, মমতাসহ আমাকে শৈশবে প্রতিপালন করেছিলেন।’ বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, যখন কোনো অনুগত সন্তান নিজের মা-বাবার দিকে অনুগ্রহের নজরে দেখে, মহান আল্লাহ তার প্রতিটি দৃষ্টির বিনিময়ে একটি করে কবুল হজের সাওয়াব দান করেন (বায়হাকি মিশকাত, পৃষ্ঠা-৪২১)।

বিষয়:

মা
এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত