
গোলাপ মুনীর

বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন, চিন্তাবিদ, ভিন্ন ধাঁচের বহুমাত্রিক লেখক, কলাম লেখক ও অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ ও আমার বয়সের পার্থক্য ২৩ বছরের। বলতে গেলে, আমার বেড়ে ওঠার আগেই তিনি ভিন্ন মাত্রার প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক। আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জাতীয় বিষয় নিয়ে তার লেখা দেখতে পেতাম।
অনেক বিতর্কিত বিষয়ে তার লেখায় থাকত তথ্যনির্ভর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এর মাধ্যমে তিনি যেসব যুক্তি তুলে ধরতেন তা খণ্ডানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজৈবনিক রচনা সম্পর্কে তার মন্তব্যটি—“শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মনে হয়েছে একটি বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতে ধরা পড়েছে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। এখন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকা বাম বুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনটাই ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত।
কিন্তু শেখ মুজিব তার জীবনীতে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তিনি তার আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, শেখ মুজিব ছিলেন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু শেখ মুজিব তার জীবনীতে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি।’ অর্থাৎ শেখ মুজিবের মধ্যে ছিল একটি মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ, যেমনি ছিল বাঙালিত্ব।”
তার লেখালেখিতে তিনি যেসব নিজস্ব ধ্যান-ধারণা তুলে ধরতেন, তা পাঠকদের মনে দাগ কাটত। প্রকাশ পেত তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কলেজজীবনে পড়ার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম-সম্পর্কিত বহুবিতর্কিত একটি বিষয় নিয়ে তার একটি ইতিহাসাশ্রয়ী জ্ঞানগর্ভ লেখা একটি জাতীয় দৈনিকে পড়ার সময় তার লেখালেখির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। প্রায় পুরো পৃষ্ঠাব্যাপী এ লেখাটি পড়ে তার নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানের গভীরতা আঁচ করতে পারি।
পরে পত্রপত্রিকায় সুযোগ পেলেই তার লেখা পড়তাম। তবে তার লেখা পড়া ও তার সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিল অনেকটা সীমিত মাত্রার। তখন তিনি কে, কী করতেন—তাও আমার জানা ছিল না। কিন্তু এ কথা মনে গেঁথে গেল, তিনি নিশ্চিত এক বিদগ্ধজন। তার লেখার ধার আছে। তার লালিত বিশ্বাস তিনি তার লেখার মাধ্যমে কোনো রাখঢাক না করেই সরাসরি প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। তার বিশ্বাসতাড়িত ধ্যান-ধারণা আমাদের অনেকের ধ্যান-ধারণা ও প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলেও তা প্রকাশের সাহস তিনি রাখেন। সেজন্যই তার অনেক পরিচয়ের মাঝে তার একটি পরিচয় হচ্ছে—তিনি ভিন্ন মাত্রার এক লেখক।
পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনের একটি পর্যায়ে এসে আমি যখন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন তার সম্পর্কে আমার জানাশোনার জগৎ কিছুটা প্রসারিত হয়। কারণ তখন তিনি এ পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করেন। নয়া দিগন্তে আমার কর্মজীবন সময়ে তিনি সেখানে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। আর সম্পাদকীয় বিভাগের কলামগুলো সম্পাদনার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব আমার ওপর পড়ায় অন্যান্য কলাম লেখকদের কলামসহ এবনে গোলাম সামাদের কলামগুলোও আমাকে সম্পাদনা করতে হতো। তার কলামগুলো সম্পাদনার তেমন কিছু থাকত না। তার পরেও এগুলো পড়ে দেখতে হতো খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কারণ তার লেখার বিষয়বস্তু হজম করতে গিয়ে আমরা আবার কোনো ধরনের বিপদে পড়ি কি না।
কেননা তার লেখায় মাঝেমধ্যেই এমন কিছু নিজস্ব অভিমত থাকত, যা প্রকাশ করা হলে একশ্রেণির লোক অহেতুক নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে পারে। এমনি অবস্থায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার এই অভিমত লঘু আকারে প্রকাশ করতে হতো, যাতে কারো পক্ষে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি তার বিশ্বাস থেকে যেসব অভিমত তুলে ধরতেন, তা পাল্টাতে অর্থাৎ নমনীয় আকারে নামিয়ে আনতে চাইতেন না। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই উষ্মা প্রকাশ করতেন। এর ফলে তিনি থেকে থেকেই কলাম লেখা বন্ধ করে দিতেন। আবার অনেক অনুরোধ করে তাকে কলাম লেখায় ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।
নয়া দিগন্তে কাজ করার সময় জানলাম, প্রবীণ এই ব্যক্তিত্ব রাজশাহীতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ। নিজ হাতে লিখতেও পারেন না। তাকে লেখালেখিতে সহায়তা করেন অন্য একজন। তিনি বলে যান, আর অন্য আরেকজন তা লেখেন। এভাবেই চলে তার লেখালেখি। নয়া দিগন্তে কলাম লেখার কাজটি চলে একইভাবে। সম্ভবত বছর দশেক আগে তিনি একবার যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন নয়া দিগন্ত অফিসে আসেন। তখনই তাকে আমার প্রথম ও শেষ দেখার সুযোগ হয়েছিল। তখন তিনি নয়া দিগন্ত সম্পাদকীয় বিভাগের সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ কতক্ষণ কাটিয়েছিলেন। তখনো তার কথাবার্তায় তার আপসহীনতার মাত্রা অনুধাবন করেছি। সঙ্গে ছিল আমাদের প্রতি তার অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। সেখানে আমরা সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। শুধু শুনে যাচ্ছিলাম তার কথা। কথায় প্রকাশ পাচ্ছিল তীব্র জ্বালা। সেদিন উপলব্ধি করতে পারি, তার মতো আপসহীন ও নির্মোহ ব্যক্তির পক্ষেই এভাবে কথা বলা সম্ভব। নির্মোহ অবস্থান নিয়ে চলা তারই সাজে।
তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পেশায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী হলেও ইতিহাস, শিল্পকলা, সংস্কৃতিসহ অনেক বিষয়েই তিনি ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। এসব বিষয়ে তার পড়াশোনা ও জ্ঞানের গভীরতাও ছিল ঈর্ষণীয় মাত্রার। তাই এসব বিষয়ে লিখতে পেরেছেন বেশ কিছু বই, যেগুলো মননশীল বক্তব্যে ঋদ্ধ। একই কথা খাটে তার লেখা কলামগুলোর ব্যাপারে। তার বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে লালন করেই তিনি বক্তব্যগুলো উপস্থাপন করেন লেখালেখিতে। এ বক্তব্য কার বিরুদ্ধে গেল, কে খুশি হলেন, কিংবা অখুশি হলেন সে চিন্তা তার কাছে ছিল না। তার কলামগুলো যারা পড়েছেন, তারা হয়তো লক্ষ করেছেন, তিনি কখনো কখনো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কলম চালিয়েছেন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে অনেকের সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন তথ্য-উপাত্ত হাজির করে। তার অনেক লেখায় আছে, তাদের ওপর কড়া সমালোচনা, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভুলে বিদেশি ও বিধর্মী সংস্কৃতি পূজায় মত্ত।
তিনি বারবার কলম ধরেছেন পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে বিদেশি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধবাদীরা যুক্তি খণ্ডনের তেমন সুযোগ পর্যন্ত পেত না। তার বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বরাবর আপসহীন। কারণ তিনি কথা বলেন তার যৌক্তিক বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে, কারো মাধ্যমে প্রভাবিত বা তাড়িত হয়ে নয়। বরং তার যাবতীয় উচ্চারণ তার নিজস্ব বিশ্বাস এবং তথ্যনির্ভর ও জ্ঞানতাড়িত। সেজন্য যা বলেন এবং যা লেখেন, তা বুকে হাত দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন। এ পর্যায়ে যারা উঠতে পারেন, তারাই কেবল পারেন জীবনের সব কর্মে আত্মবিশ্বাসী থাকতে। এবনে গোলাম সামাদকে আমরা পাই তেমনি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে।
তিনি নয়া দিগন্ত ছাড়াও অসংখ্য কলাম লিখেছেন আরো বেশ কটি জাতীয় দৈনিকে। দীর্ঘদিন নিয়মিত কলাম লিখেছেন নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও ইনকিলাবে। এসব কলামে ছিল তার মুক্তচিন্তার ছাপ। ইতিহাস সচেতনতা তার লেখার আরেক বৈশিষ্ট্য। তার কোনো লেখায়ই কোনো রাজনৈতিক দলবিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বিন্দুমাত্র গন্ধ পাওয়া যেত না। তার লেখায় যখন যে রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করা দরকার, তা তিনি করেছেন নির্দ্বিধায়, খোলা কলমে। দলনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার কলামগুলোর অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। তাই দলকানা অনেক কলামিস্টও অনেক সময় তার আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
সে যা-ই হোক, আগেই জানিয়েছি, তিনি এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে যেমন আছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভিত্তিক বই, তেমনি আছে সিলেবাসের বাইরের বিষয়েরও কিছু বই। তার লেখা বইগুলোর কয়েকটি হচ্ছে—‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’, ‘আত্মপক্ষ’, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’, ‘বাংলাদেশ: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’, ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’, ‘নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ’, ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট’, ‘ইসলামি শিল্পকলা’, ‘শিল্পকলার ইতিকথা’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’, ‘বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ’, ‘বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য’ প্রভৃতি।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আল্লাহর মেহমান হয়ে। তিনি জীবিত থাকলে আমরা আরো কিছু বই উপহার পেতে পারতাম। কারণ পরিণত বয়সেও তিনি লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন। রেখে গেছেন সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের সংগ্রহে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা মূল্যবান উপাদান। তার রুহের মাগফিরাত প্রার্থনা করছি মহান আল্লাহর কাছে।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিদ্বজ্জন, চিন্তাবিদ, ভিন্ন ধাঁচের বহুমাত্রিক লেখক, কলাম লেখক ও অধ্যাপক এবনে গোলাম সামাদ ও আমার বয়সের পার্থক্য ২৩ বছরের। বলতে গেলে, আমার বেড়ে ওঠার আগেই তিনি ভিন্ন মাত্রার প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক। আমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জাতীয় বিষয় নিয়ে তার লেখা দেখতে পেতাম।
অনেক বিতর্কিত বিষয়ে তার লেখায় থাকত তথ্যনির্ভর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। এর মাধ্যমে তিনি যেসব যুক্তি তুলে ধরতেন তা খণ্ডানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব হতো না। একটি উদাহরণ নেওয়া যাক। যেমন শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজৈবনিক রচনা সম্পর্কে তার মন্তব্যটি—“শেখ মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মনে হয়েছে একটি বহুগুণে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। এতে ধরা পড়েছে শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দর্শন। এখন আওয়ামী লীগে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে থাকা বাম বুদ্ধিজীবীরা প্রমাণ করতে চাচ্ছেন যে, পাকিস্তান আন্দোলনটাই ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত।
কিন্তু শেখ মুজিব তার জীবনীতে বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তিনি তার আত্মজীবনীর এক জায়গায় বলেছেন, ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লীগ আর ছাত্রলীগ পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। আওয়ামী লীগের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, শেখ মুজিব ছিলেন খাঁটি বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু শেখ মুজিব তার জীবনীতে বলেছেন, ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হলো আমরা মুসলমান, আরেকটা হলো আমরা বাঙালি।’ অর্থাৎ শেখ মুজিবের মধ্যে ছিল একটি মুসলিম স্বাতন্ত্র্যবোধ, যেমনি ছিল বাঙালিত্ব।”
তার লেখালেখিতে তিনি যেসব নিজস্ব ধ্যান-ধারণা তুলে ধরতেন, তা পাঠকদের মনে দাগ কাটত। প্রকাশ পেত তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। কলেজজীবনে পড়ার সময় পার্বত্য চট্টগ্রাম-সম্পর্কিত বহুবিতর্কিত একটি বিষয় নিয়ে তার একটি ইতিহাসাশ্রয়ী জ্ঞানগর্ভ লেখা একটি জাতীয় দৈনিকে পড়ার সময় তার লেখালেখির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। প্রায় পুরো পৃষ্ঠাব্যাপী এ লেখাটি পড়ে তার নৃতাত্ত্বিক জ্ঞানের গভীরতা আঁচ করতে পারি।
পরে পত্রপত্রিকায় সুযোগ পেলেই তার লেখা পড়তাম। তবে তার লেখা পড়া ও তার সম্পর্কে আমার জানাশোনা ছিল অনেকটা সীমিত মাত্রার। তখন তিনি কে, কী করতেন—তাও আমার জানা ছিল না। কিন্তু এ কথা মনে গেঁথে গেল, তিনি নিশ্চিত এক বিদগ্ধজন। তার লেখার ধার আছে। তার লালিত বিশ্বাস তিনি তার লেখার মাধ্যমে কোনো রাখঢাক না করেই সরাসরি প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। তার বিশ্বাসতাড়িত ধ্যান-ধারণা আমাদের অনেকের ধ্যান-ধারণা ও প্রচলিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে গেলেও তা প্রকাশের সাহস তিনি রাখেন। সেজন্যই তার অনেক পরিচয়ের মাঝে তার একটি পরিচয় হচ্ছে—তিনি ভিন্ন মাত্রার এক লেখক।
পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনের একটি পর্যায়ে এসে আমি যখন দৈনিক নয়া দিগন্ত পত্রিকায় সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরু করি, তখন তার সম্পর্কে আমার জানাশোনার জগৎ কিছুটা প্রসারিত হয়। কারণ তখন তিনি এ পত্রিকায় কলাম লেখা শুরু করেন। নয়া দিগন্তে আমার কর্মজীবন সময়ে তিনি সেখানে নিয়মিত কলাম লিখেছেন। আর সম্পাদকীয় বিভাগের কলামগুলো সম্পাদনার প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্ব আমার ওপর পড়ায় অন্যান্য কলাম লেখকদের কলামসহ এবনে গোলাম সামাদের কলামগুলোও আমাকে সম্পাদনা করতে হতো। তার কলামগুলো সম্পাদনার তেমন কিছু থাকত না। তার পরেও এগুলো পড়ে দেখতে হতো খুবই সতর্কতার সঙ্গে। কারণ তার লেখার বিষয়বস্তু হজম করতে গিয়ে আমরা আবার কোনো ধরনের বিপদে পড়ি কি না।
কেননা তার লেখায় মাঝেমধ্যেই এমন কিছু নিজস্ব অভিমত থাকত, যা প্রকাশ করা হলে একশ্রেণির লোক অহেতুক নানা ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে পারে। এমনি অবস্থায় তার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার এই অভিমত লঘু আকারে প্রকাশ করতে হতো, যাতে কারো পক্ষে এ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির সুযোগ না থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি তার বিশ্বাস থেকে যেসব অভিমত তুলে ধরতেন, তা পাল্টাতে অর্থাৎ নমনীয় আকারে নামিয়ে আনতে চাইতেন না। এসব বিষয় নিয়ে আমাদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই উষ্মা প্রকাশ করতেন। এর ফলে তিনি থেকে থেকেই কলাম লেখা বন্ধ করে দিতেন। আবার অনেক অনুরোধ করে তাকে কলাম লেখায় ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।
নয়া দিগন্তে কাজ করার সময় জানলাম, প্রবীণ এই ব্যক্তিত্ব রাজশাহীতে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। বয়সের ভারে অনেকটা ন্যুব্জ। নিজ হাতে লিখতেও পারেন না। তাকে লেখালেখিতে সহায়তা করেন অন্য একজন। তিনি বলে যান, আর অন্য আরেকজন তা লেখেন। এভাবেই চলে তার লেখালেখি। নয়া দিগন্তে কলাম লেখার কাজটি চলে একইভাবে। সম্ভবত বছর দশেক আগে তিনি একবার যখন ঢাকায় এসেছিলেন তখন নয়া দিগন্ত অফিসে আসেন। তখনই তাকে আমার প্রথম ও শেষ দেখার সুযোগ হয়েছিল। তখন তিনি নয়া দিগন্ত সম্পাদকীয় বিভাগের সাংবাদিকদের সঙ্গে বেশ কতক্ষণ কাটিয়েছিলেন। তখনো তার কথাবার্তায় তার আপসহীনতার মাত্রা অনুধাবন করেছি। সঙ্গে ছিল আমাদের প্রতি তার অভিমানের বহিঃপ্রকাশ। সেখানে আমরা সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। শুধু শুনে যাচ্ছিলাম তার কথা। কথায় প্রকাশ পাচ্ছিল তীব্র জ্বালা। সেদিন উপলব্ধি করতে পারি, তার মতো আপসহীন ও নির্মোহ ব্যক্তির পক্ষেই এভাবে কথা বলা সম্ভব। নির্মোহ অবস্থান নিয়ে চলা তারই সাজে।
তিনি ছিলেন রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক। পেশায় উদ্ভিদবিজ্ঞানী হলেও ইতিহাস, শিল্পকলা, সংস্কৃতিসহ অনেক বিষয়েই তিনি ছিলেন বিশেষ আগ্রহী। এসব বিষয়ে তার পড়াশোনা ও জ্ঞানের গভীরতাও ছিল ঈর্ষণীয় মাত্রার। তাই এসব বিষয়ে লিখতে পেরেছেন বেশ কিছু বই, যেগুলো মননশীল বক্তব্যে ঋদ্ধ। একই কথা খাটে তার লেখা কলামগুলোর ব্যাপারে। তার বিশ্বাসকে দৃঢ়ভাবে লালন করেই তিনি বক্তব্যগুলো উপস্থাপন করেন লেখালেখিতে। এ বক্তব্য কার বিরুদ্ধে গেল, কে খুশি হলেন, কিংবা অখুশি হলেন সে চিন্তা তার কাছে ছিল না। তার কলামগুলো যারা পড়েছেন, তারা হয়তো লক্ষ করেছেন, তিনি কখনো কখনো অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির বিরুদ্ধেও কলম চালিয়েছেন। প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বাইরে গিয়ে অনেকের সম্পর্কে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন তথ্য-উপাত্ত হাজির করে। তার অনেক লেখায় আছে, তাদের ওপর কড়া সমালোচনা, যারা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ভুলে বিদেশি ও বিধর্মী সংস্কৃতি পূজায় মত্ত।
তিনি বারবার কলম ধরেছেন পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনে বিদেশি ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে তার বিরুদ্ধবাদীরা যুক্তি খণ্ডনের তেমন সুযোগ পর্যন্ত পেত না। তার বক্তব্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন বরাবর আপসহীন। কারণ তিনি কথা বলেন তার যৌক্তিক বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে, কারো মাধ্যমে প্রভাবিত বা তাড়িত হয়ে নয়। বরং তার যাবতীয় উচ্চারণ তার নিজস্ব বিশ্বাস এবং তথ্যনির্ভর ও জ্ঞানতাড়িত। সেজন্য যা বলেন এবং যা লেখেন, তা বুকে হাত দিয়ে প্রকাশ করতে পারেন। এ পর্যায়ে যারা উঠতে পারেন, তারাই কেবল পারেন জীবনের সব কর্মে আত্মবিশ্বাসী থাকতে। এবনে গোলাম সামাদকে আমরা পাই তেমনি একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ হিসেবে।
তিনি নয়া দিগন্ত ছাড়াও অসংখ্য কলাম লিখেছেন আরো বেশ কটি জাতীয় দৈনিকে। দীর্ঘদিন নিয়মিত কলাম লিখেছেন নয়া দিগন্ত, আমার দেশ ও ইনকিলাবে। এসব কলামে ছিল তার মুক্তচিন্তার ছাপ। ইতিহাস সচেতনতা তার লেখার আরেক বৈশিষ্ট্য। তার কোনো লেখায়ই কোনো রাজনৈতিক দলবিশেষের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের বিন্দুমাত্র গন্ধ পাওয়া যেত না। তার লেখায় যখন যে রাজনৈতিক দলের সমালোচনা করা দরকার, তা তিনি করেছেন নির্দ্বিধায়, খোলা কলমে। দলনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার কলামগুলোর অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। তাই দলকানা অনেক কলামিস্টও অনেক সময় তার আক্রমণের শিকার হয়েছেন।
সে যা-ই হোক, আগেই জানিয়েছি, তিনি এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। এগুলোর মধ্যে যেমন আছে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসভিত্তিক বই, তেমনি আছে সিলেবাসের বাইরের বিষয়েরও কিছু বই। তার লেখা বইগুলোর কয়েকটি হচ্ছে—‘বাংলাদেশের আদিবাসী এবং জাতি ও উপজাতি’, ‘আত্মপক্ষ’, ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’, ‘বাংলাদেশ: সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া’, ‘মানুষ ও তার শিল্পকলা’, ‘নৃতত্ত্বের প্রথম পাঠ’, ‘বায়ান্ন থেকে একাত্তর’, ‘আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনা এবং আরাকান সংকট’, ‘ইসলামি শিল্পকলা’, ‘শিল্পকলার ইতিকথা’, ‘বাংলাদেশে ইসলাম’, ‘বর্তমান বিশ্ব ও মার্কসবাদ’, ‘বাংলাদেশের মানুষ ও ঐতিহ্য’ প্রভৃতি।
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন আল্লাহর মেহমান হয়ে। তিনি জীবিত থাকলে আমরা আরো কিছু বই উপহার পেতে পারতাম। কারণ পরিণত বয়সেও তিনি লেখালেখি অব্যাহত রেখেছিলেন। রেখে গেছেন সাহসিকতার সঙ্গে আমাদের সংগ্রহে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা মূল্যবান উপাদান। তার রুহের মাগফিরাত প্রার্থনা করছি মহান আল্লাহর কাছে।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে ধানীখোলা গ্রামে ০৩ নভেম্বর ১৮৯৭ এক সম্ভান্ত জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৭ সালে এন্ট্রান্স ও ঢাকা কলেজ থেকে ১৯১৯ সালে এফএ পাস করে কলকাতা রিপন কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন।
৪ দিন আগে
প্রখ্যাত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইন্তেকালে দেশ ও জাতি একজন কৃতীসন্তান এবং জ্ঞানতাপসকেই হারালো; আমরা হারালাম একজন পরম শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী, গুণী, অভিভাবক এবং অমায়িক ও স্নেহশীল ব্যক্তিত্বকে।
৫ দিন আগে
জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের প্রবীণতম দার্শনিক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির পর স্বভাবতই সর্বভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের মধ্যেও বিভক্তির সৃষ্টি হয়।
৫ দিন আগেবিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে পরিচিত শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থপতি শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ২০০৬ সালে এ সম্মাননা চালু হয়।
৭ দিন আগে