
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ

প্রখ্যাত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইন্তেকালে দেশ ও জাতি একজন কৃতীসন্তান এবং জ্ঞানতাপসকেই হারালো; আমরা হারালাম একজন পরম শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী, গুণী, অভিভাবক এবং অমায়িক ও স্নেহশীল ব্যক্তিত্বকে। চুরানব্বই বছর বয়সে, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এই রৌদ্র-ছায়াময় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবনের ও জ্ঞানসাধনার ইতিহাস, শিক্ষা বিস্তারে ও জ্ঞানচর্চায় এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান, আর চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্যের অম্লান পরিচয়, উদার ও স্নেহশীল হৃদয়ের স্বাক্ষর।
সুপুরুষ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী; অথচ অমায়িক ও হাস্যোজ্জ্বল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের অন্তরের উদারতা আর সৌন্দর্যও ছিল হৃদয়ে দাগ কাটার মত। জমিদার-নন্দন আর অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, কোনোরূপ অহমিকা বা উচ্চম্মন্যতা তাঁর আচরণে ছিল না। শ্রদ্ধেয় মরহুম আজরফের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ যাদের হয়েছে তাঁরা জানেন, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক এবং জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মতত্ত্ব, সমাজ ও অর্থনীতি এবং আরও বহুবিধ বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও অগাধ পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি, তাঁর ঔদার্য আর হৃদয়ের স্নেহবত্তাও ছিল অসাধারণ। তিনি পেশা ও শ্রেণী নির্বিশেষে নবীন, প্রবীণ সব মানুষকেই অত্যন্ত আপন করে নিতেন, স্নেহ ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। ধর্মীয় বা আদর্শগত মতপার্থক্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহা আদর্শের ভিন্নতা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াত না।
সিলেটের সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের সন্তান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান আজরফ (উল্লেখ্য, তিনি নামের শেষে 'চৌধুরী' পদবি লেখা বর্জন করেছিলেন এবং তাঁর বহু রচনায় 'দেওয়ান' অভিধাও ব্যবহার করেননি)। আজীবন জ্ঞানচর্চা করলেও, তিনি কোনো 'আইভরি টাওয়ার' বা 'গজদন্ত মিনার'-এর বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁর দীর্ঘ ও কর্মময় জীবনে তিনি জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি কর্মসাধনায়ও আত্মনিয়োগ করেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়ভার এবং দায়িত্বও গ্রহণ করেন। শিক্ষা বিস্তারে এবং জ্ঞানচর্চায় ও দার্শনিক অনুধ্যানে নিবেদিতপ্রাণ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাধারণ মানুষের সঙ্গেও একাত্ম হয়েছেন, কামনা করেছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, জনগণের দারিদ্রদ্র্য মোচন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। জমিদার নন্দন হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা এবং চিন্তাচেতনার বিরোধী, ইসলামের সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় আকাঙ্ক্ষী। দার্শনিক আজরফ তাঁর বহু রচনায় তাঁর জীবনবোধ, জীবন-চেতনা এবং মানবতাবাদী আদর্শের কথা নানা তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিধৃত করেছেন। অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিজীবনের আচার-আচরণে ও কর্মতৎপরতায় যেমন জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা প্রকাশিত, তেমনি তাঁর অনেক রচনায় বিশেষত সৃষ্টিশীল রচনায় দারিদ্রদ্র্যপীড়িত ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্যও বিধৃত। একাধারে দার্শনিক, পণ্ডিত ও সৃষ্টিশীল লেখক এবং বরেণ্য মরমি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক ও জমিদার হাসন রাজার দৌহিত্র মোহাম্মদ আজরফ সমাজ আর সাধারণ মানুষের জীবন অধ্যয়নেও যে ব্রতী ছিলেন, তাঁর কোনো কোনো ছোট গল্পে ও উপন্যাসে রয়েছে তাঁর পরিচয়। উল্লেখ্য হাসন রাজার পুত্র এবং মোহাম্মদ আজরফের মামা দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীও ছিলেন সেকালের বিশিষ্ট কবি।
সদ্য পরলোকগত শ্রদ্ধেয় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দার্শনিক চিন্তা-চেতনা, অনুধ্যান, জ্ঞানচর্চা আর সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সে সবের মূল্যায়ন এ রচনার উদ্দিষ্ট বা লক্ষ্য নয় এবং তা আমার সাধ্যাতীতও নয় বটে। তবুও মরহুমের রচনার দীর্ঘদিনের অনুরাগী পাঠক ও তাঁর স্নেহধন্য একজন হিসেবে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে উল্লেখ করতেই হয় যে, মোহাম্মদ আজরফ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, বংশগত ও পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে। সেই ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, দর্শন অধ্যয়নে ও দর্শনচর্চায় ব্রতী হন, তার মূলেও কাজ করেছে পারিবারিক ও বংশগত ঐতিহ্য ও রক্তের ধারা। উল্লেখ্য, সে যুগে অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিশেষত সামন্তবাদী পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দুর চর্চাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মোহাম্মদ আজরফের পরিবারে এবং তাঁর নানা মরমি কবি হাসন রাজার পরিবারে সেকালেই সাহিত্যের চর্চা ছিল এবং বাংলা ভাষায় সৃষ্টিশীল ও চিন্তামূলক সাহিত্যও রচিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আজরফের চাচাতো ভাই মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী ব্রিটিশ আমলেই সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষার বিকাশ, বিবর্তন এবং উন্নয়ন সম্পর্কে মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাত, মাসিক আল ইসলাহ এবং অন্যান্য পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আলোচনা-সমালোচনা লেখেন। আহবাব চৌধুরী ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর এবং সুলেখক। ১৯২৭ সালেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ 'বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে'। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ছাড়াও স্বাতন্ত্র্যবাদী এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী আহবাব চৌধুরী মুসলমান সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ সম্বলিত ভাষা ব্যবহারের অধিকার সম্পর্কে লেখালেখি করেন, তাঁরই উদ্যোগে সেকালে পাঠ্যপুস্তকে ও ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতায় মুসলিম ঐতিহ্যবাহী শব্দ সম্বলিত ভাষা ব্যবহারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর আহবাব চৌধুরীর উত্থাপিত প্রস্তাব সিনেটে গৃহীত হওয়ার ফলেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতায় ও পাঠ্যপুস্তকে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের আইনগত স্বীকৃতি মেলে। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মাসিক মোহাম্মদী ও অন্যান্য পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। (দ্রষ্টব্য মাসিক মোহাম্মদী, অগ্রহায়ণ, ১৩৫০)।
উপরোক্ত ইতিহাস ও পটভূমির কথা স্মরণে রাখলে, লেখক ও দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের (একদা ১৯৪৬ সালে তিনি আসাম আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন) সাহিত্য সাধনা, দর্শন-চর্চা এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনকালে একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক হিসেবে সিলেটে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা এবং ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়টি অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যাবে। এ সত্য অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ঐ ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদান অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, শিক্ষাবিদ, ও দার্শনিক হিসেবে তাঁর ব্যাপক খ্যাতি ও স্বীকৃতির আড়ালে অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। উল্লেখ্য, শুধু তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হিসেবেই নয়, ১৯৪৮ সালেই সিলেট থেকে মাহমুদ আলী প্রকাশিত ও সম্পাদিত সপ্তাহিক 'নওবেলাল' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তীতে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শ্রদ্ধেয় আজরফ ছিলেন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'নওবেলাল'-এর প্রথম সম্পাদক এবং প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মাহমুদ আলী। 'নওবেলাল' সম্পাদনাকালে এবং পরবর্তী পর্যায়েও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে যে চাকরি জীবনেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে ও মূল্য দিতে হয়েছে সে ইতিহাস বিধৃত রয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণে (ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি) এবং অন্যান্য রচনায়। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অগ্রণী সংস্থা পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস এবং এই সংস্থার মুখপত্র 'সাপ্তাহিক সৈনিক'-এর ভূমিকা ও অবদান যে অবিস্মরণীয় তা স্বীকৃত। সাপ্তাহিক 'নওবেলাল' ভাষা আন্দোলনে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে, সে সত্যও অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, সেকালে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত এবং সামন্তবাদী চিন্তা ধোরাপ্রসূত মুসলিম পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দু চর্চা প্রাধান্য পেত, বাংলা ভাষার চর্চাকে উল্টো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হতো সেকালে পাকিস্তান সরকারের বৈরিতার মুখে এবং বাংলা বিরোধীদের দৌরাত্ম্যে বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ সহজ ব্যাপার ছিল না। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতিদানের দাবিতে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতিতে যোগদানের জন্য মোহাম্মদ আজরফকে সরকারের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও এবং ১৯৪৯ সাল থেকে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হিসেবেও ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। একজন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে শুধু শীতল পাণ্ডিত্যের চর্চা করেননি, কেবল দর্শন চিন্তায় ও তথ্য তত্ত্বের ব্যাখ্যা দানে ব্যাপৃত থাকেননি। উল্লেখ্য, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন প্রায় গোড়া থেকেই পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস ও সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সাথে সম্পৃক্ত। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ছিলেন।
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর সুদীর্ঘ, সাহিত্য জীবনে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখলেও এবং জীবনের এক পর্যায়ে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত হওয়ায়, ১৯৪৬ সালের আসাম আইন পরিষদের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মূল প্রবণতা এবং সাধনার ক্ষেত্র ইতিহাস ও দর্শন চর্চা। স্মরণযোগ্য যে, দেশ বিভাগ পূর্বকালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মুসলিম লীগ রাজনীতি ও পাকিস্তাদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আসামের মুসলিম লীগ নেতা ও লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মওলানা ভাসানীর অনুরাগী ও অনুসারী হিসেবে তৎকালে আসামে বহিরাগতদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দিয়ে শিলচরে গ্রেফতার হন এবং দশ মাসের কারাদণ্ডও ভোগ করেন। মরমি সাধক ও কবি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বরেণ্য ও অবিশ্বরণীয় ব্যক্তিত্ব ও মহৎ মানবতাবাদী হাসন রাজার ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার যে তাঁর দৌহিত্র (কন্যার পুত্র) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে এবং দার্শনিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত এবং ইসলামের সাম্যনীতি ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ মোহাম্মদ আজরফ আজীবন ইসলামের ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনা নিয়ে প্রচুর অধ্যয়ন আর লেখালেখি করলেও অন্যান্য ধর্ম এবং দর্শন সম্পর্কেও তাঁর পড়াশোনা ছিল অগাধ। উদার হৃদয়ের অধিকারী এবং মানবতাবাদী আজরফ শুধু বিভিন্ন ধর্ম-দর্শন আর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কেই ব্যাপক পড়াশোনা করেননি, তিনি বিভিন্ন ধর্ম-দর্শনের মহৎ ও কল্যাণকর এবং মানবতাবাদী দিকগুলোকে মর্যাদা ও মূল্য দিয়েছেন। শুধু তাঁর লেখায়ই নয়, বিভিন্ন সেমিনারে ও আলোচনা সভায় তাঁর ভাষণে তিনি ইসলাম ধর্মের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দিক ইসলামের ইতিহাস ও দার্শনিক তত্ত্ব, ইসলামের আদর্শ ও মানবতাবাদী শিক্ষা তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম-দর্শনের তুলনামূলক পর্যলোচনা করতেন, যুক্তি বাস্তবতার আলোকে এবং মানবকল্যাণের লক্ষ্যে সবকিছু বিচার-বিবেচনা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিতেন।
ইসলামের শিক্ষা ও মানবতাবাদী আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী হলেও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অন্যান্য ধর্ম আর দর্শনের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি শুধু শ্রদ্ধাশীলই ছিলেন না, ধর্ম বিষয়ক সভা সেমিনারে এবং ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিক-মনীষীদের স্মরণ সভায়ও আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করতেন। ধর্ম, দর্শন এবং মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য রাখতেন। অবাধ জ্ঞানচর্চা এবং সর্ব বিষয়ে অধ্যয়ন ও জানার ব্যাপারে আজীবন তাঁর আগ্রহ ছিল ঐকান্তিক। তাঁর রচিত 'ইসলাম ও মানবতাবাদ', 'দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম', 'ইসলামিক মুভমেন্ট', 'জীবন সমস্যা সমাধানে ইসলাম' ইত্যাদি গ্রন্থে ও অন্যান্য রচনায় ধর্ম দর্শন পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এবং মানবতার মুক্তি সনদ হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি তুলনামূলক পর্যালোচনাও করেছেন। তুলনামূলক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, 'প্রকৃত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মানবতাবাদেরই এক রূপ। মানব জীবনে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক রাখার জন্য এ দুনিয়ায় যে ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল তা ইসলাম এবং তা মানবতাবাদেরই এক সংস্করণ। ইসলামও দেখা দিয়েছিল জীবনবিকাশের প্রয়োজনেই—কাজেই তাতে জীবন বিকাশের যে পথ রয়েছে তা বিচার করে দেখতে হবে।' (অতীত জীবনের স্মৃতি, ১৯৮৭, পৃ. ২২০)
জ্ঞান সাধক ও উদার হৃদয় আজরফ অন্যান্য জীবন দর্শন এবং জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কেও ছিলেন অধ্যয়ননিষ্ঠ, জিজ্ঞাসু ও বিচারশীল। এ কারণেই পঞ্চাশের দশকে ইসলামি চিন্তাবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হয়েছিল 'দুনিয়ার সংস্কৃতির ইতিহাসে মার্কসবাদের অবদান অনস্বীকার্য। ... মার্কসবাদের ঐতিহাসিক মূল্য কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।' (এ যুগের দৃষ্টিতে মার্কসবাদ, 'মাসিক দ্যুতি', শ্রাবণ ১৩৬০)
মোহাম্মদ আজরফ তাঁর উপরোক্ত 'এ যুগের দৃষ্টিতে মার্কসবাদ' নিবন্ধে মার্কসবাদের এবং মার্কসীয় দর্শনের একতত্ত্বকে দেশদর্শিতা ও নানা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর এবং এই দার্শনিক তত্ত্বকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে পরিশুদ্ধ করে বৃহত্তর ধারণার মধ্যে তার সারাংশ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সাম্যবাদী নীতি এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শে বিশ্বাসী। আল্লাহর একত্বে এবং সার্বভৌমত্বে আস্থাবান দার্শনিক আজরফ হযরত আবুজর গিফারী (রা.)-এর অনুরাগী ছিলেন। তিনি তাঁর 'সত্যের সৈনিক' ও 'হযরত আবুজর' পুস্তিকায় সাম্য ও ন্যায়নীতি এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে মহানবী (সা.)-এর অন্যতম প্রিয় সাহাবা ও আদর্শের পতাকাবাহী বিপ্লব আবুজর গিফারীর (রা.) সংগ্রামের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, উপমহাদেশের সমকালীন রাজনীতিবিদ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকামী এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রামী, ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী আবু ইসলামের সাম্য ও ন্যায় নীতিতে আস্থাবান বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উপমহাদেশ খ্যাত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি ছিল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অগ্রণী নেতা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ সত্যিকার জননেতা পূর্বেই বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ... পূর্বাপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী হওয়ার ফলে আমরা যখন ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের উদ্দেশ্যও ছিল যে ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে সমর্থ হব। এ জন্য যারা উর্দুর সপক্ষে মত দিলেন তাদের সঙ্গে আমাদের ঘন ঘন সংঘাত দেখা দিত।' (ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত রূপ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অগ্রপথিক, ভাষা দিবস সংখ্যা, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১) উল্লেখ্য, পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, সুপণ্ডিত ও ধর্মবেত্তা এবং 'ইসলামের মর্মবাণী' 'ক্রীড অব ইসলাম' গ্রন্থের রচয়িতা ও পাকিস্তানোত্তরকালে প্রতিষ্ঠিত খেলাফতে রব্বানী পার্টির অগ্রনায়ক মরহুম আবুল হাশিমের সঙ্গে ছিল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের আত্মিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত সম্পর্ক। উভয়েই ছিলেন খেলাফত এবং 'রবুবিয়াত'-এর আদর্শ ও নীতিতে আস্থাবান।
আগেই বলেছি, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরোধী এবং মানবতাবাদী এই দার্শনিক স্বজাতি, স্বদেশ ও স্বসমাজের উন্নয়নেও ছিলেন অভিলাষী। সর্বমানবের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি তিনি স্বদেশের শোষিত, বঞ্চিত মানুষেরও কল্যাণ কামনা করেছেন, চেয়েছেন সম্পদের সুষম বণ্টন। মোহাম্মদ আজরফ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের আদর্শ এবং শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো এবং সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, 'ইনসানে কামিল' বা 'মর্দে মুমিন' হওয়া এবং মানুষের মধ্যে সব ধরনের সদগুণাবলির বিকাশের মাধ্যমই সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা, সবার কল্যাণ সাধন করা যেতে পারে। মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন বিভিন্ন দর্শন ও দার্শনিকদের রচনার অভিনিবিষ্ট পাঠক এবং তাঁর অনেক রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন যুগের খ্যাতনামা দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিকদের রচনার উদ্ধৃতি এবং আলোচনা পর্যালোচনা আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক মূল্যায়ন তাঁর অধ্যয়নের পরিধি এবং পাণ্ডিত্যের পরিচয়ই তুলে ধরে। বাংলা সাহিত্যতো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যেও তাঁর ব্যাপক পঠন-পাঠন ছিল। তুলনামূলক পাঠ আর অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলেই জ্ঞান-সাধক মোহাম্মদ আজরফ জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ধর্ম-দর্শন এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিশ্বসে স্থির হতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, যৌবনে মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন 'ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' এর প্রভাবাধীন, এই আন্দোলনের দুই নেতা কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেনের অনুরাগী। এদের ব্যক্তিত্ব এবং অবদানের প্রতি তিনি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল। পরবর্তী জীবনে দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল এবং বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব তাঁর চিন্তাচেতনায় বিস্তার করলেও, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদী চিন্তাধারা এবং দার্শনিক অনুজ্ঞায়ও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় আজরফের অনেক রচনায়, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল প্রমুখের সাহিত্য এবং দার্শনিক চিন্তাচেতনা আর জগৎ ও জীবন ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের পটভূমিকায় এবং বিশেষভাবে ফারসি সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষত হাফিজ, রুমী, সাদী প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য কবির কাব্য ও দর্শনের আলোকে তিনি এদের মূল্যায়ন করেছেন। ইসলামি আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের অনুরাগী এবং ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মোহাম্মদ আজরফ প্রধানত বিশ্ব মুসলিমের এবং স্বদেশ ও সমসমাজের উন্নতি আর কল্যাণ কামনা করলেও তার মূল উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আর কাম্য ছিল মানবকল্যাণ এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসান।
মূলত, বাংলা ভাষার লেখক হলেও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ইংরেজি ভাষায়ও প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। একাধিক ভাষার সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষায় বহু কবিতা ও শ্লোক তিনি অবলীলায় আওড়াতে পারতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। মোহাম্মদ আজরফের বাগ্মিতা অসাধারণ ছিল না। তিনি বক্তৃতা দিতেন অনেকটা আলাপচারিতার ধরনে, ঘরোয়া ভঙ্গিতে। তাঁর বক্তৃতার প্রধান অংশই অধিকার করে থাকতো বাংলা ও অন্যান্য ভাষার কবিতা, শ্লোক, প্রবাদ এবং গল্প। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকদের এবং কবি সাহিত্যিকদের রচনা থেকে তিনি অনর্গল উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল প্রমুখের কবিতা তাঁর কণ্ঠ থেকে অনায়াসে উচ্চারিত হতো। বক্তৃতার মাঝে মাঝে রস রসিকতা করে এবং হাস্যরসের ভিয়েন দিয়ে তিনি কঠিন জিনিসও সহজলভ্য করে তুলতেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতো একজন দার্শনিক-পণ্ডিত এবং অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরই চির অন্তর্ধান ঘটলো।

প্রখ্যাত প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইন্তেকালে দেশ ও জাতি একজন কৃতীসন্তান এবং জ্ঞানতাপসকেই হারালো; আমরা হারালাম একজন পরম শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী, গুণী, অভিভাবক এবং অমায়িক ও স্নেহশীল ব্যক্তিত্বকে। চুরানব্বই বছর বয়সে, আমাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের এক অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ এই রৌদ্র-ছায়াময় পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন, কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর বর্ণাঢ্য ও কর্মময় জীবনের ও জ্ঞানসাধনার ইতিহাস, শিক্ষা বিস্তারে ও জ্ঞানচর্চায় এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবিস্মরণীয় অবদান, আর চারিত্র্য-বৈশিষ্ট্যের অম্লান পরিচয়, উদার ও স্নেহশীল হৃদয়ের স্বাক্ষর।
সুপুরুষ ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী; অথচ অমায়িক ও হাস্যোজ্জ্বল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের অন্তরের উদারতা আর সৌন্দর্যও ছিল হৃদয়ে দাগ কাটার মত। জমিদার-নন্দন আর অভিজাত পরিবারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও, কোনোরূপ অহমিকা বা উচ্চম্মন্যতা তাঁর আচরণে ছিল না। শ্রদ্ধেয় মরহুম আজরফের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভের সুযোগ যাদের হয়েছে তাঁরা জানেন, শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক এবং জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা-সংস্কৃতি, ধর্মতত্ত্ব, সমাজ ও অর্থনীতি এবং আরও বহুবিধ বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন ও অগাধ পাণ্ডিত্যের পাশাপাশি, তাঁর ঔদার্য আর হৃদয়ের স্নেহবত্তাও ছিল অসাধারণ। তিনি পেশা ও শ্রেণী নির্বিশেষে নবীন, প্রবীণ সব মানুষকেই অত্যন্ত আপন করে নিতেন, স্নেহ ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখতেন। ধর্মীয় বা আদর্শগত মতপার্থক্য, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহা আদর্শের ভিন্নতা সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াত না।
সিলেটের সুনামগঞ্জের এক সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারের সন্তান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক দেওয়ান আজরফ (উল্লেখ্য, তিনি নামের শেষে 'চৌধুরী' পদবি লেখা বর্জন করেছিলেন এবং তাঁর বহু রচনায় 'দেওয়ান' অভিধাও ব্যবহার করেননি)। আজীবন জ্ঞানচর্চা করলেও, তিনি কোনো 'আইভরি টাওয়ার' বা 'গজদন্ত মিনার'-এর বাসিন্দা ছিলেন না। তাঁর দীর্ঘ ও কর্মময় জীবনে তিনি জ্ঞান সাধনার পাশাপাশি কর্মসাধনায়ও আত্মনিয়োগ করেন।
রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হন। অনেক ক্ষেত্রে নেতৃত্বের দায়ভার এবং দায়িত্বও গ্রহণ করেন। শিক্ষা বিস্তারে এবং জ্ঞানচর্চায় ও দার্শনিক অনুধ্যানে নিবেদিতপ্রাণ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সাধারণ মানুষের সঙ্গেও একাত্ম হয়েছেন, কামনা করেছেন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন, জনগণের দারিদ্রদ্র্য মোচন এবং অর্থনৈতিক মুক্তি। জমিদার নন্দন হওয়া সত্ত্বেও মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থা এবং চিন্তাচেতনার বিরোধী, ইসলামের সাম্য ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ ও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় আকাঙ্ক্ষী। দার্শনিক আজরফ তাঁর বহু রচনায় তাঁর জীবনবোধ, জীবন-চেতনা এবং মানবতাবাদী আদর্শের কথা নানা তত্ত্ব, তথ্য ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিধৃত করেছেন। অভিজাত পরিবারের সন্তান এবং শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হওয়া সত্ত্বেও তাঁর ব্যক্তিজীবনের আচার-আচরণে ও কর্মতৎপরতায় যেমন জনগণের প্রতি মমত্ববোধ ও সহমর্মিতা প্রকাশিত, তেমনি তাঁর অনেক রচনায় বিশেষত সৃষ্টিশীল রচনায় দারিদ্রদ্র্যপীড়িত ও শোষণ-বঞ্চনার শিকার সাধারণ মানুষের জীবনালেখ্যও বিধৃত। একাধারে দার্শনিক, পণ্ডিত ও সৃষ্টিশীল লেখক এবং বরেণ্য মরমি কবি ও আধ্যাত্মিক সাধক ও জমিদার হাসন রাজার দৌহিত্র মোহাম্মদ আজরফ সমাজ আর সাধারণ মানুষের জীবন অধ্যয়নেও যে ব্রতী ছিলেন, তাঁর কোনো কোনো ছোট গল্পে ও উপন্যাসে রয়েছে তাঁর পরিচয়। উল্লেখ্য হাসন রাজার পুত্র এবং মোহাম্মদ আজরফের মামা দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরীও ছিলেন সেকালের বিশিষ্ট কবি।
সদ্য পরলোকগত শ্রদ্ধেয় দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দার্শনিক চিন্তা-চেতনা, অনুধ্যান, জ্ঞানচর্চা আর সাহিত্যকর্ম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সে সবের মূল্যায়ন এ রচনার উদ্দিষ্ট বা লক্ষ্য নয় এবং তা আমার সাধ্যাতীতও নয় বটে। তবুও মরহুমের রচনার দীর্ঘদিনের অনুরাগী পাঠক ও তাঁর স্নেহধন্য একজন হিসেবে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে উল্লেখ করতেই হয় যে, মোহাম্মদ আজরফ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা, বংশগত ও পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে। সেই ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু করেন, দর্শন অধ্যয়নে ও দর্শনচর্চায় ব্রতী হন, তার মূলেও কাজ করেছে পারিবারিক ও বংশগত ঐতিহ্য ও রক্তের ধারা। উল্লেখ্য, সে যুগে অভিজাত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিশেষত সামন্তবাদী পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দুর চর্চাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু মোহাম্মদ আজরফের পরিবারে এবং তাঁর নানা মরমি কবি হাসন রাজার পরিবারে সেকালেই সাহিত্যের চর্চা ছিল এবং বাংলা ভাষায় সৃষ্টিশীল ও চিন্তামূলক সাহিত্যও রচিত হয়েছে। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আজরফের চাচাতো ভাই মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আহবাব চৌধুরী ব্রিটিশ আমলেই সমাজ, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং বাংলা ভাষার বিকাশ, বিবর্তন এবং উন্নয়ন সম্পর্কে মাসিক মোহাম্মদী, মাসিক সওগাত, মাসিক আল ইসলাহ এবং অন্যান্য পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ, আলোচনা-সমালোচনা লেখেন। আহবাব চৌধুরী ছিলেন একাধারে রাজনীতিবিদ, আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর এবং সুলেখক। ১৯২৭ সালেই প্রকাশিত হয় তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ 'বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে'। ভাষা, সাহিত্য, সমাজ, সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা ছাড়াও স্বাতন্ত্র্যবাদী এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী আহবাব চৌধুরী মুসলমান সমাজে প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দ সম্বলিত ভাষা ব্যবহারের অধিকার সম্পর্কে লেখালেখি করেন, তাঁরই উদ্যোগে সেকালে পাঠ্যপুস্তকে ও ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতায় মুসলিম ঐতিহ্যবাহী শব্দ সম্বলিত ভাষা ব্যবহারের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটর আহবাব চৌধুরীর উত্থাপিত প্রস্তাব সিনেটে গৃহীত হওয়ার ফলেই ম্যাট্রিক পরীক্ষার খাতায় ও পাঠ্যপুস্তকে আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারের আইনগত স্বীকৃতি মেলে। এই প্রেক্ষিতে তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে মাসিক মোহাম্মদী ও অন্যান্য পত্রিকায় সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। (দ্রষ্টব্য মাসিক মোহাম্মদী, অগ্রহায়ণ, ১৩৫০)।
উপরোক্ত ইতিহাস ও পটভূমির কথা স্মরণে রাখলে, লেখক ও দার্শনিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের (একদা ১৯৪৬ সালে তিনি আসাম আইন পরিষদের সদস্য ছিলেন) সাহিত্য সাধনা, দর্শন-চর্চা এবং পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনকালে একজন লেখক, শিক্ষাবিদ ও সাংবাদিক হিসেবে সিলেটে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা এবং ভাষা আন্দোলনে অবিস্মরণীয় অবদানের বিষয়টি অনুধাবন ও উপলব্ধি করা যাবে। এ সত্য অনস্বীকার্য যে, শিক্ষাবিদ, দার্শনিক, ইসলামি চিন্তাবিদ ও লেখক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের ঐ ঐতিহাসিক ভূমিকা ও অবদান অর্থাৎ ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা, শিক্ষাবিদ, ও দার্শনিক হিসেবে তাঁর ব্যাপক খ্যাতি ও স্বীকৃতির আড়ালে অনেকটা চাপা পড়ে গেছে। উল্লেখ্য, শুধু তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হিসেবেই নয়, ১৯৪৮ সালেই সিলেট থেকে মাহমুদ আলী প্রকাশিত ও সম্পাদিত সপ্তাহিক 'নওবেলাল' পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক হিসেবে এবং পরবর্তীতে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শ্রদ্ধেয় আজরফ ছিলেন ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত সাপ্তাহিক 'নওবেলাল'-এর প্রথম সম্পাদক এবং প্রধান সম্পাদক ও প্রকাশক ছিলেন মাহমুদ আলী। 'নওবেলাল' সম্পাদনাকালে এবং পরবর্তী পর্যায়েও ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে যে চাকরি জীবনেও নানাভাবে হয়রানির শিকার হতে ও মূল্য দিতে হয়েছে সে ইতিহাস বিধৃত রয়েছে তাঁর স্মৃতিচারণে (ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি) এবং অন্যান্য রচনায়। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান অগ্রণী সংস্থা পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস এবং এই সংস্থার মুখপত্র 'সাপ্তাহিক সৈনিক'-এর ভূমিকা ও অবদান যে অবিস্মরণীয় তা স্বীকৃত। সাপ্তাহিক 'নওবেলাল' ভাষা আন্দোলনে যে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে, সে সত্যও অনস্বীকার্য। উল্লেখ্য, সেকালে অভিজাত ও উচ্চবিত্ত এবং সামন্তবাদী চিন্তা ধোরাপ্রসূত মুসলিম পরিবারে আরবি, ফারসি ও উর্দু চর্চা প্রাধান্য পেত, বাংলা ভাষার চর্চাকে উল্টো অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হতো সেকালে পাকিস্তান সরকারের বৈরিতার মুখে এবং বাংলা বিরোধীদের দৌরাত্ম্যে বাংলাভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অংশগ্রহণ সহজ ব্যাপার ছিল না। বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে স্বীকৃতিদানের দাবিতে অনুষ্ঠিত সভা-সমিতিতে যোগদানের জন্য মোহাম্মদ আজরফকে সরকারের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে হয়েছে। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সব ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেও এবং ১৯৪৯ সাল থেকে পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি হিসেবেও ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। একজন শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক হিসেবে শুধু শীতল পাণ্ডিত্যের চর্চা করেননি, কেবল দর্শন চিন্তায় ও তথ্য তত্ত্বের ব্যাখ্যা দানে ব্যাপৃত থাকেননি। উল্লেখ্য, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন প্রায় গোড়া থেকেই পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিস ও সাপ্তাহিক সৈনিক-এর সাথে সম্পৃক্ত। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ছিলেন।
ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর সুদীর্ঘ, সাহিত্য জীবনে অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখলেও এবং জীবনের এক পর্যায়ে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত হওয়ায়, ১৯৪৬ সালের আসাম আইন পরিষদের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মূল প্রবণতা এবং সাধনার ক্ষেত্র ইতিহাস ও দর্শন চর্চা। স্মরণযোগ্য যে, দেশ বিভাগ পূর্বকালে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মুসলিম লীগ রাজনীতি ও পাকিস্তাদ আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। আসামের মুসলিম লীগ নেতা ও লাইনপ্রথা বিরোধী আন্দোলনের অগ্রনায়ক মওলানা ভাসানীর অনুরাগী ও অনুসারী হিসেবে তৎকালে আসামে বহিরাগতদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে দিয়ে শিলচরে গ্রেফতার হন এবং দশ মাসের কারাদণ্ডও ভোগ করেন। মরমি সাধক ও কবি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বরেণ্য ও অবিশ্বরণীয় ব্যক্তিত্ব ও মহৎ মানবতাবাদী হাসন রাজার ঐতিহ্যিক উত্তরাধিকার যে তাঁর দৌহিত্র (কন্যার পুত্র) দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে সৃষ্টি রহস্য উদঘাটনে এবং দার্শনিক চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিল, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে খ্যাত এবং ইসলামের সাম্যনীতি ও মানবতাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ মোহাম্মদ আজরফ আজীবন ইসলামের ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং মানবতাবাদী চিন্তা-চেতনা নিয়ে প্রচুর অধ্যয়ন আর লেখালেখি করলেও অন্যান্য ধর্ম এবং দর্শন সম্পর্কেও তাঁর পড়াশোনা ছিল অগাধ। উদার হৃদয়ের অধিকারী এবং মানবতাবাদী আজরফ শুধু বিভিন্ন ধর্ম-দর্শন আর ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কেই ব্যাপক পড়াশোনা করেননি, তিনি বিভিন্ন ধর্ম-দর্শনের মহৎ ও কল্যাণকর এবং মানবতাবাদী দিকগুলোকে মর্যাদা ও মূল্য দিয়েছেন। শুধু তাঁর লেখায়ই নয়, বিভিন্ন সেমিনারে ও আলোচনা সভায় তাঁর ভাষণে তিনি ইসলাম ধর্মের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক দিক ইসলামের ইতিহাস ও দার্শনিক তত্ত্ব, ইসলামের আদর্শ ও মানবতাবাদী শিক্ষা তুলে ধরার পাশাপাশি অন্যান্য ধর্ম-দর্শনের তুলনামূলক পর্যলোচনা করতেন, যুক্তি বাস্তবতার আলোকে এবং মানবকল্যাণের লক্ষ্যে সবকিছু বিচার-বিবেচনা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিতেন।
ইসলামের শিক্ষা ও মানবতাবাদী আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাসী হলেও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ অন্যান্য ধর্ম আর দর্শনের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। তিনি অন্যান্য ধর্মের প্রতি শুধু শ্রদ্ধাশীলই ছিলেন না, ধর্ম বিষয়ক সভা সেমিনারে এবং ধর্মীয় নেতা ও দার্শনিক-মনীষীদের স্মরণ সভায়ও আমন্ত্রিত হয়ে যোগদান করতেন। ধর্ম, দর্শন এবং মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাদি বিষয়ে মূল্যবান বক্তব্য রাখতেন। অবাধ জ্ঞানচর্চা এবং সর্ব বিষয়ে অধ্যয়ন ও জানার ব্যাপারে আজীবন তাঁর আগ্রহ ছিল ঐকান্তিক। তাঁর রচিত 'ইসলাম ও মানবতাবাদ', 'দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ ধর্ম ইসলাম', 'ইসলামিক মুভমেন্ট', 'জীবন সমস্যা সমাধানে ইসলাম' ইত্যাদি গ্রন্থে ও অন্যান্য রচনায় ধর্ম দর্শন পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা এবং মানবতার মুক্তি সনদ হিসেবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরতে গিয়ে তিনি তুলনামূলক পর্যালোচনাও করেছেন। তুলনামূলক দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ছিল তাঁর প্রিয় বিষয়। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, 'প্রকৃত ইসলামী জীবন ব্যবস্থা মানবতাবাদেরই এক রূপ। মানব জীবনে সুস্থ, সবল ও স্বাভাবিক রাখার জন্য এ দুনিয়ায় যে ব্যবস্থার প্রবর্তন হয়েছিল তা ইসলাম এবং তা মানবতাবাদেরই এক সংস্করণ। ইসলামও দেখা দিয়েছিল জীবনবিকাশের প্রয়োজনেই—কাজেই তাতে জীবন বিকাশের যে পথ রয়েছে তা বিচার করে দেখতে হবে।' (অতীত জীবনের স্মৃতি, ১৯৮৭, পৃ. ২২০)
জ্ঞান সাধক ও উদার হৃদয় আজরফ অন্যান্য জীবন দর্শন এবং জীবন ব্যবস্থা সম্পর্কেও ছিলেন অধ্যয়ননিষ্ঠ, জিজ্ঞাসু ও বিচারশীল। এ কারণেই পঞ্চাশের দশকে ইসলামি চিন্তাবিদ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হয়েছিল 'দুনিয়ার সংস্কৃতির ইতিহাসে মার্কসবাদের অবদান অনস্বীকার্য। ... মার্কসবাদের ঐতিহাসিক মূল্য কেউ অস্বীকার করতে পারেন না।' (এ যুগের দৃষ্টিতে মার্কসবাদ, 'মাসিক দ্যুতি', শ্রাবণ ১৩৬০)
মোহাম্মদ আজরফ তাঁর উপরোক্ত 'এ যুগের দৃষ্টিতে মার্কসবাদ' নিবন্ধে মার্কসবাদের এবং মার্কসীয় দর্শনের একতত্ত্বকে দেশদর্শিতা ও নানা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর এবং এই দার্শনিক তত্ত্বকে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের আলোকে পরিশুদ্ধ করে বৃহত্তর ধারণার মধ্যে তার সারাংশ গ্রহণের আবশ্যকতার কথা বলেছিলেন। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সাম্যবাদী নীতি এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আদর্শে বিশ্বাসী। আল্লাহর একত্বে এবং সার্বভৌমত্বে আস্থাবান দার্শনিক আজরফ হযরত আবুজর গিফারী (রা.)-এর অনুরাগী ছিলেন। তিনি তাঁর 'সত্যের সৈনিক' ও 'হযরত আবুজর' পুস্তিকায় সাম্য ও ন্যায়নীতি এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের লক্ষ্যে মহানবী (সা.)-এর অন্যতম প্রিয় সাহাবা ও আদর্শের পতাকাবাহী বিপ্লব আবুজর গিফারীর (রা.) সংগ্রামের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। উল্লেখ্য, উপমহাদেশের সমকালীন রাজনীতিবিদ, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনকামী এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রামী, ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধে বিশ্বাসী আবু ইসলামের সাম্য ও ন্যায় নীতিতে আস্থাবান বরেণ্য ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উপমহাদেশ খ্যাত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর প্রতি ছিল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের অপরিসীম শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম অগ্রণী নেতা মওলানা ভাসানী সম্পর্কে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ লিখেছেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী প্রমুখ সত্যিকার জননেতা পূর্বেই বাংলাদেশকে একটা স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। ... পূর্বাপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনৈতিক মতবাদের অনুসারী হওয়ার ফলে আমরা যখন ভাষা আন্দোলনে যোগদান করেছিলাম তখন আমাদের উদ্দেশ্যও ছিল যে ভাষার পার্থক্যের ভিত্তিতে আমরা পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে সমর্থ হব। এ জন্য যারা উর্দুর সপক্ষে মত দিলেন তাদের সঙ্গে আমাদের ঘন ঘন সংঘাত দেখা দিত।' (ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত রূপ, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অগ্রপথিক, ভাষা দিবস সংখ্যা, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১) উল্লেখ্য, পাকিস্তান আন্দোলনের অন্যতম নেতা, খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ, সুপণ্ডিত ও ধর্মবেত্তা এবং 'ইসলামের মর্মবাণী' 'ক্রীড অব ইসলাম' গ্রন্থের রচয়িতা ও পাকিস্তানোত্তরকালে প্রতিষ্ঠিত খেলাফতে রব্বানী পার্টির অগ্রনায়ক মরহুম আবুল হাশিমের সঙ্গে ছিল দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের আত্মিক, সাংস্কৃতিক ও আদর্শগত সম্পর্ক। উভয়েই ছিলেন খেলাফত এবং 'রবুবিয়াত'-এর আদর্শ ও নীতিতে আস্থাবান।
আগেই বলেছি, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার বিরোধী এবং মানবতাবাদী এই দার্শনিক স্বজাতি, স্বদেশ ও স্বসমাজের উন্নয়নেও ছিলেন অভিলাষী। সর্বমানবের কল্যাণ কামনার পাশাপাশি তিনি স্বদেশের শোষিত, বঞ্চিত মানুষেরও কল্যাণ কামনা করেছেন, চেয়েছেন সম্পদের সুষম বণ্টন। মোহাম্মদ আজরফ গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের আদর্শ এবং শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটানো এবং সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। তিনি এও বিশ্বাস করতেন যে, 'ইনসানে কামিল' বা 'মর্দে মুমিন' হওয়া এবং মানুষের মধ্যে সব ধরনের সদগুণাবলির বিকাশের মাধ্যমই সুন্দর সমাজ প্রতিষ্ঠা, সবার কল্যাণ সাধন করা যেতে পারে। মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন বিভিন্ন দর্শন ও দার্শনিকদের রচনার অভিনিবিষ্ট পাঠক এবং তাঁর অনেক রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন যুগের খ্যাতনামা দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও ধর্মতাত্ত্বিকদের রচনার উদ্ধৃতি এবং আলোচনা পর্যালোচনা আর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তুলনামূলক মূল্যায়ন তাঁর অধ্যয়নের পরিধি এবং পাণ্ডিত্যের পরিচয়ই তুলে ধরে। বাংলা সাহিত্যতো বটেই, বিশ্ব সাহিত্যেও তাঁর ব্যাপক পঠন-পাঠন ছিল। তুলনামূলক পাঠ আর অধ্যয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্ম, দর্শন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয়ের ফলেই জ্ঞান-সাধক মোহাম্মদ আজরফ জীবনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ধর্ম-দর্শন এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে বিশ্বসে স্থির হতে পেরেছিলেন। উল্লেখ্য, যৌবনে মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন 'ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' এর প্রভাবাধীন, এই আন্দোলনের দুই নেতা কাজী আবদুল ওদুদ ও আবুল হুসেনের অনুরাগী। এদের ব্যক্তিত্ব এবং অবদানের প্রতি তিনি ছিলেন আজীবন শ্রদ্ধাশীল। পরবর্তী জীবনে দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবাল এবং বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাব তাঁর চিন্তাচেতনায় বিস্তার করলেও, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতাবাদী চিন্তাধারা এবং দার্শনিক অনুজ্ঞায়ও তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। শ্রদ্ধেয় আজরফের অনেক রচনায়, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল প্রমুখের সাহিত্য এবং দার্শনিক চিন্তাচেতনা আর জগৎ ও জীবন ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের পটভূমিকায় এবং বিশেষভাবে ফারসি সাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষত হাফিজ, রুমী, সাদী প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য কবির কাব্য ও দর্শনের আলোকে তিনি এদের মূল্যায়ন করেছেন। ইসলামি আদর্শ, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধের অনুরাগী এবং ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মোহাম্মদ আজরফ প্রধানত বিশ্ব মুসলিমের এবং স্বদেশ ও সমসমাজের উন্নতি আর কল্যাণ কামনা করলেও তার মূল উদ্দেশ্য, লক্ষ্য আর কাম্য ছিল মানবকল্যাণ এবং শোষণ-বঞ্চনার অবসান।
মূলত, বাংলা ভাষার লেখক হলেও দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ইংরেজি ভাষায়ও প্রবন্ধ এবং গ্রন্থ রচনা করেছেন। একাধিক ভাষার সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিচয় এবং বাংলা, আরবি, ফারসি, উর্দু, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষায় বহু কবিতা ও শ্লোক তিনি অবলীলায় আওড়াতে পারতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। মোহাম্মদ আজরফের বাগ্মিতা অসাধারণ ছিল না। তিনি বক্তৃতা দিতেন অনেকটা আলাপচারিতার ধরনে, ঘরোয়া ভঙ্গিতে। তাঁর বক্তৃতার প্রধান অংশই অধিকার করে থাকতো বাংলা ও অন্যান্য ভাষার কবিতা, শ্লোক, প্রবাদ এবং গল্প। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিকদের এবং কবি সাহিত্যিকদের রচনা থেকে তিনি অনর্গল উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। শেখ সাদী, হাফিজ, ওমর খৈয়াম, রবীন্দ্রনাথ, ইকবাল, নজরুল প্রমুখের কবিতা তাঁর কণ্ঠ থেকে অনায়াসে উচ্চারিত হতো। বক্তৃতার মাঝে মাঝে রস রসিকতা করে এবং হাস্যরসের ভিয়েন দিয়ে তিনি কঠিন জিনিসও সহজলভ্য করে তুলতেন। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের মতো একজন দার্শনিক-পণ্ডিত এবং অমায়িক ব্যক্তিত্বের অধিকারী ব্যক্তিরই চির অন্তর্ধান ঘটলো।

জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের প্রবীণতম দার্শনিক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির পর স্বভাবতই সর্বভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের মধ্যেও বিভক্তির সৃষ্টি হয়।
১০ ঘণ্টা আগেবিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ সাহিত্য সম্মাননা হিসেবে পরিচিত শেখ জায়েদ বুক অ্যাওয়ার্ড। সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্থপতি শেখ জায়েদ বিন সুলতান আল নাহিয়ানের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে ২০০৬ সালে এ সম্মাননা চালু হয়।
৩ দিন আগে
দিলরুবা তার মাকে নিতে আসে গ্রামে। গ্রামের মানুষ পাঁচ মাস পর হঠাৎ আবিষ্কার করে এক নতুন দিলরুবাকে। দিলরুবার চেহারায় এই পাঁচ মাসেই জৌলুস এসেছে। আভিজাত্যের ছাপ এসেছে। আভিজাত্য তার বয়স কমিয়ে দিয়েছে। অর্থ মানুষকে সত্যিই বদলে দেয়।
৩ দিন আগে
মধ্যযুগের পুঁথি ছিল আধুনিক যুগের উপন্যাসের মতোই বিষয়-আশয়ে ঠাসা। পার্থক্য শুধু সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের। উপন্যাস রচিত হয় কথার পর কথা সাজিয়ে; আর পুঁথি রচিত হতো সুর-ছন্দ-অন্ত্যমিলের সংমিশ্রণে, যা পড়লে মানুষ সহজেই আকৃষ্ট হতো, এখনো হয়। আকৃষ্ট হওয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল সুর।
৩ দিন আগে