দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

ড. আনিসুজ্জামান
প্রকাশ : ০৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৬: ৪৬

জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের প্রবীণতম দার্শনিক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির প্রাক্তন সভাপতি এবং বর্তমানে প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি বাংলাদেশ দর্শন সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাণপুরুষ। ১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির পর স্বভাবতই সর্বভারতীয় দর্শন কংগ্রেসের মধ্যেও বিভক্তির সৃষ্টি হয়। তদানীন্তন পাকিস্তান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেসের, বিশেষ করে এর পূর্বাঞ্চলীয় শাখা, প্রতিষ্ঠা ও তার কর্মকাণ্ড নির্বাহের ক্ষেত্রে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পাকিস্তান ফিলোসফিক্যাল কংগ্রেস ও বাংলাদেশ দর্শন সমিতির একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসেবে বিভিন্ন সময়ে তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেও অনেক দর্শন সংশ্লিষ্ট ও ধর্মীয় সেমিনারে যোগদান করেছেন এবং স্বীয় চিন্তা ও মনীষার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। দেওয়ান আজরফ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি একজন বড় মাপের জীবন-ঘনিষ্ঠ দার্শনিক, উঁচুস্তরের সুফি সাধক, ইসলামি চিন্তাবিদ, গণমুখী রাজনীতিক, কল্যাণধর্মী অর্থনীতিবিদ, মানব মুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিত সংস্কৃতির বলিষ্ঠ কণ্ঠ, সুবক্তা, সুলেখক ও সুপণ্ডিত, সর্বোপরি একই সাথে বিরল ধী-শক্তি ও সুপণ্ডিত ও হৃদয়ানুভূতির অধিকারী একজন প্রজ্ঞাবান মানুষ।

সিকি শতাব্দীরও অধিককাল ধরে অত্যন্ত কাছে থেকে এই অসামান্য প্রতিভার অধিকারী মানুষটিকে গভীরভাবে জানার সুযোগ লাভে আমি নিজেকে ধন্য মনে করি। অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাঁর কাছে ব্র্যাডলির যুক্তিবিদ্যা পড়ার বিরল সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। 'বিরল সৌভাগ্য' এজন্য বলছি যে, তিনি তখন কিছুদিনের জন্য খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। কেবল একজন হৃদয়বান পিতৃতুল্য মানুষ হিসেবেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছে সমাদৃত ছিলেন না, একজন অত্যন্ত সফল শিক্ষক হিসেবেও তিনি ছিলেন তাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয়। ক্লাসরুমের বাইরে, এমন কি বাসায়ও, ছাত্রছাত্রীদের নোট দেখে দেয়া, ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া, বাস্তব জীবনের নানা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সুপরামর্শ ও সদুপদেশ নিয়ে এগিয়ে আসাসহ বিবিধ কাজের ভেতর দিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই তিনি পরিণত হতেন ছাত্রছাত্রীদের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তিত্বে। বস্তুত, তিনি নিজেই কেবল একজন গুণী ব্যক্তি নন, অন্যদের অন্তস্থিত মৌলিক মানবীয় গুণাবলি আবিষ্কার-অনুধাবন ও সে সবের বিকাশের ক্ষেত্রেও তিনি সদাই উপকারী বন্ধুর ভূমিকা পালন করেন। একটি প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে বহু-মাত্রিক এ ব্যক্তিত্বের কীর্তি ও কর্মের, চিন্তা ও মনীষার উপস্থাপন ও মূল্যায়ন সম্ভব নয়। সেজন্য আমি কেবল তাঁর দর্শন চিন্তার কয়েকটি দিকের প্রতি সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে এ প্রবন্ধটি সমাপ্ত করবো।

বিজ্ঞাপন

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দার্শনিক চিন্তার মূল কাঠামো সম্বন্ধে কিছু বলার আগে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা সম্বন্ধে দু'একটি কথা বলা জরুরি মনে করি। এটা এজন্য যে প্রত্যেকটি মানুষের ব্যক্তিত্ব বিকাশ ও মনীষার স্ফুরণের ওপর তাঁর শিক্ষা ও পরিবেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব থাকে।

দার্শনিক-চিন্তাবিদগণও এর ব্যতিক্রম নন। এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত দার্শনিক বারট্রান্ড রাসেলের একটি কথা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, 'Philosophers are both effects and causes: effects of teir social circumstances and of the politics and institutions of their time; causes (if they are fortunate) of beliefs which mould the politics and institutions of later ages.

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯০৬ সানের ২৫ অক্টোবর, ১৩১৩ বাংলা ৯ কার্তিক রোজ শুক্রবার সুনামগঞ্জ শহরে মাতামহ বিশ্ববিখ্যাত মরমি কবি ও জমিদার হাসন রাজার বাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সোনার চামচ মুখে দিয়েই জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং জন্মসূত্রেই সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক ও জ্ঞানী ব্যক্তি এরিস্টটল কর্তৃক চিহ্নিত দর্শনচর্চার দুটো পূর্বশর্ত প্রাচুর্য বা সচ্ছলতা এবং অবসর-পূরণ করেছেন। এর থেকেও বড় কথা, দর্শনচর্চার জন্য যে বিশেষ ধরনের জিজ্ঞাসু মন প্রয়োজন, ছোট বেলা থেকেই তাঁর মধ্যে সেটি পরিলক্ষিত হয়। সাধারণত বড়লোকদের ছেলেমেয়েদের, বিশেষ করে সামন্তবাদী ব্যবস্থায়, যে সব বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়, যেমন ভোগবাদী হওয়া, গড্ডলিকা প্রবাহে নিজেদের ভাসিয়ে দেয়া, শোষণমূলক মনোবৃত্তির অধিকারী হওয়া, বংশ গৌরববোধ করা, সাধারণ মানুষদের মানুষ হিসেবে গণ্য না করা, অনর্জিত ও প্রয়াস-নিরপেক্ষ গুণ-বৈশিষ্ট্যের কারণে অহংকার বোধ করা ও অন্যদের হেয় ও ছোট মনে করা, নৈতিক দিক দিয়ে শিথিল হওয়া, মূল ও যথার্থ ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ না হয়ে বাহ্যিক ধর্মীয় আড়ম্বর ও অনুষ্ঠানসর্বস্ব হওয়া, আন্তরিক না হয়ে প্রদর্শন বাতিকগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি। সে সব থেকে তিনি আশ্চর্যজনকভাবে মুক্ত ছিলেন।

জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করলেও তাঁর শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া হয়। প্রচলিত ব্যবস্থা অনুযায়ী পারিবারিক পরিবেশেই তাঁর শিক্ষারম্ভ হয়। পরে ১৯১২ সনে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে নিজেদের পরিচালিত গ্রামের স্কুলে ভর্তি করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুলে ভর্তি হন। অত্যন্ত সুনামের সাথে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি ১৯২৫ সালে সিলেট এমসি কলেজে ভর্তি হন এবং পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে কৃতিত্বের সাথে এমএ পাশ করেন। 'Access to Reality' নামে তিনি তাঁর Ph.D. থিসিসও সম্পন্ন করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তদানীন্তন প্রধান ড. গোবিন্দ চন্দ্র (জি. সি) দেবের প্রথমে আমেরিকায় ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে চলে যাওয়া এবং পরবর্তীকালে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চেই সেই ভয়াল রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার কারণে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে থিসিস জমা দেয়ার মনোভাব হারিয়ে ফেলেন। নানা কারণে এর পরেও তিনি আর তাঁর থিসিস দাখিল করেননি।

ছাত্র হিসেবে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। বিস্ময়কর তাঁর স্মরণ শক্তি। এ বয়সেও তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বাংলা, উর্দু, ফার্সি, সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য হতে উদ্ধৃতি দিয়ে যেতে পারেন। বিষয় বিশেষের মধ্যে তাঁর পড়াশোনা সীমাবদ্ধ নয়। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বিভিন্ন প্রকার দর্শন ছাড়াও তিনি বিশ্বসাহিত্য, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও বিভিন্ন চিন্তাবিদের অনেক মূল্যবান গ্রন্থ গভীর মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করেছেন। এর থেকেও বড় কথা হলো কেবল তাত্ত্বিক পড়াশোনার মধ্যেই তিনি তাঁর সব মেধা ও কর্মক্ষমতাকে নিঃশেষিত করেননি। পড়াশোনা ও লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন জনহিতকর কর্ম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত বিভিন্ন আন্দোলনে তিনি নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেছেন। এসবের পরিণতিতে স্বাভাবিকভাবেই তাই তাঁর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের কর্ম সম্পাদনের দক্ষতার সৃষ্টি হয় এবং তিনি নানাবিধ গুণাবলির অধিকারী হন। দীর্ঘ জীবনে দেওয়ান আজরফ অসংখ্য সেমিনার ও আলোচনা সভায় বক্তৃতা করেছেন। তিনি প্রচুর লিখেছেন। প্রায় পৌনে এক শতক গ্রন্থ ও কয়েক সহস্র প্রবন্ধের তিনি রচয়িতা। দর্শনের বিভিন্ন বিষয় ছাড়াও তিনি ছোটগল্প, নাটক, উপন্যাস, কবিতা, রম্যরচনা, ভ্রমণকাহিনী, ধর্মীয় ও সমাজিক বিষয়াবলি নিয়ে বিভিন্ন প্রবন্ধ, জীবনী গ্রন্থ প্রভৃতি রচনা করেছেন। বলাবাহুল্য সব রচনার মধ্যেই তাঁর জীবনবোধ ও বিশ্বাস প্রতিফলিত হয়েছে।

এবার আমরা তাঁর দার্শনিক চিন্তার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উল্লেখ করবো। 'উল্লেখ করবো' শব্দ দুটি ব্যবহার করছি এজন্য যে আমরা কোনো দার্শনিক প্রবন্ধ রচনা করার সময় যে পদ্ধতি ব্যবহার করি, এ প্রবন্ধে সে পদ্ধতি ব্যবহার করবো না। আমরা আমাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় তেমন কোনো যুক্তি প্রদর্শন করবো না, বিষয় বিন্যাসে তেমন পারম্পর্য বজায় রাখবো না, সমালোচনামুখর বা বিশ্লেষণাত্মক হবো না। এর কারণ তা হলে আমাদের একটি অত্যন্ত ছোট এলাকা বেছে নিতে হবে এবং তার পাঠক হবেন কেবল টেকনিক্যাল অর্থে দার্শনিকরা। আমার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য ভিন্ন। এর অধিকাংশ পাঠক একাডেমিক দর্শনের বাইরের লোক। তাঁরা জীবন দর্শনে আগ্রহী এবং কী করে দার্শনিক চিন্তা অগ্রসর হয়, সেটি নয় বরং তার শেষ ফল কী তা জানতে চান। সেজন্য আমি একটুখানি ভিন্নভাবে অগ্রসর হচ্ছি। দেওয়ান আজরফের জ্ঞানতত্ত্ব দিয়ে শুরু করি, এজন্য যে কোনো দার্শনিকের দার্শনিক চিন্তার গতি প্রকৃতি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে তাঁর দার্শনিক সৌধের ভিত্তি তথা জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রথমে জানা প্রয়োজন। দেওয়ান আজরফ পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য দর্শনের বিভিন্ন জ্ঞানতাত্ত্বিক মতবাদ অধ্যয়ন ও পর্যালোচনা করে জ্ঞানতত্ত্ব সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতবাদ গড়ে তুলেছেন। তিনি পূর্ণ জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে এককভাবে বুদ্ধিবাদ, অভিজ্ঞতাবাদ, বিচারবাদ, এমনকি স্বজ্ঞাবাদ গ্রহণ করেননি বরং ক্ষেত্রবিশেষে জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ক এ সব কটি মতকেই একই সাথে বিবেচনায় নিয়েছেন এবং ওয়াহীর আলোকে এগুলোকে সমন্বিত করে গ্রহণ করেছেন। অন্য কথায়, তিনি বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়-অভিজ্ঞতা ও সাধারণ স্বজ্ঞাকে অস্বীকার করেননি, তবে পূর্ণ জ্ঞান অর্জন ও সত্য লাভের ক্ষেত্রে একক এমনকি যৌথভাবেও এদের কার্যকারিতা মেনে নেননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন- ‘The intuition of the Prophets have still farreaching effects on the pages of history. Their intuitions are recorded and regarded as the truths received without the help of the normal sense organs or the ratio cinative faculty. They solve problems of life, give direc tives to the activities of men, temodel the different institutions of society. In short, they revalue the ideas and ideals of the existing order and remould the lives of men. Though apparently no logi cal ground can be deciphered as to their origin, they do not as a matter of fact contradict the laws of reasoning or of logic.’

এভাবে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জ্ঞানোৎপত্তি সংক্রান্ত তাঁর ব্যাপক ভিত্তিক মত উপস্থাপন করেন। স্বাভাবিকভাবেই এজন্য তাঁর দর্শন একপেশে বা খণ্ডিত রূপ পরিগ্রহ করেনি। এরূপ একটি ব্যাপক জ্ঞানতাত্ত্বিক ভিত্তির উপরে তাঁর দার্শনিক সৌধ গড়ে উঠেছে বলে তাঁর অধিবিদ্যক অবস্থান, পাশ্চাত্যে প্রচলিত এবং সে হিসেবে প্রাচ্যে অনুসৃত অর্থে, একজন স্বপ্নবিলাসী ভাববিলাসীর নয়। সেজন্য দর্শন তাঁর কাছে জীবনবিচ্ছিন্ন কোন তত্ত্বচিন্তা নয় বরং তিনি গভীরভাবে বিশ্বাস করেন যে যথার্থ দার্শনিক জিজ্ঞাসার মূল রয়েছে মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে। অন্য কথায়, তত্ত্বজিজ্ঞাসা মানুষের সহজাত। জীবন ও জগতের উৎপত্তি ও পরিণতি তথা আদি কারণ সংক্রান্ত প্রশ্ন, মানুষের উৎপত্তি, মানব প্রকৃতি, মানবজীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, সে লক্ষ্য অর্জনের উপায়, শুভ-অশুভের প্রকৃতি ও দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত জিজ্ঞাসা সচেতন মানব মনকে নাড়া দেবেই। এ সম্বন্ধে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বলেন— ‘মানব-জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করলে যা আমাদের কাছে স্পষ্টত প্রতিভাত হয়—তা হচ্ছে মানবেতর প্রাণীর জীবন থেকে তার পার্থক্য। যে সব প্রশ্ন অন্যান্য প্রাণীর জীবনে দেখা দেয় না, মানব-জীবনে তা অতি শৈশবেই দেখা দেয়। জীবন-প্রভাতেই মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে-আমি কোথা থেকে এলাম? কোথায় ছিলো আমার পূর্বের বাসস্থান? কোথায়ই বা আমি ফিরে যাবো? আমার চারদিকে যে সব বস্তু রয়েছে, ওরা আমার শত্রু না মিত্র? আমার সম্মুখে যে সব লোক মৃত্যুমুখে পতিত হলো, ওরা কোথায় গেলো?’

মানবীয় প্রয়োজন ও মানব প্রকৃতির ব্যাপক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে অধ্যক্ষ আজরফ আবিষ্কার করেন যে প্রকৃত ধর্মীয় চেতনা অজ্ঞতাপ্রসূত নয় অথবা সবল, ধনিক ও শোষক-শাসক কর্তৃক দুর্বল বা শোষিতদের জন্য সান্ত্বনা স্বরূপ উদ্ভাবিত কিছুও নয় বরং যথার্থ ধর্মীয় চেতনা আত্মসচেতন ও প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত সচ্ছল এবং শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ মানুষের মধ্যেই অধিক বিকশিত হয়। শোষণের কারণ প্রকৃত ধর্মীয় চেতনা নয়; বরং তার অভাব।

তবে এ কথা সত্যি যে বিভিন্ন যুগে ধর্মের নামে শোষণ-শাসন করা হয়েছে। এর কারণ হলো মানুষকে অন্যায় ও অসত্যের নামে শোষণ করা সহজ; অধিকাংশ ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। সেজন্য স্থান-কাল-পাত্র ভেদে ভালো কিছুর আড়ালেই অন্যায় ও অশুভ কিছু অর্জন করতে হয়। মানব মানসে ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে বলেই এ নাম ভাঙিয়ে মানুষের প্রতারণা করা যায়। এতে প্রকৃত ধর্মের দুর্বলতা নয় বরং শক্তিমত্তাই প্রমাণিত হয়। রাজনীতি ও শোষণ মুক্তির নামে যে প্রচুর অপকর্ম হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, তা আজ আর চোখ-কান খোলা মানুষদের বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। রাজনৈতিক দল, অর্থনৈতিক কর্মসূচি ও সাংস্কৃতিক চেতনা ও স্ফূর্তির নামে মানুষে মানুষে বিভিন্ন দেশে ও সময়ে কম বিভেদের সৃষ্টি করা হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা কেবল ধর্মীয় পরিচয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি-ভাষা অঞ্চল, গ্রোত্র, বর্ণ ও সমর্থে নারীপুরুষ বিচারে মানুষকে বিভিন্ন সময়ে খণ্ডিতভাবে দেখা হয়েছে এবং তাকে তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সেজন্য অধ্যক্ষ আজরফ মনে করেন যে ধর্মের বিপক্ষে যে শোষণ ও বিভেদের কথা বলা হয়, তার কারণ প্রকৃত ধর্মীয় চেতনা নয় বা এজন্য দায়ী সত্যিকার ধার্মিক ব্যক্তিরা নয় বরং একশ্রেণীর ধর্মব্যবসায়ী ও ধর্মের মুখোশ পরা স্বার্থান্বেষী মহল। সব ঐশী ও বড় ধর্মগুলোর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সেখানে মানবতার একটি কেন্দ্রীয় ভূমিকা ও গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। অন্যায়, অসত্য এ শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিটি ধর্মের সত্যিকার বীরেরা যুগে যুগে সংগ্রাম করে গেছেন।

প্রত্যাদিষ্ট ধর্মের শেষতম ও পূর্ণতম সংস্করণের ধারক ও বাহক হিসেবে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শিক্ষায় গতিশীল ও বাস্তব জীবনাদর্শ হিসেবে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় ইসলাম প্রচলিত অর্থে কেবল একটি ধর্ম নয়। প্রচলিত অর্থে ধর্ম হচ্ছে পারমার্থিক জীবনে মুক্তি লাভের জন্য মানুষ যে কতগুলো বিশ্বাস পোষণ করে এবং সে লক্ষ্যে কিছু আচার অনুষ্ঠান পালন করে, তার সমষ্টি। অন্য কথায়, ধর্ম মূলত মানুষ ও অতীন্দ্রিয় পরম শক্তি-সত্তার মধ্যে এক ধরনের বিশ্বাস ও আচরণগত সম্পর্ক বিশেষ। ইসলাম এ অর্থে কেবল একটি ধর্ম না হওয়ার কারণ হলো ইসলামে রয়েছে অসংখ্য রাজনৈতিক বিধানাবলি, নিজস্ব অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিস্তৃত নির্দেশ ও নির্দেশনা, যুদ্ধ-সন্ধি তথা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলনীতিসহ ইহজীবনের বাস্তব ও ব্যাপক পরিসরে কার্যকর করতে হবে এমন সব আইন-কানুন। অন্য কথায়, ইসলাম কেবল কতকগুলো বিমূর্ত নৈতিক ও আধ্যাত্মিক নির্দেশাবলির সমষ্টি নয়। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ যুক্তি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে এবং অভিজ্ঞতা ও স্বজ্ঞার সাহায্য নিয়ে, সর্বোপরি ঐশী জ্ঞানালোকে উদ্ভাসিত হয়ে ইসলামের এই ব্যাপক ও কল্যাণধর্মী রূপ আবিষ্কার করেন এবং সমকালীন মানুষের সামনে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে তা উপস্থাপন করতে প্রয়াসী হন। তাঁর বিপ্লবী গ্রন্থ ‘জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম’-এ এ ধারা প্রয়াস সহজেই লক্ষণীয়।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে কেবল বিমূর্ত তত্ত্বালোচনা বা উচ্চাঙ্গের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উচ্চারণের মাধ্যমেই কোনো আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এ জন্য বাস্তবে দরকার এমন সব রক্ত মাংসের মানুষের যারা নিজেদের জীবনে এ আদর্শের মূর্ত প্রতীক হবেন। অনেক সাধারণ মুসলমান এ ব্যাপারে এক ধরনের হতাশায় ভোগে। তারা ভাবে, রসুলুল্লাহ্ (সা.) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের পর এমন সব মানুষ কি আর পাওয়া যাবে! দেওয়ান আজরফ এ ধরনের চিন্তাধারাকে সঠিক মনে করেন না। তিনি বিভিন্ন যুগের ইসলামি কর্মতৎপরতার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, ইসলামের মধ্যে এমন শক্তি রয়েছে যা যে কোনো যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে ও চাহিদা মেটাতে সক্ষম। তিনি তাঁর 'Islamic Movement' ও 'ইসলাম আন্দোলন যুগে যুগে' গ্রন্থ দুটিতে দেখিয়েছেন কীভাবে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন দেশে ইসলামি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অসংখ্য মানুষ সংগ্রাম করেছে। এ বই দুটিতে তিনি এসব আন্দোলনের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল ইসলামি ভাবাদর্শ তথা তাদের কর্মসূচি ও নেতৃত্বের গুণাবলির মূল্যায়ন করেছেন, তাদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন এবং সফলতার লক্ষ্যে ইসলামের মর্মবাণী ও প্রাণসম্পদ থেকে আহরিত পথনির্দেশ সরবরাহ করেছেন। ইসলামের ইতিহাসে শোষণমুক্তির লক্ষ্যে নিবেদিতপ্রাণ একজন বীর সৈনিক হযরত আবুজর গিফারী (রা.)। তাঁর জীবন ও কর্মের বিশ্লেষণের মাধ্যমে (সত্যের সৈনিক আবুজর, ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি চরিত্র, Abu Dhar Gifari গ্রন্থত্রয় দ্রষ্টব্য) দেওয়ান আজরফ দেখিয়েছেন কেন এবং কীভাবে মদীনার সেই সাম্যবাদী ইসলামি সমাজের মধ্যে সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বীজ সংক্রমিত হয় এবং আস্তে আস্তে ইসলামি বিপ্লব বিশ্ববিপ্লবের পরিণতি লাভ করার আগেই মাঝপথে হারিয়ে যায়।

‘দর্শনের নানা প্রসঙ্গ’-এ তিনি তাঁর স্বভাবসুলভ সমন্বয়ী পদ্ধতিতে মানব প্রকৃতির সাথে যুক্ত দর্শনের কয়েকটি চিরায়ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং স্বীয় অভিজ্ঞতা যুক্তি, প্রজ্ঞা ও জ্ঞানালোকিত বিশ্বাসের আলোকে সেগুলোর সমাধান খুঁজেছেন। ‘জীবন দর্শনের পুনর্গঠন’ শীর্ষক গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান, ইতিহাস ও উচ্চতর প্রজ্ঞার আলোকে ইসলামকে একটি বিজয়ী আদর্শ হিসেবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেছেন।

একই সুর অন্যভাবে অনুরণিত হয়েছে তাঁর তমদ্দুনের বিকাশ, ইতিহাসের ধারা, Background of the Culture of Muslim Bengal, ইসলাম ও মানবতাবাদ, Philosophy of History, সন্ধানী দৃষ্টিতে ইসলাম প্রভৃতি গ্রন্থে।

আগেই উল্লেখ করেছি যে একটি প্রবন্ধের সীমিত পরিসরে অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের দর্শনের প্রতি এমনকি তাঁর দার্শনিক চিন্তার একটি দিকের প্রতিও সুবিচার করা সম্ভব নয়। সেজন্য নানা উঙ্গিত ও কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি যে তিনি যথার্থ অর্থেই একজন দার্শনিক, যিনি জীবন ও জগৎকে গভীর ও নির্মোহভাবে দেখতে প্রয়াস পেয়েছেন। উপরের আলোচনা থেকে আশা করি পাঠকের এ ধারণা হবে যে তিনি দর্শনচর্চায় ও জীবন রহস্য বুঝতে একদেশদর্শী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেননি বরং বিশ্বের বিভিন্ন দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতি থেকে তিনি উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন এবং এ সবের মধ্যে যেটুকু গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন, তার আলোকে স্বীয় বিশ্বাস ও উত্তরাধিকারকে সমৃদ্ধ করেছেন।

এখানে একটি কথা অনেকাংশে অপ্রাসঙ্গিক মনে হলেও বলা প্রয়োজন বোধ করি এবং সে কথাটি বলে প্রবন্ধ শেষ করবো। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বিশে শতাব্দীর প্রথম পর্বের একজন উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি এবং রাজনীতিবিদ হয়েও এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তির লক্ষ্যে ইসলামের প্রকৃত পালনবাদী রূপটি তাঁর ব্যাপক লেখালেখি ও বক্তৃতা-আলোচনার মাধ্যমে তুলে ধরেন। ভাবতে আশ্চর্য লাগে, তাঁর প্রজন্মের এবং তাঁর পর্যায়ের একজন মানুষের ঢাকায় কোনো নিজস্ব ঘরবাড়ি নেই। আজও তিনি ছেলের সাথে একটি ভাড়া করা বাসায় বসবাস করেন। আমি মনে করি, শতাব্দীর সাক্ষী এ জ্ঞানবৃদ্ধ আমাদের মাঝ থেকে চলে যাওয়ার পূর্বেই তাঁর সারা জীবনের জ্ঞানচর্চার স্বীকৃতিস্বরূপ অনতিবিলম্বে তাঁকে একটি সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়ে নিজেদের দায়মুক্ত ও ধন্য করা কর্তব্য।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত