খানের আখ্যান
মারুফ কামাল খান
দিল্লির লালকেল্লায় ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট শাহ্জাহান তার কাছে আসা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের দেখা দিতে এবং অভ্যর্থনা জানাতে একটি বিশেষ মহল নির্মাণ করেন। এর নাম দেন দেওয়ান-ই-খাস। দেওয়ান-ই-খাসের ছিল অনিন্দ্য সুন্দর নির্মাণ সৌকর্য। সম্রাট তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ও পারিষদবর্গ নিয়ে দিওয়ান-ই-খাসে বসতেন। যুবরাজ, শাহজাদা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিতদের সঙ্গে শলাপরামর্শ এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় অত্যন্ত গোপনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এখানে। পুরো প্রাসাদের এটিই ছিল সবচেয়ে জাঁকজমক ও অলংকারপূর্ণ মহল। এর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতো ‘নহর-ই-বেহেশত’ বা স্বর্গীয় প্রস্রবণ। শ্বেতপাথরের তৈরি প্রাসাদের দরবার কক্ষটির সামনে মূল্যবান পাথরে সোনার হরফে লেখা ছিল : ‘আগার ফেরদৌস বার রুয়ে জামিনাস্ত। হামিনাস্ত-ও হামিনাস্ত-ও হামিনাস্ত।’ ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের ইন্দো-পার্সিয়ান সুফি গায়ক, সংগীতজ্ঞ, কবি এবং পণ্ডিত আমির খসরু ওই ফারসি বয়েত রচনা করেছিলেন। তার পুরো নাম ছিল আবুল হাসান ইয়ামিনউদ্দিন খসরু। আমির খসরু নামে সমধিক পরিচিত কবির ওই কাব্যকণিকার বাংলা অর্থ হলো : ‘এ ধরায় স্বর্গ যদি থাকে কোনোখানে- এখানেই, এখানেই, তাহা এইখানে।’
আমির খসরুর এই বয়েত দেওয়ান-ই-খাসের সৌন্দর্য ও মহিমা কীর্তনের জন্য সম্রাট শাহ্জাহান ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এটি রচিত হয়েছিল দেওয়ান-ই-খাস নির্মিত হওয়ার অন্ততপক্ষে ৩৫০ বছর আগে। কাশ্মীরের অনুপম নিসর্গ শোভা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ফারসি ভাষায় এই অমর দ্বিপদী কবিতা বা কাপলেট রচনা করেছিলেন। সত্যিই কাশ্মীর এই দুনিয়ার ফেরদৌস বা ভূস্বর্গই বটে। পৃথিবীর সব রূপ-সৌন্দর্য যেন ভিড় করেছে এখানে। ছুটে এসেছে প্রকৃতির রূপের সব অনুষঙ্গ। প্রকৃতির প্রতিটি বিচিত্র স্বাদের অলংকার দিয়ে সাজানো এ ভূস্বর্গ। একটা সময় কাশ্মীর শব্দটি ভৌগোলিকভাবে শুধু বিশাল হিমালয় এবং পিরপাঞ্জাল পর্বতমালার উপত্যকাকে নির্দেশনা করা হতো। আজ কাশ্মীর বলতে বোঝায় একটি বিশাল অঞ্চল, যা ভারতশাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর,পাকিস্তানশাসিত গিলগিট-বালতিস্তান এবং আজাদ কাশ্মীর প্রদেশ এবং চীনশাসিত আকসাই চীন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্রাক্ট অঞ্চলগুলো নিয়ে গঠিত। কাশ্মীরে পর্যটকদের চোখ জুড়ায় শ্রীনগর, পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ ও কাটরা এলাকা। প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার ব্যাপ্ত বানিহাল টানেলের আগে রয়েছে বেশ কিছু হিমবাহ অঞ্চল। সেখান থেকে পাড়ি দিলেই আশ্চর্য এক সবুজে ঢাকা কাশ্মীরের দেখা মিলবে। বনগুলো সেজে আছে পপলার ও উইলো গাছে। আর আছে সবুজ শস্যক্ষেত। সবুজ গাছের ফাঁকে নীল আকাশ। দূরে রুক্ষ পাহাড়, নিশ্চুপ উপত্যকা। আর মাইলের পর মাইল পাহাড় টপকেই কাশ্মীর। রোমান্টিক স্বপ্নের ভূস্বর্গ। স্বপ্নরাজ্য। কাশ্মীরের রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। স্বচ্ছজলের নদী, উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়, বনভূমি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মানুষজনÑ সব মিলিয়ে অনন্য সংযোজন এখানে। রয়েছে পিরপাঞ্জাল গিরিশৃঙ্গ তার অন্যদিকেই কারাকোরাম নাঙ্গা পর্যন্ত। আর তার আড়ালে কাশ্মীর। গোলাপি, সাদা রঙের সরষে আর পপি ফুলে সারা গ্রীষ্ম ঝলমল করে। প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা নিশাত, শালিমার, হারওয়ান, মুঘল গার্ডেন এবং চশমাশাহি দেখতে ভিড় করেন কাশ্মীরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তুষারপাতের কারণে পর্যটকদের কাছে আলাদা কদর আছে কাশ্মীরের।
পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনগুলো হারিয়ে যায়নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মীরি সুফিবাদের।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ—শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে কিনে নেন এবং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার বংশধররা ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় অঞ্চলটি একটি বিবদমান অঞ্চলে পরিণত হয়।
কাশ্মীর উপত্যকায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগুরু, শতকরা ৭৭ ভাগ। ফলে এ অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ধারণা ছিল। কিন্তু তখনকার হিন্দু শাসক রাজা হরি সিংয়ের তাতে ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু তিনি কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করতে চাইলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীরা তা মেনে নেবে না বলে তিনি সময়ক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ছিল কাশ্মীরের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। তিনি কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত ব্রাহ্মণ ছিলেন। পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত না হলে নেহরু নিজ দেশে বহিরাগত বলে পরিচিত হতেন। তাই তিনি কাশ্মীর নিয়ে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে গোপনে ঘোঁট পাকান। তাকে এ কাজে সহায়তা করেন ভারতবর্ষের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জম্মু প্রদেশে উগ্রপন্থি হিন্দু ও শিখরা ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে’র (আরএসএস) পরিচালনায় এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার ও রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রায় প্রায় এক লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। এই গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জম্মু প্রদেশের জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাত হ্রাস করা।
পাকিস্তান তখনো ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন বা অধিরাজ্য। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল। তিনি কাশ্মীর অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেন পাকিস্তানের সি-ইন-সি জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার মেসার্ভিকে। এই নির্দেশনা ও সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতির খবর ফাঁস হয়ে পৌঁছে যায় ভারতীয় সি-ইন-সি জেনারেল স্যার রবার্ট ম্যাকগ্রেগর ম্যাকডোনাল্ড লকহার্টের কাছে। তিনি দ্রুত তা জানিয়ে দেন মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুকে। জেনে যান রাজা হরি সিংও। তিনি কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করতে মাউন্টব্যাটেনের সাহায্য চান। এ খবর চাউর হলে হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুসলমান অধিবাসীদের বিদ্রোহ। তাদের সমর্থনে পাঠান উপজাতিরা এসে যোগ দেয়। এই বিদ্রোহের ছত্রছায়ার পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ একদল প্রশিক্ষিত আধাসামরিক রেঞ্জারকে কাশ্মীর অধিকারের জন্য পাঠান। এই পরিস্থিতিতে হরি সিং জম্মুতে পালিয়ে যান এবং কাশ্মীর অধিকার করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য চান।
ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে এলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে কাশ্মীরের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। বাকি অংশ ভারতের অধিকারে চলে যায়। ১৯৪৭ ও ৪৮ সালে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পরপর দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরপর জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করে। তারা প্রস্তাব করে কাশ্মীরের জনগণ একটি গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে, তারা স্বাধীন হবে নাকি ভারত কিংবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই এ প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ভারত কখনোই কাশ্মীরে গণভোট হতে দেয়নি। তারা রাজা হরি সিংয়ের পুত্র ড. করণ সিংকে ভারত-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে সদরে রিয়াসত নিযুক্ত করে। কাশ্মীরের জনপ্রিয় নেতা, স্থানীয় ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টির প্রধান এবং নেহরুর বন্ধু শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য চালাতে থাকে।
রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে ভারত যে চুক্তি করে তাতে জম্মু-কাশ্মীর একটি বিশেষ মর্যাদা ও অধিকারপ্রাপ্ত স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের স্বীকৃতি পায়। এরপর শুরু হয় ভারতের কূটকৌশল ও চুক্তি ভঙ্গ। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন কাটছাঁট করা শুরু হয়। উপত্যকার জনগণের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। বন্ধু প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চুক্তিভঙ্গের বেদনায় ম্লান হয়ে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের পদস্থ কর্মকর্তারা তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর শেখ আবদুল্লাহ চৌ এন লাইয়ের সঙ্গেও দেখা করেন। পাকিস্তান সফরে গিয়েও তিনি বীরোচিত সংবর্ধনা পান। এসব ঘটনায় নয়াদিল্লি তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রিয় বন্ধু নেহরু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করে তাকে জেলে পাঠান। টানা ১০ বছর জেল খেটে রণক্লান্ত শেখ কারামুক্ত হয়ে এক ধরনের আত্মসমর্পণ করেন। নেহরুর বাসায় গিয়ে তিনি কিছু শর্তসাপেক্ষে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসতে রাজি হন। এরপরের নির্বাচনে তিনি ফের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য সরকারের প্রধান নির্বাচিত হন। তবে তার পদবি প্রধানমন্ত্রী থেকে হয়ে যায় মুখ্যমন্ত্রী। ততদিনে তিনি নিজের ও রাজ্যের মর্যাদা রক্ষার লড়াই অব্যাহত রাখার শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন।
নেহরু ও শেখ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর জম্মু-কাশ্মীরের মর্যাদা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হতে থাকে। তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও স্বাধীনতার চেতনা বাড়তে থাকে। বিদ্রোহ-বিক্ষোভ দমনে নয়াদিল্লি জম্মু-কাশ্মীরে এক ধরনের সেনাশাসন জারি করে। ভারতীয় বাহিনী হত্যা ও জুলুম-পীড়ন চালিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্তব্ধ করে দিতে চায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় উপত্যকাজুড়ে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই। বিভিন্ন সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন গড়ে ওঠে। ভারতের চোখে ও প্রচারণায় তারা জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাদের মদত দেওয়ার অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে। কোনো সুরাহা হয়নি।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নেয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হলে সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি ভারতের হাতে আটক হয়। এদের ছাড়াতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তি করতে বাধ্য হয়। সেই চুক্তিতে পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ইস্যুর বদলে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ বলে মেনে নেয়। ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ উপেক্ষা করে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে। ওই ধারায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এরপর থেকেই ভারত অধিকৃত কাশ্মীর এক বন্দি উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। সেখানে চলছে সেনা-পুলিশের জবরদস্তির সভ্যতাহীন শাসন। অস্ত্রের ভাষায় দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব দাবি। রক্তের বন্যায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি চলছে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করে দুনিয়াজোড়া ভারতীয় প্রোপাগান্ডা।
এরই মধ্যে অধিকৃত কাশ্মীরের পর্যটক আকর্ষণের
অন্যতম কেন্দ্র পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ওই হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদত ছিল বলে ভারত অভিযোগ তোলে। যদিও ভারতের ভেতরেই কোনো কোনো মহল ওই হামলাকে ভারত সরকারেরই পরিকল্পিত ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন বলে অভিহিত করে। কিন্তু ভারত তার বায়বীয় অভিযোগের ভিত্তিতেই ৬ মে রাতের অন্ধকারে আজাদ কাশ্মীর ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তত ছয়টি স্পটে হামলা চালায়। এসব হামলায় মসজিদ ও ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়। বেশ কিছু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ভারতীয় হামলা রোধে পাকিস্তান কয়েকটি পয়েন্টে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে গুলি ছোড়ে এবং ফ্রান্সে তৈরি অত্যাধুনিক রাফালসহ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার এই সংঘাত খুবই আতঙ্কের। এই যুদ্ধ থামবে নাকি আরো বিপজ্জনক দিকে মোড় নেবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
অশোকের সময়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মজ্জান্তিকা কাশ্মীরে গিয়ে পরম ধর্ম হিসেবে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। ক্ষমার অবতার যিশু এই ভূস্বর্গে এসেছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। এখানকার হজরতবাল দরগাহ ও মসজিদে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কেশদাম সংরক্ষিত রয়েছে। যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ ইসলামের শান্তিবাদী সুফি ধারার অনুসারী। দরিদ্র ভোজন বা লঙ্গরের উদ্ভাবক, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের স্মৃতিধন্য এই ভূস্বর্গ কাশ্মীর। সেই শান্তির উপত্যকায় আর কত রক্ত ঝরবে, বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হবে? আর কতদিন কাশ্মীরের সুন্দর, সুশ্রী, শান্তিবাদী মানুষ বুটের তলায় পিষ্ট হবে? আজ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এ যুদ্ধ যেন দ্রুত থেমে যায়। প্রার্থনা করি, এই ঘটনাপ্রবাহ যেন কাশ্মীরকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। যেন এ দশকই কাশ্মীর উপত্যকার মুক্তির দশক হয়ে ওঠে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
দিল্লির লালকেল্লায় ১৬৪৮ খ্রিষ্টাব্দে মোগল সম্রাট শাহ্জাহান তার কাছে আসা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের দেখা দিতে এবং অভ্যর্থনা জানাতে একটি বিশেষ মহল নির্মাণ করেন। এর নাম দেন দেওয়ান-ই-খাস। দেওয়ান-ই-খাসের ছিল অনিন্দ্য সুন্দর নির্মাণ সৌকর্য। সম্রাট তার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন ও পারিষদবর্গ নিয়ে দিওয়ান-ই-খাসে বসতেন। যুবরাজ, শাহজাদা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিতদের সঙ্গে শলাপরামর্শ এবং প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় অত্যন্ত গোপনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো এখানে। পুরো প্রাসাদের এটিই ছিল সবচেয়ে জাঁকজমক ও অলংকারপূর্ণ মহল। এর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হতো ‘নহর-ই-বেহেশত’ বা স্বর্গীয় প্রস্রবণ। শ্বেতপাথরের তৈরি প্রাসাদের দরবার কক্ষটির সামনে মূল্যবান পাথরে সোনার হরফে লেখা ছিল : ‘আগার ফেরদৌস বার রুয়ে জামিনাস্ত। হামিনাস্ত-ও হামিনাস্ত-ও হামিনাস্ত।’ ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকের ইন্দো-পার্সিয়ান সুফি গায়ক, সংগীতজ্ঞ, কবি এবং পণ্ডিত আমির খসরু ওই ফারসি বয়েত রচনা করেছিলেন। তার পুরো নাম ছিল আবুল হাসান ইয়ামিনউদ্দিন খসরু। আমির খসরু নামে সমধিক পরিচিত কবির ওই কাব্যকণিকার বাংলা অর্থ হলো : ‘এ ধরায় স্বর্গ যদি থাকে কোনোখানে- এখানেই, এখানেই, তাহা এইখানে।’
আমির খসরুর এই বয়েত দেওয়ান-ই-খাসের সৌন্দর্য ও মহিমা কীর্তনের জন্য সম্রাট শাহ্জাহান ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু এটি রচিত হয়েছিল দেওয়ান-ই-খাস নির্মিত হওয়ার অন্ততপক্ষে ৩৫০ বছর আগে। কাশ্মীরের অনুপম নিসর্গ শোভা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তিনি ফারসি ভাষায় এই অমর দ্বিপদী কবিতা বা কাপলেট রচনা করেছিলেন। সত্যিই কাশ্মীর এই দুনিয়ার ফেরদৌস বা ভূস্বর্গই বটে। পৃথিবীর সব রূপ-সৌন্দর্য যেন ভিড় করেছে এখানে। ছুটে এসেছে প্রকৃতির রূপের সব অনুষঙ্গ। প্রকৃতির প্রতিটি বিচিত্র স্বাদের অলংকার দিয়ে সাজানো এ ভূস্বর্গ। একটা সময় কাশ্মীর শব্দটি ভৌগোলিকভাবে শুধু বিশাল হিমালয় এবং পিরপাঞ্জাল পর্বতমালার উপত্যকাকে নির্দেশনা করা হতো। আজ কাশ্মীর বলতে বোঝায় একটি বিশাল অঞ্চল, যা ভারতশাসিত রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীর,পাকিস্তানশাসিত গিলগিট-বালতিস্তান এবং আজাদ কাশ্মীর প্রদেশ এবং চীনশাসিত আকসাই চীন এবং ট্রান্স-কারাকোরাম ট্রাক্ট অঞ্চলগুলো নিয়ে গঠিত। কাশ্মীরে পর্যটকদের চোখ জুড়ায় শ্রীনগর, পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ ও কাটরা এলাকা। প্রায় সোয়া দুই কিলোমিটার ব্যাপ্ত বানিহাল টানেলের আগে রয়েছে বেশ কিছু হিমবাহ অঞ্চল। সেখান থেকে পাড়ি দিলেই আশ্চর্য এক সবুজে ঢাকা কাশ্মীরের দেখা মিলবে। বনগুলো সেজে আছে পপলার ও উইলো গাছে। আর আছে সবুজ শস্যক্ষেত। সবুজ গাছের ফাঁকে নীল আকাশ। দূরে রুক্ষ পাহাড়, নিশ্চুপ উপত্যকা। আর মাইলের পর মাইল পাহাড় টপকেই কাশ্মীর। রোমান্টিক স্বপ্নের ভূস্বর্গ। স্বপ্নরাজ্য। কাশ্মীরের রূপ সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। স্বচ্ছজলের নদী, উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা পাহাড়, বনভূমি, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মানুষজনÑ সব মিলিয়ে অনন্য সংযোজন এখানে। রয়েছে পিরপাঞ্জাল গিরিশৃঙ্গ তার অন্যদিকেই কারাকোরাম নাঙ্গা পর্যন্ত। আর তার আড়ালে কাশ্মীর। গোলাপি, সাদা রঙের সরষে আর পপি ফুলে সারা গ্রীষ্ম ঝলমল করে। প্রতিবছর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা নিশাত, শালিমার, হারওয়ান, মুঘল গার্ডেন এবং চশমাশাহি দেখতে ভিড় করেন কাশ্মীরে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং তুষারপাতের কারণে পর্যটকদের কাছে আলাদা কদর আছে কাশ্মীরের।
পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ববর্তী সময়ে কাশ্মীর প্রথমে হিন্দুধর্ম এবং পরে বৌদ্ধধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরে নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈব মতবাদের উত্থান ঘটে। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তার ঘটে এবং শৈব মতবাদের প্রভাব হ্রাস পায়। কিন্তু তাতে পূর্ববর্তী সভ্যতাগুলোর অর্জনগুলো হারিয়ে যায়নি, বরং নবাগত ইসলামি রাজনীতি ও সংস্কৃতি এগুলোকে বহুলাংশে অঙ্গীভূত করে নেয়, যার ফলে জন্ম হয় কাশ্মীরি সুফিবাদের।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত হন এবং শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তী পাঁচ শতাব্দীব্যাপী কাশ্মীরে মুসলিম শাসন বজায় ছিল। এর মধ্যে মুঘল সম্রাটরা ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত এবং আফগান দুররানী সম্রাটরা ১৭৪৭ থেকে ১৮১৯ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। ১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ—শিখ যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে শিখরা পরাজিত হয়। এরপর অমৃতসর চুক্তি অনুসারে জম্মুর রাজা গুলাব সিংহ অঞ্চলটি ব্রিটিশদের কাছে থেকে কিনে নেন এবং কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত তার বংশধররা ব্রিটিশ রাজমুকুটের অনুগত শাসক হিসেবে কাশ্মীর শাসন করেন। ১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগের সময় অঞ্চলটি একটি বিবদমান অঞ্চলে পরিণত হয়।
কাশ্মীর উপত্যকায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগুরু, শতকরা ৭৭ ভাগ। ফলে এ অঞ্চল স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে বলে ধারণা ছিল। কিন্তু তখনকার হিন্দু শাসক রাজা হরি সিংয়ের তাতে ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু তিনি কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করতে চাইলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসীরা তা মেনে নেবে না বলে তিনি সময়ক্ষেপণের কৌশল গ্রহণ করেন। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর ছিল কাশ্মীরের প্রতি বিশেষ দুর্বলতা। তিনি কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত ব্রাহ্মণ ছিলেন। পূর্বপুরুষের স্মৃতিবিজড়িত কাশ্মীর উপত্যকা ভারতের অন্তর্ভুক্ত না হলে নেহরু নিজ দেশে বহিরাগত বলে পরিচিত হতেন। তাই তিনি কাশ্মীর নিয়ে রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে গোপনে ঘোঁট পাকান। তাকে এ কাজে সহায়তা করেন ভারতবর্ষের শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে জম্মু প্রদেশে উগ্রপন্থি হিন্দু ও শিখরা ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘে’র (আরএসএস) পরিচালনায় এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সরকার ও রাজকীয় সৈন্যবাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রায় প্রায় এক লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। এই গণহত্যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জম্মু প্রদেশের জনসংখ্যায় মুসলিমদের অনুপাত হ্রাস করা।
পাকিস্তান তখনো ব্রিটিশ ডোমিনিয়ন বা অধিরাজ্য। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ গভর্নর জেনারেল। তিনি কাশ্মীর অধিগ্রহণের উদ্দেশ্যে সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানোর নির্দেশ দেন পাকিস্তানের সি-ইন-সি জেনারেল স্যার ফ্রাঙ্ক ওয়াল্টার মেসার্ভিকে। এই নির্দেশনা ও সেনা মোতায়েনের প্রস্তুতির খবর ফাঁস হয়ে পৌঁছে যায় ভারতীয় সি-ইন-সি জেনারেল স্যার রবার্ট ম্যাকগ্রেগর ম্যাকডোনাল্ড লকহার্টের কাছে। তিনি দ্রুত তা জানিয়ে দেন মাউন্টব্যাটেন ও নেহরুকে। জেনে যান রাজা হরি সিংও। তিনি কাশ্মীরকে ভারতভুক্ত করতে মাউন্টব্যাটেনের সাহায্য চান। এ খবর চাউর হলে হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে শুরু হয় মুসলমান অধিবাসীদের বিদ্রোহ। তাদের সমর্থনে পাঠান উপজাতিরা এসে যোগ দেয়। এই বিদ্রোহের ছত্রছায়ার পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ একদল প্রশিক্ষিত আধাসামরিক রেঞ্জারকে কাশ্মীর অধিকারের জন্য পাঠান। এই পরিস্থিতিতে হরি সিং জম্মুতে পালিয়ে যান এবং কাশ্মীর অধিকার করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহায্য চান।
ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে এলে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে তাদের যুদ্ধ বাধে। এ যুদ্ধে কাশ্মীরের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। বাকি অংশ ভারতের অধিকারে চলে যায়। ১৯৪৭ ও ৪৮ সালে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে পরপর দুটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এরপর জাতিসংঘ হস্তক্ষেপ করে। তারা প্রস্তাব করে কাশ্মীরের জনগণ একটি গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করবে, তারা স্বাধীন হবে নাকি ভারত কিংবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে। পাকিস্তান ও ভারত উভয়েই এ প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ভারত কখনোই কাশ্মীরে গণভোট হতে দেয়নি। তারা রাজা হরি সিংয়ের পুত্র ড. করণ সিংকে ভারত-অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরে সদরে রিয়াসত নিযুক্ত করে। কাশ্মীরের জনপ্রিয় নেতা, স্থানীয় ন্যাশনাল কনফারেন্স পার্টির প্রধান এবং নেহরুর বন্ধু শেখ আবদুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী করে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্য চালাতে থাকে।
রাজা হরি সিংয়ের সঙ্গে ভারত যে চুক্তি করে তাতে জম্মু-কাশ্মীর একটি বিশেষ মর্যাদা ও অধিকারপ্রাপ্ত স্বায়ত্তশাসিত রাজ্যের স্বীকৃতি পায়। এরপর শুরু হয় ভারতের কূটকৌশল ও চুক্তি ভঙ্গ। ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে পর্যায়ক্রমে জম্মু-কাশ্মীর বিশেষ মর্যাদা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন কাটছাঁট করা শুরু হয়। উপত্যকার জনগণের মধ্যে ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। বন্ধু প্রধানমন্ত্রী নেহরুর চুক্তিভঙ্গের বেদনায় ম্লান হয়ে শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের স্বাধীনতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। যুক্তরাষ্ট্রের পদস্থ কর্মকর্তারা তার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পর শেখ আবদুল্লাহ চৌ এন লাইয়ের সঙ্গেও দেখা করেন। পাকিস্তান সফরে গিয়েও তিনি বীরোচিত সংবর্ধনা পান। এসব ঘটনায় নয়াদিল্লি তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। প্রিয় বন্ধু নেহরু রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় গ্রেপ্তার করে তাকে জেলে পাঠান। টানা ১০ বছর জেল খেটে রণক্লান্ত শেখ কারামুক্ত হয়ে এক ধরনের আত্মসমর্পণ করেন। নেহরুর বাসায় গিয়ে তিনি কিছু শর্তসাপেক্ষে কাশ্মীরের স্বাধীনতার দাবি থেকে সরে আসতে রাজি হন। এরপরের নির্বাচনে তিনি ফের জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য সরকারের প্রধান নির্বাচিত হন। তবে তার পদবি প্রধানমন্ত্রী থেকে হয়ে যায় মুখ্যমন্ত্রী। ততদিনে তিনি নিজের ও রাজ্যের মর্যাদা রক্ষার লড়াই অব্যাহত রাখার শক্তি-সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন।
নেহরু ও শেখ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর জম্মু-কাশ্মীরের মর্যাদা, অধিকার ও স্বায়ত্তশাসন ধীরে ধীরে ক্ষীয়মাণ হতে থাকে। তরুণদের মধ্যে ক্ষোভ ও স্বাধীনতার চেতনা বাড়তে থাকে। বিদ্রোহ-বিক্ষোভ দমনে নয়াদিল্লি জম্মু-কাশ্মীরে এক ধরনের সেনাশাসন জারি করে। ভারতীয় বাহিনী হত্যা ও জুলুম-পীড়ন চালিয়ে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা স্তব্ধ করে দিতে চায়। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় উপত্যকাজুড়ে স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই। বিভিন্ন সশস্ত্র গেরিলা সংগঠন গড়ে ওঠে। ভারতের চোখে ও প্রচারণায় তারা জঙ্গি ও বিচ্ছিন্নতাবাদী। তাদের মদত দেওয়ার অভিযোগ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এই কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে। কোনো সুরাহা হয়নি।
১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত মিত্রবাহিনী হিসেবে অংশ নেয় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। সে যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হলে সামরিক, আধাসামরিক ও পুলিশ মিলিয়ে প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি ভারতের হাতে আটক হয়। এদের ছাড়াতে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সিমলা চুক্তি করতে বাধ্য হয়। সেই চুক্তিতে পাকিস্তান কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ইস্যুর বদলে দ্বিপক্ষীয় বিরোধ বলে মেনে নেয়। ২০১৯ সালে বিজেপি সরকার সব প্রতিবাদ-বিক্ষোভ উপেক্ষা করে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বিলোপ করে। ওই ধারায় কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা নিশ্চিত করা হয়েছিল। এরপর থেকেই ভারত অধিকৃত কাশ্মীর এক বন্দি উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। সেখানে চলছে সেনা-পুলিশের জবরদস্তির সভ্যতাহীন শাসন। অস্ত্রের ভাষায় দমিয়ে দেওয়া হচ্ছে সব দাবি। রক্তের বন্যায় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি চলছে স্বাধীনতাকামী মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রিত করে দুনিয়াজোড়া ভারতীয় প্রোপাগান্ডা।
এরই মধ্যে অধিকৃত কাশ্মীরের পর্যটক আকর্ষণের
অন্যতম কেন্দ্র পেহেলগামে এক সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন পর্যটক নিহত হয়। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই ওই হামলার পেছনে পাকিস্তানের মদত ছিল বলে ভারত অভিযোগ তোলে। যদিও ভারতের ভেতরেই কোনো কোনো মহল ওই হামলাকে ভারত সরকারেরই পরিকল্পিত ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন বলে অভিহিত করে। কিন্তু ভারত তার বায়বীয় অভিযোগের ভিত্তিতেই ৬ মে রাতের অন্ধকারে আজাদ কাশ্মীর ও পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্তত ছয়টি স্পটে হামলা চালায়। এসব হামলায় মসজিদ ও ঘরবাড়ির ক্ষতি হয়। বেশ কিছু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়। ভারতীয় হামলা রোধে পাকিস্তান কয়েকটি পয়েন্টে ভারতীয় লক্ষ্যবস্তুতে গুলি ছোড়ে এবং ফ্রান্সে তৈরি অত্যাধুনিক রাফালসহ কয়েকটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে। দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক শক্তিধর দুটি প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার এই সংঘাত খুবই আতঙ্কের। এই যুদ্ধ থামবে নাকি আরো বিপজ্জনক দিকে মোড় নেবে, তা এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
অশোকের সময়ে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী মজ্জান্তিকা কাশ্মীরে গিয়ে পরম ধর্ম হিসেবে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। ক্ষমার অবতার যিশু এই ভূস্বর্গে এসেছিলেন বলেও জনশ্রুতি আছে। এখানকার হজরতবাল দরগাহ ও মসজিদে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র কেশদাম সংরক্ষিত রয়েছে। যেখানকার বেশিরভাগ মানুষ ইসলামের শান্তিবাদী সুফি ধারার অনুসারী। দরিদ্র ভোজন বা লঙ্গরের উদ্ভাবক, শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের স্মৃতিধন্য এই ভূস্বর্গ কাশ্মীর। সেই শান্তির উপত্যকায় আর কত রক্ত ঝরবে, বারুদের ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত হবে? আর কতদিন কাশ্মীরের সুন্দর, সুশ্রী, শান্তিবাদী মানুষ বুটের তলায় পিষ্ট হবে? আজ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, এ যুদ্ধ যেন দ্রুত থেমে যায়। প্রার্থনা করি, এই ঘটনাপ্রবাহ যেন কাশ্মীরকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়। যেন এ দশকই কাশ্মীর উপত্যকার মুক্তির দশক হয়ে ওঠে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক
ই-মেইল : mrfshl@gmail.com
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর এখন বছর অতিক্রান্ত হয়নি। এর মধ্যে ফ্যাসিবাদের সফট পাওয়ারগুলো সরব হয়ে উঠেছে।
১৮ ঘণ্টা আগেকবি ও গীতিকার কাইফি আজমি সিনেমার গান লেখার একটা অদ্ভুত পদ্ধতির কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে এই পদ্ধতির বেশ মিল আছে।
১৮ ঘণ্টা আগেপৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ, যে দেশটির সঙ্গে তার সব প্রতিবেশীর সম্পর্ক তিক্ততায় ভরা। শুধু তা-ই নয়, ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার এমন একটি ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে, যার অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হচ্ছে সংঘাতপূর্ণ দক্ষিণ এশিয়া।
২ দিন আগেফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস গত মাসে দেওয়া এক ভাষণে হামাসের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগঠনটির সদস্যদের ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দেন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ওই ভাষণে তিনি অবিলম্বে হামাসকে অস্ত্র সমর্পণ করার এবং অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার দাবি জানান।
২ দিন আগে