যে কারণে হিংসার আগুনে পুড়লেন তিনি

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫৫
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ০১

এত নির্যাতন করার পরও তিনি একবারের জন্যও শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করলেন না। যখন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল প্রশ্ন করলেন, আপনার রাগ হয় না? উত্তরে শুধু তিনি বললেন, রাগ করে কী হবে, আল্লাকে বলি। কি নিদারুণ এক মর্মবেদনা নিয়ে বেগম খালেদা জিয়া এ কথাটা বললেন। কিন্তু এত কষ্টের পরও শেখ হাসিনার হৃদয়হীনতার বিপরীতে তিনি যে উদারতা দেখিয়েছেন, তা উচ্চ নৈতিকতার পরিচয় বহন করে, যা সব মানুষকে মুগ্ধ করেছে।

অথচ এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে তার পড়ার কথা ছিল না। কারণ তিনি তো কোনো সাধারণ মহিলা নন। তিনি বেগম খালেদা জিয়া। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। শুধু তা-ই নয়, তিনি একাধারে স্বাধীনতার ঘোষক, বীরউত্তম, সেনাপ্রধান ও রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। মর্যাদায়, সম্মানে তিনি অনেক ওপরে। তবু তাকে নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের শিকার হতে হলো।

বিজ্ঞাপন

মিথ্যা মামলায় হয়েছেন কারারুদ্ধ। বিদেশে একটু ভালো চিকিৎসার আবেদনকেও ঘৃণা ও অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। কিন্তু কেন এই নির্মমতা? কেন এই নিষ্ঠুর আচরণ? শুধু কি এ কারণেই যে, তিনি ক্ষমতার প্রধান চ্যালেঞ্জার। নাকি শেখ হাসিনা তার বাবার ইমেজ ছাপিয়ে অন্য কারো ইমেজ প্রতিষ্ঠিত থাকুক, তা চান না বলেই খালেদা জিয়ার ওপর নিপীড়নের এই স্টিমরোলার।

কারণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে শেখ মুজিবুর রহমানের ইমেজের বিপরীতে জিয়াউর রহমানের এই নন্দিত ইমেজকে শেখ হাসিনা হয়তো কখনোই মেনে নিতে পারেননি। আর জিয়ার সেই নন্দিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তরাধিকার তো খালেদা খালেদা জিয়া। মূলত সে জন্যই কি এই নিষ্ঠুরতা? বলা যায় হিংসার আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা!

পাঠক, অনেকেরই এটা মনে আছে, একজন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা একটা রায়ে উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অনেকেরই অবদান আছে’, শুধু এটুকুতেই তার কি করুণ পরিণতিই না হয়েছিল! বাংলাদেশের ইতিহাসে সেই প্রথম একজন প্রধান বিচারপতি যাকে ওইটুকু মন্তব্যের অপরাধে জোরপূর্বক পদত্যাগ করিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

মূলত এটা ছিল ব্যক্তি পূজার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসনকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা। এ ধরনের উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দেশের জন্য অবদান রাখা অন্য সবার অবদান ও গৌরবকে কুক্ষিগত করে একজনকে মহান করা। তাই প্রধান বিচারপতি সিনহা আরো অনেকের অবদানের কথা বলায় তাকে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ভোগ করতে হয়েছিল।

সুতরাং জিয়াউর রহমানের বিশাল জনপ্রিয়তা ধারণকারী খালেদা জিয়াকে সহ্য করা সত্যি শেখ হাসিনার জন্য খুবই কঠিন কাজ। অথচ বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানব ইতিহাসজুড়েই একটা অগ্রসর বিরুদ্ধবিশ্বাস পূর্বতন বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ করে থাকে। যেমন করে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) বিরুদ্ধবিশ্বাস মুসলিম লীগকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।

আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথমে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং পরে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) বিরুদ্ধবিশ্বাস আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করেছে। কিন্তু জাসদের বিরুদ্ধবিশ্বাস যৌক্তিক রাজনৈতিক সমীকরণ দাঁড় করাতে ব্যর্থ হওয়ায় পরে শক্তিশালী বিরুদ্ধবিশ্বাস হিসেবে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে যায় বিএনপি। শুধু তাই নয় খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার হিসেবে তার পুত্র তারেক রহমানও ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত। সুতরাং মা ও পুত্রকে একই সঙ্গে সাজা দিয়ে গোটা জিয়া পরিবার ও বিএনপিকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, যাকে সুচিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে দেওয়া হয়নি, যাকে দয়া দেখানোর কথা বলে কারাগার থেকে বের করে গৃহে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল, তিনি আজ মুক্ত বাতাসে, মুক্ত মনে ব্রিটেনে চিকিৎসাধীন। আর যিনি দয়া ও করুণার কথা বলে নিজেকে সব ক্ষমতার আধার ভাবতেন, তিনি আজ জনরোষের ভয়ে পালিয়ে ভারতের করুণায় আশ্রিত।

আমি অনেক বছর ধরে খুব কাছে থেকে খালেদা জিয়াকে দেখে আসছি। দেশপ্রেমের অসাধারণ এক প্রতীক তিনি। ব্যক্তিজীবনে তিনি হিসাবি এবং কখনোই দুর্নীতিগ্রস্ত নন। আর এই হিসাবটা তিনি করতে শিখেছিলেন স্বামী জিয়াউর রহমানের সীমিত আয়ে সংসার চালানোর হিমশিম খাওয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ জিয়াউর রহমান মাসিক বেতনের ভেতর দিয়েই চলতেন। একবার তিনি সাংবাদিক নেতাদের চায়ের দাওয়াত দিয়েছিলেন। চায়ের সঙ্গে খেতে দিয়েছিলেন চালভাজা।

আরেক ডিনারে টেবিলে ছিল কচুর লতি ও কাঁচকি মাছ। এটার মধ্যে কোনো প্রদর্শনীবৃত্ত ছিল না। এ রকম একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন খালেদা জিয়াকে রাষ্ট্র পরিচালনায়ও হিসাবি করে তুলছিল। তাই পোশাক-আশাকে আভিজাত্য বজায় রাখলেও অন্যদের মতো তিনি দুর্নীতি করে নিজে কিংবা পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজনদের দেশ-বিদেশে অর্থকড়ির পাহাড় করে দেননি। হাওয়া ভবন নিয়ে যত কথা, তার সবটাই ছিল বিরোধীদের প্রচারণা।

১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ সরকার হাওয়া ভবনকে দুর্নীতির আখড়া হিসেবে প্রমাণ করতে পারেনি। উলটো আওয়ামী লীগের সীমাহীন দুর্নীতির কাহিনি এখন দেশ-বিদেশে কিংবদন্তিতে রূপ নিয়েছে। কিন্তু খালেদা জিয়া দেশ-বিদেশে নিজ সন্তান ও নিকট-আত্মীয়দের জন্য দুর্নীতির নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেননি। কিংবা দুর্নীতির টাকা গিফট হিসেবে দেখিয়ে বৈধ করার মতো বুদ্ধি বুঝি খালেদা জিয়ার মাথায় কখনো আসেনি। তবুও তার বিরুদ্ধেই মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ এনে কারারুদ্ধ করা হলো। হলেন নিগ্রহের নিষ্পেষণে জর্জরিত। কিন্তু বিধির বিধান কে খণ্ডাবে। এ প্রসঙ্গে সেই বিখ্যাত সিনেমাটার নাম মনে পড়ে গেল। সিনেমাটির নাম ছিল, ‘টুডে ইটস মি, টুমরো ইউ’। অনেকটা শিকারি যখন শিকারে পরিণত হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত