ড. যোবায়ের আল মাহমুদ
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) যে সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবি জানাল এবং তার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের কথা বলল, এটা জুলাই বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক দাবি। অথচ অনেক পুরোনো রাজনীতিবিদ তার বিরোধিতা শুরু করছেন, মনে হয় যেন এক রিপাবলিকের পর আর কিছুর দরকার নেই। ফ্রান্সে কিন্তু পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। যেই সংবিধান বছরের পর বছর বাকশাল, সামরিক শাসন, পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, তা রক্ষা করতে এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়া, পুরোনো রাজনৈতিক দল এবং আঞ্চলিক শক্তিÑসবাই এক কেন তার হদিস নিলেই বোঝা যাবে কেন তারা সেকেন্ড রিপাবলিক চায় না। এরা চায় দেশে পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ চালু থাকুক, তাতেই তাদের মাফিয়া লুটেরা রাজনীতি অব্যাহত থাকবে। পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের রক্ষাকবচ যেই সংবিধান, তা বাদ দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র দরকার। এনসিপির উচিত দায়সারাগোছের সংস্কারের আলাপ বাদ দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের জন্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আলাপ তোলা।
ঔপনিবেশিক এবং গণবিরোধী আমলাতন্ত্র, গণনির্যাতনের কাঠামো বজায় রাখা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার আমূল পরিবর্তন না করে সেকেন্ড রিপাবলিক হবে না। আবার দেশের শাসনতন্ত্র, গণপ্রতিনিধিত্ব আইনসহ অনেক কিছুর তুমুল বৈপ্লবিক সংস্কার দরকার। সবচেয়ে বড় কথাÑএ দেশের সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোয় গণসার্বভৌমত্বের বদলে সরকার অথবা সংসদ অথবা রাষ্ট্রকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ফলে সংসদে গণবিরোধী আইন পাস করা সহজ এখানে। জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার, চিন্তার অধিকার, বিকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এমন নিবর্তনমূলক আইন এবং অধ্যাদেশ পাস করা সহজ এখানে, কারণ জনগণ কিংবা ব্যক্তি-সার্বভৌম নয়, এ দেশে সার্বভৌম হচ্ছে রাষ্ট্র/সরকার/সংসদ। এ কারণেই সরকার বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা/স্থিতিশীলতা/স্ট্যাবিলিটি রক্ষাই বাংলাদেশের প্রথম রিপাবলিকের মূলশাঁস, তাই এসবের অজুহাতে ব্যক্তির মর্যাদা, ব্যক্তির অধিকারকে বারবার ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ফলে প্রথম রিপাবলিকের পুরো সময়ে এ দেশের মানুষ হয় বাকশাল (১৯৭৫) অথবা সামরিক শাসন অথবা সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র (১৯৯০ থেকে ২০০৬) অথবা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র (২০০৯-১৩) বা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের (২০১৪-২৪) দুঃশাসনের শিকার হয়েছে। ফলে শুধু সংস্কার করে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যেমন সম্ভব নয়, একই সঙ্গে জনগণের স্বার্থ দেখভাল করার মতো রাজনীতিও হবে না।
আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ব্যক্তির অধিকার-বিকাশ-মর্যাদা রক্ষাই হবে রাজনৈতিক দল/সরকার/রাষ্ট্রের মূল কাজ, উল্টোটা নয়। ফলে দ্বিতীয় রিপাবলিকের মূল কাজ হবে ব্যক্তির অধিকার-বিকাশ-মর্যাদা রক্ষা করার জন্য দেশের গঠনতন্ত্র, সমস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানো। এনসিপির ঘোষণাপত্রে এসব ক্লিয়ার করা দরকার ছিল। আমাদের রাজনৈতিক ফিলোসফি যে চরম ট্রাইবাল এবং কলোনিয়াল তার প্রমাণ হচ্ছে এ দেশের পুরা রাজনৈতিক কাঠামো, সংবিধান এবং প্রশাসনে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই, ফলে তা চরম অগণতান্ত্রিক। বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক রাজনীতি ভারসাস পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র চালু রাখার পুরোনো রাজনীতি। তাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যাওয়াই এ সময়ের মূল কাজ এবং সেটাই জুলাই বিপ্লবের মূল অভিমুখ। বিপ্লব বেহাত হলেও তা নতুন করে দানা বাঁধার জন্য সমস্ত শর্ত তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু রাজনীতি হচ্ছে করে দেখানোÑএনসিপি কি দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের কাজ করে দেখাতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এতটুকু বলা যায়, এনসিপি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় রিপাবলিকের নতুন গণআন্দোলন বন্ধ হবে না।
বিএনপি নেতারা এনসিপির প্রস্তাবিত সেকেন্ড রিপাবলিকের বিরোধিতা করা শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক আবার কী জিনিস? প্রথম রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে যে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক দরকার? বিএনপি নেতারা সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবিকে এখন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কৌশল বলেও এর বিরোধিতা করছেন। অনেকের মতে, বিএনপি যে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট বা গণ-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে, তার প্রমাণ তারা জুলাই প্রোক্লেমেশন এবং তার ভিত্তিতে নতুন গঠনতন্ত্র ও সেকেন্ড রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, চলমান সংবিধানের কিছু সংস্কার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ৭২-এর সংবিধান রক্ষার দাবিতে এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী এবং আঞ্চলিক শক্তি এক জোট হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাতের জন্যই এই অ্যালায়েন্স কি না, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে বিএনপি আগাতে চায়, এই ৩১ দফা জুলাই বিপ্লবের আগে দেওয়ার ফলে তাতে জুলাই বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগই কম। যেমন : ৩১ দফায় সংসদীয় সার্বভৌমত্ব/রাষ্ট্র বা সরকারের সার্বভৌমত্বই বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে, গণসার্বভৌমত্ব (people’s sovereignty) অথবা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। অথচ আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব, সেটা মার্কিন বুর্জোয়া বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবেরও মূলসুর। ২৪-এর এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর তার একটা প্রোক্লেমেশনের ভিত্তিতেই তো সামনের রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার কথা অথচ জুলাই বিপ্লবের এক বছর আগে দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বিএনপি আগাতে চায়।
বিএনপির ৩১ দফায় রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে পাওয়ার শেয়ারের প্রস্তাব থাকলেও সংবিধানের মেইন পাওয়ার ডায়নামিকস এবং ভাবাদর্শ একই রেখে দায়সারাভাবে সংস্কারের কথা বলা আছে, ফলে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অথবা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অক্ষত রাখারই প্রকল্প এই ৩১ দফা। দায়সারাগোছের বলছি যেমন : ৭০ অনুচ্ছেদ পুরা বাতিলের কথা না বলে সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব ক্ষেত্রে সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না, ফলে সাংসদের নিজস্ব স্বাধীনতা মানে তিনি যেই নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি, সেখানকার জনগণের মতামতকে দলীয় বাক্সে বন্দি করার গণতন্ত্রবিরোধী প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে।
২৪-এর জুলাই বিপ্লব হয়েছে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ ও কলোনিয়াল আধিপত্যের বিরুদ্ধে। ৩১ দফায় কীভাবে এই সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ এবং আঞ্চলিক শক্তির হেজেমনিক আগ্রাসন দূর করা হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেভাবে ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে নিপীড়ক বাহিনী হিসেবে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বিলুপ্তি এবং পুলিশ বাহিনীর ব্যাপক সংস্কার দরকার। বিএনপির ৩১ দফায় গুম-খুন-হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ক বাহিনীর বৈপ্লবিক সংস্কার/পুনর্গঠনের কোনো কথা নেই। জননিপীড়ক আমলাতন্ত্রের যথাযথ সংস্কারের কোনো কিছুই সেখানে নেই। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ঔপনিবেশিক আইন বিশেষ করে ১৮৬০ সালের পুলিশ আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি (the Code of Criminal Procedure of 1898) এবং ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন্স সংস্কারের কোনো কথা বিএনপির ৩১ দফায় নেই। বাংলাদেশের এসব ঔপনিবেশিক চরম নিপীড়নমূলক আইন বজায় রেখে বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় সংবিধানকে একটা চিরন্তন জরুরি অবস্থা জারির (a state of exception or perpetual emergence) উপযোগী হিসেবে বজায় রাখা হয়েছে। জনগণের সিভিল রাইটস লঙ্ঘনকারী এসব আইন বজায় রেখে ‘আইনের শাসন’ চালুর যে অঙ্গীকার করছেন, এ দেশের রাজনীতিবিদরা এগুলো আসলে গণপ্রতারণা। ফলে ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে আগানো মানে দায়সারাগোছের সংস্কার করে ফ্যাসিস্ট সিস্টেম ও কাঠামো অক্ষত রেখে রাজনীতি করতে চান তারা। ফলে ৭২-এর সংবিধানের হাল্কা সংস্কার করে তারা চলতে চায়। যেই সংবিধানের উপযোগিতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই, যা বারবার আমাদের বাকশাল, সামরিক শাসন, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে গেছে, সেই সংবিধানকে জোড়াতালি দিয়ে আর চালানো যাবে না, কারণ এটা আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হবে। তাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের দাবি হচ্ছে এই সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা।
অথচ বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের বয়ান ফেরি করে বলছে, ৭২-এর সংবিধানের মূল কাঠামো অক্ষত রাখতে হবে এবং না হলে নাকি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন করে গণপরিষদ নির্বাচন না দিয়ে পাকিস্তানি কাঠামোর অধীনে গড়ে ওঠা যেই গণপরিষদ, তার মাধ্যমেই ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যেখানে সংসদ/সরকারকেই সার্বভৌম পাওয়ার দেওয়ায় এবং স্টেটের তিন বিভাগের মধ্যে পাওয়ারের কোনো ব্যালান্স না থাকায় এবং ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একজন সাংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ায় এই সংবিধানের যেই পাওয়ার স্ট্রাকচার দাঁড়িয়েছে, তাতে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের কাছে একক কেন্দ্রীভূত পাওয়ার থাকায় একটা ভয়াবহ একনায়কতান্ত্রিক কাঠামোই হচ্ছে এ দেশের শাসনতন্ত্র। ফলে এই সংবিধান মাত্রই একটা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র বা পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্রের বাইরে আর কিছুই আমাদের উপহার দিতে পারেনি এবং পারবে না। ফলে এই সংবিধানই আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারহরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণে ৭২-এর সংবিধান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের যে গণদাবি, মানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা, তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবিপ্লব।
অথচ ৭২-এর সংবিধানে যে গণসার্বভৌমত্ব নেই, তাই এটাই যে মুক্তিযুদ্ধকে বেহাত করার প্রথম সাইন ছিল, তা রাজনীতিবিদরা জনগণকে জানতে দেন না। ফলে ৭২-এর সংবিধান আমাদের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে দেয়নি এবং গণতন্ত্র হয়ে গেছে সুদূরপরাহত। অথচ লীগ, লীগঘেঁষা বামপন্থি আর আঞ্চলিক শক্তির পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের যেই বুদ্ধিবৃত্তিক নেক্সাস, তা এখন প্রচার করছে ৭২-এর সংবিধান বাতিল করলে নাকি দেশে ইসলামিক সংবিধান আসবেÑমানে ‘ডানপন্থার’ বা ‘মৌলবাদের’ উত্থান হবেÑএই জুজুর ভয় দেখিয়ে এরা যে প্রোপাগান্ডা করছে, বিএনপিও একই সুরে কথা বলছে বলে মনে হচ্ছে। অথচ নতুন সংবিধানের মেইন ফোকাল পয়েন্ট হবে গণসার্বভৌমত্ব মানে তা লিবারেল ডেমোক্রেটিক স্টেট কাঠামোই প্রস্তাব করবে। নতুন গঠনতন্ত্র বাদ দিয়ে পুরোনো সিস্টেমে চলার পক্ষে বিএনপির এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই ভাবছেন এত বড় একটা বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের পরও গণক্ষমতার প্রতি আস্থা রেখে গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে না গিয়ে বিএনপি কেন সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের এবং আঞ্চলিক হেজিমনির মূল হাতিয়ার ৭২-এর অগণতান্ত্রিক সংবিধান সুরক্ষার কথা বলছে?
বিএনপির ৩১ দফা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে দেওয়ায় এটা গণঅভ্যুত্থানের সবপক্ষের দফা নয়। ২০২৪-এর জানুয়ারির ইলেকশনের আগে আন্দোলন করার সময় ২০২৩-এর জুলাইয়ের ১৩ তারিখে যেই ৩১ দফা দেওয়া হয়, তা ছিল পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর কিছু সংস্কার করে দায় সারার দাবি এবং সে কারণেই ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের বয়ান নেই করে দেওয়ার জন্যই কি বিএনপি ৩১ দফা নিয়েই আগোচ্ছে এবং জুলাই প্রোক্লেমেশনের প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করছে? ৩১ দফার সংস্কারের আলাপ ২৩-এর রাজনৈতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে বিএনপির সীমিত সংস্কারের আলাপ এবং ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি, ফলে এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর জুলাই ঘোষণাপত্রকে বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গণঅভ্যুত্থানকে রাজনীতি এবং ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত বলে মনে করছেন কেউ কেউ। জুলাই প্রোক্লেমেশন হাজির করা অতি জরুরি এ কারণেই। গণঅভ্যুত্থানের দলিল আকারে এবং গণঅভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং কমিটমেন্ট রক্ষার চার্টার হিসেবে জুলাই প্রোক্লেমেশন, তাই অবশ্যই এই মুহূর্তের সবচেয়ে দরকারি রাজনৈতিক কাজ। এটাকে ঠেকিয়ে দিয়ে ৩১ দফার আলাপ এলে দেশকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগের দশায় নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত কি না, তা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) যে সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবি জানাল এবং তার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের কথা বলল, এটা জুলাই বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক দাবি। অথচ অনেক পুরোনো রাজনীতিবিদ তার বিরোধিতা শুরু করছেন, মনে হয় যেন এক রিপাবলিকের পর আর কিছুর দরকার নেই। ফ্রান্সে কিন্তু পঞ্চম রিপাবলিক চলছে। যেই সংবিধান বছরের পর বছর বাকশাল, সামরিক শাসন, পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ কায়েমের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, তা রক্ষা করতে এ দেশের অধিকাংশ মিডিয়া, পুরোনো রাজনৈতিক দল এবং আঞ্চলিক শক্তিÑসবাই এক কেন তার হদিস নিলেই বোঝা যাবে কেন তারা সেকেন্ড রিপাবলিক চায় না। এরা চায় দেশে পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ চালু থাকুক, তাতেই তাদের মাফিয়া লুটেরা রাজনীতি অব্যাহত থাকবে। পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের রক্ষাকবচ যেই সংবিধান, তা বাদ দিয়ে নতুন গঠনতন্ত্র দরকার। এনসিপির উচিত দায়সারাগোছের সংস্কারের আলাপ বাদ দিয়ে নতুন গণতান্ত্রিক গঠনতন্ত্র প্রণয়ন এবং তার ভিত্তিতে সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের জন্য দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের আলাপ তোলা।
ঔপনিবেশিক এবং গণবিরোধী আমলাতন্ত্র, গণনির্যাতনের কাঠামো বজায় রাখা পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার আমূল পরিবর্তন না করে সেকেন্ড রিপাবলিক হবে না। আবার দেশের শাসনতন্ত্র, গণপ্রতিনিধিত্ব আইনসহ অনেক কিছুর তুমুল বৈপ্লবিক সংস্কার দরকার। সবচেয়ে বড় কথাÑএ দেশের সংবিধান এবং রাষ্ট্রকাঠামোয় গণসার্বভৌমত্বের বদলে সরকার অথবা সংসদ অথবা রাষ্ট্রকেই সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ফলে সংসদে গণবিরোধী আইন পাস করা সহজ এখানে। জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার, চিন্তার অধিকার, বিকাশের অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এমন নিবর্তনমূলক আইন এবং অধ্যাদেশ পাস করা সহজ এখানে, কারণ জনগণ কিংবা ব্যক্তি-সার্বভৌম নয়, এ দেশে সার্বভৌম হচ্ছে রাষ্ট্র/সরকার/সংসদ। এ কারণেই সরকার বা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা/স্থিতিশীলতা/স্ট্যাবিলিটি রক্ষাই বাংলাদেশের প্রথম রিপাবলিকের মূলশাঁস, তাই এসবের অজুহাতে ব্যক্তির মর্যাদা, ব্যক্তির অধিকারকে বারবার ভূলুণ্ঠিত করা হয়েছে। ফলে প্রথম রিপাবলিকের পুরো সময়ে এ দেশের মানুষ হয় বাকশাল (১৯৭৫) অথবা সামরিক শাসন অথবা সংসদীয় স্বৈরতন্ত্র (১৯৯০ থেকে ২০০৬) অথবা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র (২০০৯-১৩) বা সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের (২০১৪-২৪) দুঃশাসনের শিকার হয়েছে। ফলে শুধু সংস্কার করে এ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা যেমন সম্ভব নয়, একই সঙ্গে জনগণের স্বার্থ দেখভাল করার মতো রাজনীতিও হবে না।
আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং ব্যক্তির অধিকার-বিকাশ-মর্যাদা রক্ষাই হবে রাজনৈতিক দল/সরকার/রাষ্ট্রের মূল কাজ, উল্টোটা নয়। ফলে দ্বিতীয় রিপাবলিকের মূল কাজ হবে ব্যক্তির অধিকার-বিকাশ-মর্যাদা রক্ষা করার জন্য দেশের গঠনতন্ত্র, সমস্ত প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে ঢেলে সাজানো। এনসিপির ঘোষণাপত্রে এসব ক্লিয়ার করা দরকার ছিল। আমাদের রাজনৈতিক ফিলোসফি যে চরম ট্রাইবাল এবং কলোনিয়াল তার প্রমাণ হচ্ছে এ দেশের পুরা রাজনৈতিক কাঠামো, সংবিধান এবং প্রশাসনে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব বলে কিছু নেই, ফলে তা চরম অগণতান্ত্রিক। বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক রাজনীতি ভারসাস পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্র/সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র চালু রাখার পুরোনো রাজনীতি। তাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে গণসার্বভৌমত্ব বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যাওয়াই এ সময়ের মূল কাজ এবং সেটাই জুলাই বিপ্লবের মূল অভিমুখ। বিপ্লব বেহাত হলেও তা নতুন করে দানা বাঁধার জন্য সমস্ত শর্ত তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু রাজনীতি হচ্ছে করে দেখানোÑএনসিপি কি দ্বিতীয় রিপাবলিক গঠনের কাজ করে দেখাতে পারবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এতটুকু বলা যায়, এনসিপি ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় রিপাবলিকের নতুন গণআন্দোলন বন্ধ হবে না।
বিএনপি নেতারা এনসিপির প্রস্তাবিত সেকেন্ড রিপাবলিকের বিরোধিতা করা শুরু করেছেন। কেউ বলছেন, সেকেন্ড রিপাবলিক আবার কী জিনিস? প্রথম রিপাবলিক কি অসুস্থ হয়ে গেছে যে আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক দরকার? বিএনপি নেতারা সেকেন্ড রিপাবলিকের দাবিকে এখন নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার কৌশল বলেও এর বিরোধিতা করছেন। অনেকের মতে, বিএনপি যে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট বা গণ-আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে, তার প্রমাণ তারা জুলাই প্রোক্লেমেশন এবং তার ভিত্তিতে নতুন গঠনতন্ত্র ও সেকেন্ড রিপাবলিকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, চলমান সংবিধানের কিছু সংস্কার করলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ৭২-এর সংবিধান রক্ষার দাবিতে এখন বিএনপি, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী এবং আঞ্চলিক শক্তি এক জোট হয়েছেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে নস্যাতের জন্যই এই অ্যালায়েন্স কি না, তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।
জুলাই ঘোষণাপত্র বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে বিএনপি আগাতে চায়, এই ৩১ দফা জুলাই বিপ্লবের আগে দেওয়ার ফলে তাতে জুলাই বিপ্লবের গণ-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হওয়ার সুযোগই কম। যেমন : ৩১ দফায় সংসদীয় সার্বভৌমত্ব/রাষ্ট্র বা সরকারের সার্বভৌমত্বই বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে, গণসার্বভৌমত্ব (people’s sovereignty) অথবা ব্যক্তির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। অথচ আধুনিক বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে গণসার্বভৌমত্ব, সেটা মার্কিন বুর্জোয়া বিপ্লব এবং ফরাসি বিপ্লবেরও মূলসুর। ২৪-এর এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর তার একটা প্রোক্লেমেশনের ভিত্তিতেই তো সামনের রাজনীতি আবর্তিত হওয়ার কথা অথচ জুলাই বিপ্লবের এক বছর আগে দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবের ভিত্তিতেই বিএনপি আগাতে চায়।
বিএনপির ৩১ দফায় রাষ্ট্রের তিন বিভাগের মধ্যে পাওয়ার শেয়ারের প্রস্তাব থাকলেও সংবিধানের মেইন পাওয়ার ডায়নামিকস এবং ভাবাদর্শ একই রেখে দায়সারাভাবে সংস্কারের কথা বলা আছে, ফলে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অথবা সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র বজায় রাখার সিস্টেম অক্ষত রাখারই প্রকল্প এই ৩১ দফা। দায়সারাগোছের বলছি যেমন : ৭০ অনুচ্ছেদ পুরা বাতিলের কথা না বলে সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, যেখানে আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত, এমন সব ক্ষেত্রে সাংসদ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না, ফলে সাংসদের নিজস্ব স্বাধীনতা মানে তিনি যেই নির্বাচনী এলাকার প্রতিনিধি, সেখানকার জনগণের মতামতকে দলীয় বাক্সে বন্দি করার গণতন্ত্রবিরোধী প্রস্তাব বহাল রাখা হয়েছে।
২৪-এর জুলাই বিপ্লব হয়েছে সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ ও কলোনিয়াল আধিপত্যের বিরুদ্ধে। ৩১ দফায় কীভাবে এই সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদ এবং আঞ্চলিক শক্তির হেজেমনিক আগ্রাসন দূর করা হবে, তার কোনো সুস্পষ্ট রূপরেখা নেই। ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাষ্ট্রীয় বাহিনী যেভাবে ছাত্র-জনতার ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, তাতে নিপীড়ক বাহিনী হিসেবে র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বিলুপ্তি এবং পুলিশ বাহিনীর ব্যাপক সংস্কার দরকার। বিএনপির ৩১ দফায় গুম-খুন-হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা বলা হলেও রাষ্ট্রীয় নিপীড়ক বাহিনীর বৈপ্লবিক সংস্কার/পুনর্গঠনের কোনো কথা নেই। জননিপীড়ক আমলাতন্ত্রের যথাযথ সংস্কারের কোনো কিছুই সেখানে নেই। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত ঔপনিবেশিক আইন বিশেষ করে ১৮৬০ সালের পুলিশ আইন, ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি (the Code of Criminal Procedure of 1898) এবং ১৯৪৩ সালের বেঙ্গল পুলিশ রেগুলেশন্স সংস্কারের কোনো কথা বিএনপির ৩১ দফায় নেই। বাংলাদেশের এসব ঔপনিবেশিক চরম নিপীড়নমূলক আইন বজায় রেখে বদরুদ্দীন উমরের ভাষায় সংবিধানকে একটা চিরন্তন জরুরি অবস্থা জারির (a state of exception or perpetual emergence) উপযোগী হিসেবে বজায় রাখা হয়েছে। জনগণের সিভিল রাইটস লঙ্ঘনকারী এসব আইন বজায় রেখে ‘আইনের শাসন’ চালুর যে অঙ্গীকার করছেন, এ দেশের রাজনীতিবিদরা এগুলো আসলে গণপ্রতারণা। ফলে ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে আগানো মানে দায়সারাগোছের সংস্কার করে ফ্যাসিস্ট সিস্টেম ও কাঠামো অক্ষত রেখে রাজনীতি করতে চান তারা। ফলে ৭২-এর সংবিধানের হাল্কা সংস্কার করে তারা চলতে চায়। যেই সংবিধানের উপযোগিতা বলতে কিছু আর অবশিষ্ট নেই, যা বারবার আমাদের বাকশাল, সামরিক শাসন, সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র এবং সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের দিকে নিয়ে গেছে, সেই সংবিধানকে জোড়াতালি দিয়ে আর চালানো যাবে না, কারণ এটা আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হবে। তাই ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের দাবি হচ্ছে এই সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করে সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা।
অথচ বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের বয়ান ফেরি করে বলছে, ৭২-এর সংবিধানের মূল কাঠামো অক্ষত রাখতে হবে এবং না হলে নাকি মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা হবে। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর নতুন করে গণপরিষদ নির্বাচন না দিয়ে পাকিস্তানি কাঠামোর অধীনে গড়ে ওঠা যেই গণপরিষদ, তার মাধ্যমেই ৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, যেখানে সংসদ/সরকারকেই সার্বভৌম পাওয়ার দেওয়ায় এবং স্টেটের তিন বিভাগের মধ্যে পাওয়ারের কোনো ব্যালান্স না থাকায় এবং ৭০ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে একজন সাংসদের নিজ দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ায় এই সংবিধানের যেই পাওয়ার স্ট্রাকচার দাঁড়িয়েছে, তাতে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের কাছে একক কেন্দ্রীভূত পাওয়ার থাকায় একটা ভয়াবহ একনায়কতান্ত্রিক কাঠামোই হচ্ছে এ দেশের শাসনতন্ত্র। ফলে এই সংবিধান মাত্রই একটা সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র বা পার্লামেন্টারি স্বৈরতন্ত্রের বাইরে আর কিছুই আমাদের উপহার দিতে পারেনি এবং পারবে না। ফলে এই সংবিধানই আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকারহরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণে ৭২-এর সংবিধান হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের যে গণদাবি, মানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা, তার বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবিপ্লব।
অথচ ৭২-এর সংবিধানে যে গণসার্বভৌমত্ব নেই, তাই এটাই যে মুক্তিযুদ্ধকে বেহাত করার প্রথম সাইন ছিল, তা রাজনীতিবিদরা জনগণকে জানতে দেন না। ফলে ৭২-এর সংবিধান আমাদের সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে দেয়নি এবং গণতন্ত্র হয়ে গেছে সুদূরপরাহত। অথচ লীগ, লীগঘেঁষা বামপন্থি আর আঞ্চলিক শক্তির পক্ষের বুদ্ধিজীবীদের যেই বুদ্ধিবৃত্তিক নেক্সাস, তা এখন প্রচার করছে ৭২-এর সংবিধান বাতিল করলে নাকি দেশে ইসলামিক সংবিধান আসবেÑমানে ‘ডানপন্থার’ বা ‘মৌলবাদের’ উত্থান হবেÑএই জুজুর ভয় দেখিয়ে এরা যে প্রোপাগান্ডা করছে, বিএনপিও একই সুরে কথা বলছে বলে মনে হচ্ছে। অথচ নতুন সংবিধানের মেইন ফোকাল পয়েন্ট হবে গণসার্বভৌমত্ব মানে তা লিবারেল ডেমোক্রেটিক স্টেট কাঠামোই প্রস্তাব করবে। নতুন গঠনতন্ত্র বাদ দিয়ে পুরোনো সিস্টেমে চলার পক্ষে বিএনপির এই অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই ভাবছেন এত বড় একটা বিপ্লবী গণঅভ্যুত্থানের পরও গণক্ষমতার প্রতি আস্থা রেখে গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার দিকে না গিয়ে বিএনপি কেন সাংবিধানিক ফ্যাসিবাদের এবং আঞ্চলিক হেজিমনির মূল হাতিয়ার ৭২-এর অগণতান্ত্রিক সংবিধান সুরক্ষার কথা বলছে?
বিএনপির ৩১ দফা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগে দেওয়ায় এটা গণঅভ্যুত্থানের সবপক্ষের দফা নয়। ২০২৪-এর জানুয়ারির ইলেকশনের আগে আন্দোলন করার সময় ২০২৩-এর জুলাইয়ের ১৩ তারিখে যেই ৩১ দফা দেওয়া হয়, তা ছিল পুরোনো রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর কিছু সংস্কার করে দায় সারার দাবি এবং সে কারণেই ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি। গণঅভ্যুত্থানের বয়ান নেই করে দেওয়ার জন্যই কি বিএনপি ৩১ দফা নিয়েই আগোচ্ছে এবং জুলাই প্রোক্লেমেশনের প্রাসঙ্গিকতা অস্বীকার করছে? ৩১ দফার সংস্কারের আলাপ ২৩-এর রাজনৈতিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে বিএনপির সীমিত সংস্কারের আলাপ এবং ৩১ দফাকে কেন্দ্র করে কোনো গণঅভ্যুত্থান হয়নি, ফলে এত বড় একটা গণঅভ্যুত্থানের পর জুলাই ঘোষণাপত্রকে বাদ দিয়ে ৩১ দফা নিয়ে রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গণঅভ্যুত্থানকে রাজনীতি এবং ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার চক্রান্ত বলে মনে করছেন কেউ কেউ। জুলাই প্রোক্লেমেশন হাজির করা অতি জরুরি এ কারণেই। গণঅভ্যুত্থানের দলিল আকারে এবং গণঅভ্যুত্থানের জন-আকাঙ্ক্ষার রাজনৈতিক স্বীকৃতি এবং কমিটমেন্ট রক্ষার চার্টার হিসেবে জুলাই প্রোক্লেমেশন, তাই অবশ্যই এই মুহূর্তের সবচেয়ে দরকারি রাজনৈতিক কাজ। এটাকে ঠেকিয়ে দিয়ে ৩১ দফার আলাপ এলে দেশকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আগের দশায় নিয়ে যাওয়ার চক্রান্ত কি না, তা ভেবে দেখা দরকার।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৭ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৭ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৭ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে