বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অ-আওয়ামী পাঠ

সাজ্জাদ নাঈম
প্রকাশ : ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৪৭

গণবিচ্ছিন্নতার কারণে এক ফ্যাসিস্ট সরকারের সরকারি নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের কী পরিণতি হতে পারে উদাহরণ হিসেবে এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আপাতদৃষ্টিতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত এক সরকারি নীতির বিরুদ্ধে শুরু হলেও, এর চূড়ান্ত পরিণতির এক রাজনৈতিক তাৎপর্য আছে।

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত এই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ স্বত্বঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। নিজেদের অধিকার আদায়ে, অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে সর্বস্তরের জনগণ, ভিন্ন পথ ও মতের রাজনৈতিক দলগুলোর বিপুল অংশগ্রহণ আমাদের ইতিহাসেই এর উদাহরণ আছে। ২৪ বছরব্যাপী বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম বহু মত ও পথের ওপরেই গড়ে উঠেছিল।

বিজ্ঞাপন

১৬ বছরব্যাপী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একদলীয় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করেছিল। এ জন্য দলটি শুধু দেশের নির্বাচনীব্যবস্থা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দখল নিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, বরং তারা নিজস্ব সাংস্কৃতিক মতবাদ নির্মাণ করেছিল এবং ইতিহাসের নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও তৈরি করেছিল। এই রাজনৈতিক ব্যাখ্যার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নিজস্ব মতবাদের বাইরে সব মতবাদকেই ‘অপর’ করা। এই ‘অপর’ মতবাদের যেকোনো অনুসারীকেই বিভিন্নভাবে দমনের মাধ্যমে নিজেদের সাংস্কৃতিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।

এই আধিপত্য সৃষ্টি করার জন্যই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে নিজস্ব ধারায় ব্যাখ্যা এবং প্রচার করে। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে বিচ্ছিন্নভাবে উপস্থাপন এবং প্রচার করা হয়। ইতিহাসকে দলীয় লেন্সে পড়তে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সংক্ষেপিত হয়ে আসে এক ব্যক্তি এবং এক দলে।

এই প্রক্রিয়ায় একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়। এ ধারণা প্রতিষ্ঠিত করা হয়, শুধু আওয়ামী লীগই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে নেতৃত্ব দেয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে এর সফল পরিসমাপ্তি ঘটায়। এই স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে ‘অপর’ সবার অবদান গৌণ।

তাই যেহেতু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগই দল হিসেবে বাংলাদেশের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে, তাই দেশ শাসনের অধিকার একমাত্র তাদের। এভাবেই ইতিহাসের আওয়ামীকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে একটি ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলে। কিন্তু ইতিহাসকে দেখতে হবে অবিচ্ছিন্ন এবং সামগ্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক অভূতপূর্ব ঘটনা। দেশভাগের কিছু পরই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা উপলব্ধি করতে শুরু করে তাদের দেশভাগের স্বপ্ন বেহাত হয়েছে, তখন তারা আবার নিজেদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের দুই অংশের স্বাভাবিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য পরিণত হয় দুই পাকিস্তানের মধ্যকার বৈষম্যের কারণে।

বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা ওই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকেই। বেহাত অধিকার ফিরে পাওয়ার লক্ষ্যে প্রথম সংগ্রাম শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আত্মপরিচয় অনুসন্ধানের রাজনৈতিক পর্যায় শুরু হয়। এই আন্দোলন ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের আত্মপরিচয় এবং আত্ম-অধিকারের রাজনৈতিক সচেতনতা নির্মাণের প্রথম পর্যায়।

এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল তমুদ্দিন মজলিশসহ বিভিন্ন সংগঠন, ছাত্র, শিক্ষক, বিভিন্ন পেশার, গ্রামগঞ্জের সাধারণ মানুষ। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী আন্দোলনগুলো ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিজেদের গণতান্ত্রিক এবং মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন হলো এর উদাহরণ। শিক্ষায় বৈষম্য সৃষ্টিকারী শরীফ কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে সব ছাত্রসংগঠন একযোগে আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল সব পর্যায়ের ছাত্রসহ, শ্রমিক এবং সাধারণ জনগণ।

৬৬-এর ছয় দফা তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ৬৬-এর ছয় দফা বাস্তবায়নের আন্দোলনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনে সব শ্রেণিপেশার মানুষ অংশগ্রহণ করে। ৬৯-এর আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সমর্থিত ছাত্রসংগঠন যেমন- ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন), ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) এবং ডাকসুর ছাত্রনেতারা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে এবং এই পরিষদই ছয় দফার ওপর ভিত্তি করে ১১ দফা দাবি পেশ করে।

এরপরই আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে প্রধান আটটি রাজনৈতিক দলÑন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ওলামায়ে ইসলাম, এনডিএফ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জোটবদ্ধ হয়ে ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। আইয়ুববিরোধী এই আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নের আসাদ, নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শামসুজ্জোহাসহ অনেক মানুষের আত্মাহুতির বিনিময়ে সৃষ্ট গণঅভ্যুত্থানে আইয়ুব খানের পতন হয় এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবসহ ৩৪ জন রাজবন্দি মুক্তি পান।

এই গণঅভ্যুত্থানের দুই বছর পরই সব আন্দোলন-সংগ্রামের সর্বশেষ পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল সর্বস্তরের জনগণ, প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর অনেক বাঙালি সদস্য আর পরোক্ষভাবে এর নেতৃত্ব দিয়েছিল তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন দেশের জন্ম হয়।

এসব আন্দোলনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষ, অসংখ্য রাজনৈতিক দলের স্বত্বঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। এই আন্দোলনগুলোয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই বাঙালিদের রাজনৈতিক চেতনা এবং রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্মিত হয়।

মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী আন্দোলনগুলোই বৃহৎ পরিসরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের নিজেদের জাতিগত পরিচয় পুনর্নির্ধারণের সুযোগ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের কোনো পর্যায়ের কোনো আন্দোলনই একক ব্যক্তি এবং একক দলনির্ভর ছিল না। প্রতিটি আন্দোলনেই বহুদল এবং বহু রাজনৈতিক নেতৃত্বের সম্পৃক্ততা ছিল। বহুমতের দলগুলো গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল।

বহুমতের দল এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব এ অঞ্চলে যে বহুদলীয় রাজনৈতিক চেতনা নির্মাণ করেছিল, তা এ অঞ্চলের জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছিল গণতান্ত্রিক চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিশ্লেষণ করতে হবে দেশভাগের পরবর্তী ২৪ বছরের সময়কালের ব্যাপ্তিতে, সামগ্রিকতার পরিপ্রেক্ষিতে, অসংখ্য ঘটনাপ্রবাহের সম্মিলন হিসেবে।

বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়কে বিশ্লেষণ করতে হবে এসব মতের, পথের এবং গণমানুষের মুক্তির অভিপ্রায়ের সাপেক্ষে, কোনো একক দল এবং মতের ইচ্ছা-অনিচ্ছার ফলাফল হিসেবে নয়। এই ‘বহুমত’ এবং ‘গণ’ই হলো বাংলাদেশ সৃষ্টিপূর্ব সব আন্দোলনের মূল ভিত্তি।

লেখক : গবেষক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত