রাকসু নির্বাচন ও হারানো গণতন্ত্র

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ০৫
প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর স্বপ্ন, সংগ্রাম, শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এখানে মিলেমিশে এক অনন্যসত্তা তৈরি করে আছে। এই সত্তাকে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের মাধ্যমে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জন্ম হয়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু)।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু দুঃখজনকভাবে বহু বছর ধরে রাকসু নির্বাচন স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষার্থীরা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, নেতৃত্ব বিকাশের সুযোগ হারাচ্ছে। ৩৬ বছর স্থগিত থাকার পর আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর রাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে তাই রাকসু নির্বাচন শুধু একটি শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচনের বিষয় নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে এই উচ্চশিক্ষাঙ্গনে হারানো গণতন্ত্রের কাহিনি এবং একই সঙ্গে সম্ভাবনার ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি।

১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর এখন পর্যন্ত ১৪ বার রাকসু নির্বাচন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়, ১৯৭০ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত রাকসু নির্বাচন হয়নি। এছাড়া সামরিক শাসনের জন্য ১৯৭৫-৮০ এবং ১৯৮১-৮৮ সাল পর্যন্ত নির্বাচন স্থগিত ছিল। রাকসুর সর্বশেষ নির্বাচন ১৯৮৯ সালে হয়েছিল। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ভিপি এবং রুহুল কুদ্দুস বাবু জিএস হিসেবে নির্বাচিত হন।

আজ ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে এসে প্রশ্ন জাগে—১৯৮৯ সালের পর ৩৬ বছর ধরে কেন রাকসু নির্বাচন আর হলো না? কারণ একদিকে প্রশাসন শঙ্কিত ছিল, নির্বাচনের ফলে শিক্ষার্থীদের শক্তিশালী প্রতিনিধিত্ব তৈরি হবে, যা প্রশাসনের জবাবদিহি বাড়াবে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলো ভয় পেত, নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা হয়তো দলীয় স্বার্থের বাইরে গিয়ে সত্যিকারের ছাত্রকল্যাণে কাজ করবেন। ফলে নানা অজুহাতে রাকসুর নির্বাচন পিছিয়ে যেতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একটি প্রজন্ম রাকসু কী তা শুধু বইয়ে পড়ে বা প্রবীণদের মুখে শুনেই জেনে গেছে।

জুলাই বিপ্লব-২০২৪-এর পর থেকে শিক্ষার্থীদের বঞ্চনা ও ক্ষোভ সংগঠিত আকারে আওয়াজ হিসেবে প্রকাশ করার সুযোগ পেয়ে যায়। আজকে দেশের সব উচ্চশিক্ষাঙ্গনে ধারাবাহিকভাবে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের আয়োজন সেই সমন্বিত কণ্ঠস্বরের ফল হিসেবে মনে করা হচ্ছে।

বহু বছর ধরে রাকসু নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা যে বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, তা বহুমাত্রিক। প্রথমত, তারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধি হারিয়েছেন। ফলে আবাসন সংকট, সিটবাণিজ্য, পরিবহন ঘাটতি, টিউশন ফি বৃদ্ধি, নিরাপত্তাহীনতা বা শিক্ষার মান উন্নয়ন—এসব সমস্যায় শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চারিত হচ্ছে না।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে। যারা আগামী দিনের সমাজ ও জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতেন, তারা আজ সে সুযোগ হারাচ্ছেন। তৃতীয়ত, গণতন্ত্রের অনুশীলন থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি অনুপস্থিত থাকলে সমাজেও গণতন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে।

বর্তমান প্রেক্ষাপট ২০২৫ সালে এসে জানুয়ারি মাস থেকেই রাকসু নির্বাচন আবার আলোচনায় এসেছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা শুধু ক্যাম্পাসের মাঠে নয়, বরং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও নিজেদের দাবি প্রকাশ করেছে। তারা বুঝতে পেরেছে, নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া সমস্যার সমাধান অসম্ভব। শিক্ষার্থীরা বিশ্বাস করে, রাকসুর মাধ্যমে তারা অন্তত একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা পাবে, যা দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে পুনর্জীবিত করতে পারে। এ জন্যই ২৫ সেপ্টেম্বর রাকসু ভোটের আয়োজন সফল হতে যাচ্ছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাকসু আবার আলোচনায় আসছে নতুন সম্ভাবনার কারণে। অতীতে রাকসু নির্বাচনি প্রচারে স্লোগান, পোস্টার, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পুরো ক্যাম্পাসকে প্রাণবন্ত করে তুলত। বর্তমানে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে রাকসুর দাবি তুলছে, অনলাইন পিটিশন করছে, সচেতনতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। অতীতের রাকসু শারীরিক উপস্থিতি দিয়ে শিক্ষার্থীদের একত্র করত আর বর্তমান প্রজন্মের রাকসু আন্দোলন ভার্চুয়াল ও বাস্তব—উভয় মাধ্যমে সংগঠিত হচ্ছে।

আর কয়েকদিন বাদে রাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ এঁকে দিতে পারে। যদি ২০২৫ সালে রাকসু নির্বাচন সুষ্ঠু ও সফলভাবে হতে পারে, তবে এর প্রভাব হবে ইতিবাচক ও বহুমাত্রিক। এতে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে। তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে। নতুন মেধাবী তরুণদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে। নতুন প্রজন্মের ছাত্রছাত্রী নেতারা আগামী দিনের জাতীয় নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জবাবদিহির আওতায় আসবে, যা শিক্ষা ও সেবার মান উন্নত করবে। এতে করে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক বার্তা যাবে, যে শিক্ষার্থীরা সত্যিকার গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, তারা ভবিষ্যতে জাতীয় রাজনীতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবেন।

তবে এই সম্ভাবনার বাস্তবায়ন নির্ভর করছে প্রশাসনের সদিচ্ছা ও রাজনৈতিক চাপমুক্ত পরিবেশের ওপর। যদি নির্বাচন শুধু প্রহসনে পরিণত হয়, তবে রাকসু আরেকটি নামমাত্র প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

রাকসু নির্বাচন তাই হারানো গণতন্ত্রের কাহিনি ও সম্ভাবনার ভবিষ্যৎ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই নির্বাচন আসলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রতিচ্ছবি। বহু বছর ধরে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে, নেতৃত্ব বিকাশের ক্ষেত্র সংকুচিত করা হয়েছে। কিন্তু আজকের প্রজন্ম আবার সেই হারানো গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখছে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন

E-mail: fakrul@ru.ac.bd

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত