আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

গণমাধ্যমের বয়ান নির্মাণ এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান

তাইয়িব আহমেদ

গণমাধ্যমের বয়ান নির্মাণ এবং কর্তৃত্ববাদের উত্থান
তাইয়িব আহমেদ

সাংবাদিকতা আর রাজনীতির সম্পর্ক কোনো দিনই সরল ছিল না। জার্মান সমাজবিজ্ঞানী ও দার্শনিক ম্যাক্স ভেবার এক শতাব্দী আগে যেদিন বলেছিলেন—‘Journalism will remain one of the most important career paths for professional political activity’—তিনি আসলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে সাংবাদিকতা শুধুই তথ্য পরিবেশনের কাজ নয়; এটি সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিস্তৃত ক্ষেত্র। সাংবাদিকতা যে রাজনৈতিক ক্রিয়ার একটি মুখ্য দিক—এই সত্য আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে আমেরিকান সমাজবিজ্ঞানী উইলিয়াম গ্যামসনের কথায়, যিনি মিডিয়াকে বলেছেন রাজনীতির ‘মাস্টার ফোরাম’ (master forum)—যে মঞ্চে ক্ষমতা প্রতিনিয়ত অভিনীত হয়, পুনর্লিখিত হয় এবং আবার নতুন আঙ্গিকে জনগণের সামনে হাজির হয়। আর মিডিয়া স্কলার মাইকেল শাডসনের সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর মন্তব্য—জার্নালিজম ইজ অ্যান এলিমেন্ট অব পলিটিকস (journalism is an element of politics)—এই তিনটি বক্তব্যই মিলে আমাদের সামনে এক প্রতিবিম্ব রাখে : মিডিয়া শুধু রাজনীতিকে কভার করে না; মিডিয়া রাজনীতিকে গঠন করে।

মিডিয়া : আদর্শগত যন্ত্র ও ক্ষমতার উৎপাদন

বিজ্ঞাপন

তথ্য উপস্থাপনার ধরন বদলালেই বার্তা সম্পূর্ণ উল্টে যেতে পারে ১৮০ ডিগ্রি পর্যন্ত। এটিই মিডিয়ার প্রকৃত রাজনীতি। সংবাদমাধ্যম সমাজকে শুধু জানায় না, বরং শেখায়—কোনটা সত্য, কোনটা অগ্রাধিকারযোগ্য, কোনটা বিপজ্জনক আর কোনটা স্বাভাবিক। তাই সংবাদ কখনোই ঘটনাকে যেমন দেখা গেছে, ঠিক সেই রূপে তুলে ধরে না; বরং ঘটনার একটি নির্মিত, বাছাই করা, রাজনৈতিক সংস্করণই সামনে আনে। এ কারণে সংবাদমাধ্যম আসলে একটি ‘নলেজ-প্রোডিউসিং ডিসকার্সিভ ফিল্ড’ (knowledge-producing discursive field)—যেখানে অর্থ, বয়ান, প্রতীক, সত্য ও ক্ষমতা দৈনিকভাবে তৈরি হয়। গণমাধ্যমের মূল কাজ শুধু বিনোদন বা তথ্য সরবরাহ নয়; এটি সমাজকে এমন মূল্যবোধ, আচরণ ও চিন্তাধারায় প্রশিক্ষিত করে, যা একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক কাঠামোর সঙ্গে নাগরিককে একীভূত করে তোলে।

এই জায়গাটিতেই সাংবাদিকতার নৈতিক উদ্দেশ্য বা নরমেটিভ রোল (normative role), যা গণতন্ত্রকে সেবা দেওয়া—অপরিহার্য হয়ে ওঠে। ক্রিশ্চিয়ানস, হ্যালিন ও মানচিনি, ম্যাকনেয়ারসহ অসংখ্য মিডিয়া স্কলার বলেছেনÑসাংবাদিকতার মূল তাগিদ হওয়া উচিত জনস্বার্থ রক্ষা, সমাজকে তথ্য দিয়ে সক্ষম করে তোলা এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহির আওতায় আনা। জার্মান দার্শনিক ইয়রগান হ্যাবারমাসের পাবলিক স্ফিয়ার (public sphere) ধারণা তাই সংবাদমাধ্যমকে শুধু পেশা নয়—গণতান্ত্রিক পরিসরের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে কল্পনা করে। নাগরিকরা যেন যুক্তি, সমালোচনা ও আলোচনা দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর নজর রাখতে পারে—মিডিয়ার প্রথম কাজ আসলে সেটাই।

শাডসন দেখিয়েছেন—সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের জন্য শুধু তথ্য সরবরাহ করে না; এটি নাগরিক সচেতনতার ভিত্তি নির্মাণ করে, ভিন্নমতের জন্য স্থান তৈরি করে এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে জ্ঞানে ভিত্তিপ্রাপ্ত রাখে। জেমস ক্যারি (১৯৮৭) বলেছেন, সাংবাদিকতা জনতার ভেতরেই নিহিত—অর্থাৎ জনগণের কণ্ঠস্বরই সাংবাদিকতার প্রধান উৎস। জোসেফ পুলিৎজার সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ আদর্শ হিসেবে পাবলিক সার্ভিস (public service)–কে ঘোষণা করেছিলেন। আর পৃথিবীর প্রথম সাংবাদিকতা স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাংবাদিক ওয়াল্টার উইলিয়ামস সাংবাদিকতার একটা রূপ বর্ণনা করেছেন তার বিখ্যাত ‘জার্নালিস্টস ক্রিড’ (Journalist’s Creed)-এ। জার্নালিস্ট’স ক্রিড এমন একটি দলিল, যা একশোরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে, নিয়মিতভাবে পুনর্মুদ্রিত হয়, ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবের দেয়াল শোভা বাড়ায় এবং বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতা পাঠক্রমের একটি স্থায়ী উপাদান হিসেবে রয়ে গেছে।

ওয়াল্টার উইলিয়ামস বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যে সাংবাদিকতা সর্বাধিক সাফল্য অর্জন করে এবং সত্যিকার অর্থেই সাফল্যের যোগ্য—তা ঈশ্বরকে ভয় করে এবং মানুষকে সম্মান করে; তা অটলভাবে স্বাধীন, মতের অহংকার বা ক্ষমতার লোভে বিচলিত নয়; তা নির্মাণশীল, সহনশীল কিন্তু কখনোই উদাসীন নয়; আত্মনিয়ন্ত্রিত, ধৈর্যশীল, পাঠকের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল কিন্তু কোনো কিছুকেই ভয় করে না; তা অবিচারের বিরুদ্ধে তৎক্ষণাৎ ক্ষুব্ধ হয়; সুবিধাভোগীর আবেদন কিংবা জনতার কোলাহলে প্রভাবিত হয় না; তা প্রত্যেক মানুষকে একটি সুযোগ দিতে চায় এবং যতদূর আইন, ন্যায্য মজুরি এবং মানব-ভ্রাতৃত্বের স্বীকৃতি তাকে সম্ভব করে তোলে, সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে সচেষ্ট; তা গভীরভাবে দেশপ্রেমিক, একই সঙ্গে আন্তরিকভাবে আন্তর্জাতিক সদিচ্ছা উন্নীত করে এবং বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বকে দৃঢ় করে; এ এক মানবিক সাংবাদিকতা—আজকের বিশ্বের জন্য, আজকের বিশ্ব থেকেই উৎসারিত।’

কিন্তু বাংলাদেশে এই নৈতিক প্রকল্পটি ভেঙে গেছে। পতনটি শুধু পেশাগত নয়—এটি রাজনৈতিক।

বাংলাদেশে মিডিয়া : কর্তৃত্ববাদের পুষ্টিযন্ত্র

বাংলাদেশের সমকালীন মিডিয়া পরিবেশের দিকে তাকালে দেখা যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বাস্তবতা। মিডিয়া স্কলারশিপ যে সত্যটি বারবার বলেছে—মিডিয়া নিজের ন্যারেটিভ তৈরি করতে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকেই ‘এক্সপার্ট’ বানায় এবং সংবাদের অবজেকটিভিটির তোয়াক্কা না করে নিজেদের আদর্শিক লাইনের নিউজ ফ্রেমিং করে—এটি দেশে শাসকশ্রেণির রাজনৈতিক প্রয়োজনে আরো দৃঢ়ভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে প্রকৃত বিশ্লেষক বা বিরোধী মত প্রকাশকারীর কণ্ঠ অনুপস্থিত হয়ে পড়ে আর কিছু নির্দিষ্ট মুখ বারবার জনগণের সামনে হাজির হয় ‘বিশেষজ্ঞ’ নামে, যাদের বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ এবং কাঙ্ক্ষিত বয়ানকে শক্তিশালী করে। দেশের প্রধানধারার মিডিয়াকে দেখলে বোঝা যায় কীভাবে এই বিশেষজ্ঞ বাছাই ক্ষমতার লজিকে পরিচালিত হয়।

এ পর্যায়ে আসে ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোর ক্ষমতাতত্ত্ব। ফুকো দেখালেন, ক্ষমতা কোনো নির্দিষ্ট কেন্দ্রে থাকে না; এটি প্রতিষ্ঠান, জ্ঞান, ভাষা ও প্রতিদিনের প্র্যাকটিসে ছড়িয়ে থাকে। সংবাদমাধ্যম তাই ক্ষমতার একটি কেন্দ্র নয়—অসংখ্য ক্ষমতার নোডের একটি জটিল সমাবেশ। আরেক ফরাসি দার্শনিক লুই আলথুসার এটিকে বলেছেন সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী আইডিওলজিক্যাল অ্যাপারেটাস (ideological apparatus) বা আদর্শগত যন্ত্র। এই যন্ত্রের কাজ হলো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শকে ‘স্বাভাবিক’ সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। জার্মানের ফ্রাংকফুর্ট স্কুলের দার্শনিক এডর্নো ও হরখেইমার যাকে বলেছিলেনÑ কালচার ইন্ডাস্ট্রি (culture industry) বা সংস্কৃতি-শিল্প—সেই শিল্প যেখানে মানুষের চিন্তাভাবনার মানচিত্র তৈরি হয়। ইতালিয়ান দার্শনিক এন্তোনিও গ্রামসি আরো দেখালেন—এই সাংস্কৃতিক উৎপাদনই হেজেমনিক পাওয়ার (hegemonic power) বা আধিপত্যশীল ক্ষমতার প্রকৃত উৎস।

ফলে যে বয়ান মিডিয়া সমর্থন করে—ক্ষমতা তার পক্ষেই থাকে। আর যে বয়ান মিডিয়া মুছে ফেলে বা বিকৃত করে—তা জনগণের কাছে পৌঁছায় না, ফলত ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বীরা অদৃশ্য হয়ে পড়ে। জনগণের রাজনীতি তখন শাসকের বর্ণনার ওপর দাঁড়ায়—বাস্তবতার ওপর নয়।

এ বাস্তবতা থেকে হ্যাবারমাস তাই বলেছিলেন—গণতন্ত্র রক্ষার জন্য গণতান্ত্রিক পাবলিক স্ফিয়ার (public sphere) বা জনপরিসর অপরিহার্য। আর যেহেতু মিডিয়া সেই জনপরিসরের প্রধান ভিত্তি, তাই মিডিয়ার গণতন্ত্রায়ণ ছাড়া সমাজে কোনো গণতন্ত্রই টিকে থাকতে পারে না। এটি শুধু ধারণাগত নয়—এটি রাজনৈতিক বাস্তবতা।

এ কথাটাই আরো জোর দিয়ে বলেছেন আমেরিকান মিডিয়া স্কলার ভিক্টর পিকার্ড। তিনি লিখেছেন : ‘The journalism crisis is a threat to democracy… it is abundantly clear the market cannot support the level of journalism—especially local, international, policy, and investigative reporting—that democracy requires.’ অর্থাৎ বাজার মিডিয়াকে বাঁচিয়ে রাখতে পারছে না; আর রাষ্ট্র যেভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে, তার ফলে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা সংকুচিত হয়ে আসছে। এই দ্বিমুখী সংকটই গণতন্ত্রের জন্য এক গভীর হুমকি। সে জন্যই ভিক্টর পিকার্ড বলেছেন, সমাজের গণতন্ত্রায়ণের জন্য আগে দরকার গণমাধ্যমের গণতন্ত্রায়ণ এবং সেই লক্ষ্যে তার প্রস্তাব হলো প্রত্যেক সমাজে পাবলিক মিডিয়া কমিশন গঠন করতে হবে, যাদের কাজে সমাজের মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপের গণতন্ত্রায়ণের জন্য নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া ।

গণতন্ত্রের পথে সবচেয়ে বড় বাধা : পোলারাইজড মিডিয়া ইকোসিস্টেম

বাংলাদেশে এই সংকট আরো তীব্র, আরো রাজনৈতিক, আরো কাঠামোগত। এখানে মিডিয়া ল্যান্ডস্কেপ ভীষণভাবে পোলারাইজড এবং বহুক্ষেত্রে ফ্যাসিস্টিক শক্তির দিকে স্কিউড। বিরোধী কণ্ঠস্বরকে মিডিয়ায় জায়গা দেওয়া হয় সামান্য, কখনোই সমান নয়। শাসক গোষ্ঠীর বয়ানকে রক্ষায় অনেকে সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে কাজ করে। আর যারা সত্য উচ্চারণে সাহস দেখান—তারা হয় মামলা, হয় হুমকি বা কর্মক্ষেত্রে বঞ্চনার মুখোমুখি হন। এই বাস্তবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ যদি ভাবেন—বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক হবে, জনগণ হবে সচেতন, রাষ্ট্র হবে জবাবদিহিমূলক—তবে সেই মানুষ আসলে বোকার স্বর্গে বাস করেন।

কারণ গণতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে না; এটি নির্ভর করে জনপরিসরের গুণগত মানের ওপর। আর জনপরিসর নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা, বহুমাত্রিকতা এবং নৈতিকতার ওপর।

মিডিয়ার গণতন্ত্রায়ণ ছাড়া সমাজের গণতন্ত্রায়ণ অসম্ভব—এটি নিছক একাডেমিক থিসিস নয়; এটি একটি পরম সামাজিক সত্য।

বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা তাই আমাদের একটি কঠিন কিন্তু জরুরি শিক্ষা দেয় : সত্যকে যদি বন্দি করা হয়, জনগণকে যদি ভুল তথ্যের বয়ানে নিমজ্জিত করা হয়, মতপ্রকাশ যদি রাজনৈতিক ঝুঁকি হয়ে ওঠে—তবে কর্তৃত্ববাদই রাষ্ট্রের স্বাভাবিক পরিণতি। গণতন্ত্র ফিরে আসবে শুধু তখনই যখন সংবাদমাধ্যম মুক্ত হবে, জনপরিসর উন্মুক্ত হবে, সত্যের ওপর রাষ্ট্রীয় দমন ভাঙবে আর জনগণ জানতে পারবে প্রকৃত বাস্তবতা কী।

সত্যানুসন্ধান এবং সত্য নির্মাণের মাধ্যমেই গণতন্ত্রের পথ উন্মোচিত হয়। আর সেই সত্য নির্মাণের প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো—মিডিয়া।

লেখক : সাংবাদিক, যুক্তরাষ্ট্রের কলোরেডো স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে সংবাদের সমাজতত্ত্ব বিষয়ে ডক্টোরাল ক্যান্ডিডেট

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন