মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক শুরুটা হয় ১৯৮৩ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি ৩০টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আর্থিক কোম্পানির সংখ্যা তিনটি ও ইসলামি উইন্ডো বা সেবা আছে পাঁচটি প্রচলিত আর্থিক কোম্পানির। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিমা বা তাকাফুল কোম্পানি আছে ১৮টি। এছাড়া ১৬টি প্রচলিত বিমা কোম্পানির ইসলামি উইন্ডো আছে। সরকারি সুকুক বাজারে এসেছে চারটি, করপোরেট সুকুক দুটি ও শরিয়াহ ফান্ড আছে ১৮টি। বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার প্রসার আরো হতে পারত, কিন্তু যতটুকু হয়েছে তাও একেবারে কম নয়। বাজার প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং ও বিমা পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর একটি। কিন্তু মানের দিক থেকে আছে নানা ধরনের দুর্বলতা।
মানের দুর্বলতার বর্তমান অবস্থার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই গত লুটেরা সরকারের সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, যার অন্যতম শিকার ছিল ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তখনকার অনিয়ম আর লুটপাটের বাস্তবতায় আইন কেমন ছিল সে আলোচনা অবান্তর। তবে এটাও সত্যি যে, ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার উপযোগী আইনি কাঠামো বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত। তার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ফলে আইনি কাঠামোর যৎসামান্য যে কাজ হয়েছে, তা যখন যারা পদে ছিলেন, তাদের বিচ্ছিন্ন চিন্তার ভিত্তিতে হয়েছে এবং মূলত প্রচলিত চর্চাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা বা ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার সমন্বিত বিকাশের দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন এসবে অনুপস্থিত।
ইসলামি অর্থনীতির ধারণা আর্থিক কার্যক্রমে দায়িত্বশীলতা, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার, সমাজে যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকা এবং প্রকৃত ও টেকসই ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কথা বলে। এর ফলে ইসলামি অর্থনীতি কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সবার জন্য কল্যাণকর। বর্তমান সময়ে টেকসই অর্থনীতির যে ধারণাগুলো বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে ইসলামি অর্থনীতির ধারণার সামঞ্জস্যের কারণে আমরা প্রায়ই বিশ্বমঞ্চে তাদের পাশাপাশি দেখতে পাই।
ইসলামি অর্থনীতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ এটা নয় যে, এটি একটি ধর্মভিত্তিক ব্যবস্থা, বরং কারণ এই যে, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মূল্যবোধভিত্তিক একটি ব্যবস্থা। ফলে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো এমন হতে হবে, যা এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। আইনি কাঠামো যদি প্রচলিত চর্চাভিত্তিক হয়, তবে তা ইসলামি অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার জন্য উপকারী তো হবেই না, বরং এর নীতিগুলো পরিপালনে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপে অংশীজনদের মধ্যে এই বোঝাপড়াটা হওয়া প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার ধরন কেমন হবে। যেমন, ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা কি প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার সমান্তরালে চলতে থাকবে, নাকি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ইসলামিক হবে? এই বোঝাপড়া সৃষ্টিতে প্রয়োজন ব্যাপক মতবিনিময়ের, যেখানে প্রতিনিধিত্ব থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামি অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর। ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে।
বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশ পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আইন প্রণয়ন করেছে। ইরান ১৯৮৩ সালে সুদমুক্ত ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে, যেখানে বলা হয়েছে, ইরানের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য হবে ইসলামি আইন ও প্রবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতাভিত্তিক একটি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সুদান এমন আরেকটি উদাহরণ। পাকিস্তান ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ তাদের ব্যাংক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ইসলামি ব্যবস্থায় রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর বাইরে বেশ কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে দ্বৈত আর্থিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া অন্যতম।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের মতো ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু করার আগে ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে। ইসলামি বিমা শুরু করার আগে ১৯৮৪ সালে করে ইসলামি বিমা আইন। এই আইনগুলোকে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রণয়ন করে আরেকটি আইন। ২০১৩ সালের আইনটির অন্যতম বিষয়গুলোর মধ্যে আছে আমানত ও বিনিয়োগ হিসাব পৃথক্করণ। এর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকিবিহীন ও ঝুঁকিভিত্তিক হিসাবের পার্থক্য সুস্পষ্ট করা হয়, যা শরিয়াহর দৃষ্টিতে অতি জরুরি। আইনটির অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে শরিয়াহ বিচ্যুতির আলোকে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা। আইনটিতে সর্বোচ্চ আট বছরের জেল বা ২৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকার সমান) বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই কঠোর শাস্তির বিধান রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামি আর্থিক কার্যক্রমে জড়িত সবাই যেন শরিয়াহ পরিপালনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং কোনো ধরনের বিচ্যুতির সাহস যেন কেউ না করে।
মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ইসলামি ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থার বিষয়ে তাদের দায়িত্ব কেমন হবে। যেমন সেটিতে বলা আছে, মালয়েশিয়ায় প্রচলিত ও ইসলামিক ব্যাংকিং সমান্তরালভাবে চলবে এবং মালয়েশিয়াকে ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থার একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকার ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে। একই রকমভাবে পুঁজিবাজার আইনে ইসলামি পুঁজিবাজার শক্তিশালী করার বিষয়ে বিভিন্ন বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা একটু দেরিতে শুরু হলেও এখন তাদের অগ্রগতি খুবই দ্রুত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে তাদের প্রথম ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, আর ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে ২০০৮ সালে। বর্তমানে দেশটি কেবল ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা নয়, ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থায় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার এগিয়ে যাওয়ার কারণ কেবল একটি আইন থাকা নয়, বরং এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে। ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া জাতীয় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি কমিটি প্রতিষ্ঠা করে, যার প্রধান দেশটির প্রেসিডেন্ট। সদস্যদের মধ্যে আছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় ওলামা কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। মালয়েশিয়াও বিভিন্ন পর্যায়ে একই ধরনের কমিটি গঠন করেছে। দুই দেশই ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতির বিষয়ে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেছে, যেখানে পরিকল্পনার পাশাপাশি নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেছে। অর্থাৎ কত বছরের মধ্যে তারা কী অর্জন করতে চায় তা নির্ধারণ করেছে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থায় লোকজনকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশ দুটি নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে। যেমন, মালয়েশিয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং শুরুর পর থেকে প্রতিটি বাজেটে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার জন্য কোনো না কোনো প্রণোদনা ছিল। ইসলামি অর্থনীতি-বিষয়ক শিক্ষা-গবেষণায়ও তারা ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি একটি পূর্ণাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে কেবল ইসলামি অর্থনীতির বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। মালয়েশিয়ার ২০২৫ সালের বাজেটে ১০ মিলিয়ন রিঙ্গিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ইসলামি অর্থনীতি-বিষয়ক গবেষণায়। এর আগের বছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২০ মিলিয়ন রিঙ্গিত।
প্রকৃত অর্থে ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতার দিকে তাকাতে পারে। কেবল ইসলামি ব্যাংকিং আইন নয়, প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপযোগী আইনি কাঠামো। তার আগে প্রয়োজন ইসলামি অর্থনীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা। সব থেকে জরুরি ইসলামি অর্থনীতি বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা।
লেখক: ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে মালয়েশিয়ার ইন্সইফ ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত
বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক শুরুটা হয় ১৯৮৩ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। বর্তমানে দেশে ১০টি পূর্ণাঙ্গ ইসলামি ব্যাংকের পাশাপাশি ৩০টি প্রচলিত ধারার ব্যাংক ব্রাঞ্চ বা উইন্ডোর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিং সেবা দেওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আর্থিক কোম্পানির সংখ্যা তিনটি ও ইসলামি উইন্ডো বা সেবা আছে পাঁচটি প্রচলিত আর্থিক কোম্পানির। পূর্ণাঙ্গ ইসলামি বিমা বা তাকাফুল কোম্পানি আছে ১৮টি। এছাড়া ১৬টি প্রচলিত বিমা কোম্পানির ইসলামি উইন্ডো আছে। সরকারি সুকুক বাজারে এসেছে চারটি, করপোরেট সুকুক দুটি ও শরিয়াহ ফান্ড আছে ১৮টি। বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার প্রসার আরো হতে পারত, কিন্তু যতটুকু হয়েছে তাও একেবারে কম নয়। বাজার প্রতিনিধিত্বের দিক থেকে বাংলাদেশের ইসলামি ব্যাংকিং ও বিমা পৃথিবীর শীর্ষ দেশগুলোর একটি। কিন্তু মানের দিক থেকে আছে নানা ধরনের দুর্বলতা।
মানের দুর্বলতার বর্তমান অবস্থার একটি অন্যতম কারণ অবশ্যই গত লুটেরা সরকারের সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা, যার অন্যতম শিকার ছিল ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। তখনকার অনিয়ম আর লুটপাটের বাস্তবতায় আইন কেমন ছিল সে আলোচনা অবান্তর। তবে এটাও সত্যি যে, ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার উপযোগী আইনি কাঠামো বাংলাদেশে প্রায় অনুপস্থিত। তার থেকেও বড় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। ফলে আইনি কাঠামোর যৎসামান্য যে কাজ হয়েছে, তা যখন যারা পদে ছিলেন, তাদের বিচ্ছিন্ন চিন্তার ভিত্তিতে হয়েছে এবং মূলত প্রচলিত চর্চাকে এক ধরনের বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা থেকে হয়েছে। ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা বা ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার সমন্বিত বিকাশের দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন এসবে অনুপস্থিত।
ইসলামি অর্থনীতির ধারণা আর্থিক কার্যক্রমে দায়িত্বশীলতা, ন্যায্যতা ও ন্যায়বিচার, সমাজে যারা পিছিয়ে পড়েছে তাদের ব্যাপারে সচেতন থাকা এবং প্রকৃত ও টেকসই ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কথা বলে। এর ফলে ইসলামি অর্থনীতি কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সবার জন্য কল্যাণকর। বর্তমান সময়ে টেকসই অর্থনীতির যে ধারণাগুলো বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সেগুলোর সঙ্গে ইসলামি অর্থনীতির ধারণার সামঞ্জস্যের কারণে আমরা প্রায়ই বিশ্বমঞ্চে তাদের পাশাপাশি দেখতে পাই।
ইসলামি অর্থনীতি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণ এটা নয় যে, এটি একটি ধর্মভিত্তিক ব্যবস্থা, বরং কারণ এই যে, এটি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মূল্যবোধভিত্তিক একটি ব্যবস্থা। ফলে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো এমন হতে হবে, যা এই মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। আইনি কাঠামো যদি প্রচলিত চর্চাভিত্তিক হয়, তবে তা ইসলামি অর্থনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থার জন্য উপকারী তো হবেই না, বরং এর নীতিগুলো পরিপালনে অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপে অংশীজনদের মধ্যে এই বোঝাপড়াটা হওয়া প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার ধরন কেমন হবে। যেমন, ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা কি প্রচলিত আর্থিক ব্যবস্থার সমান্তরালে চলতে থাকবে, নাকি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে ইসলামিক হবে? এই বোঝাপড়া সৃষ্টিতে প্রয়োজন ব্যাপক মতবিনিময়ের, যেখানে প্রতিনিধিত্ব থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও ইসলামি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ইসলামি অর্থনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোর। ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার আইনি কাঠামো শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছার ওপরই নির্ভর করবে।
বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশ পূর্ণাঙ্গ ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আইন প্রণয়ন করেছে। ইরান ১৯৮৩ সালে সুদমুক্ত ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে, যেখানে বলা হয়েছে, ইরানের ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য হবে ইসলামি আইন ও প্রবিধান অনুযায়ী ন্যায়বিচার ও ন্যায্যতাভিত্তিক একটি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। সুদান এমন আরেকটি উদাহরণ। পাকিস্তান ২০২৭ সালের শেষ নাগাদ তাদের ব্যাংক ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ইসলামি ব্যবস্থায় রূপান্তর করার লক্ষ্যে কাজ করছে। এর বাইরে বেশ কয়েকটি দেশ আছে, যেখানে দ্বৈত আর্থিক ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া অন্যতম।
মালয়েশিয়া বাংলাদেশের মতো ১৯৮৩ সালে ইসলামি ব্যাংকিং শুরু করার আগে ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে। ইসলামি বিমা শুরু করার আগে ১৯৮৪ সালে করে ইসলামি বিমা আইন। এই আইনগুলোকে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালে প্রণয়ন করে আরেকটি আইন। ২০১৩ সালের আইনটির অন্যতম বিষয়গুলোর মধ্যে আছে আমানত ও বিনিয়োগ হিসাব পৃথক্করণ। এর মাধ্যমে ইসলামি ব্যাংকিংয়ে ঝুঁকিবিহীন ও ঝুঁকিভিত্তিক হিসাবের পার্থক্য সুস্পষ্ট করা হয়, যা শরিয়াহর দৃষ্টিতে অতি জরুরি। আইনটির অন্য আরেকটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হচ্ছে শরিয়াহ বিচ্যুতির আলোকে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা। আইনটিতে সর্বোচ্চ আট বছরের জেল বা ২৫ মিলিয়ন রিঙ্গিত (আনুমানিক ৭০ কোটি টাকার সমান) বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই কঠোর শাস্তির বিধান রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইসলামি আর্থিক কার্যক্রমে জড়িত সবাই যেন শরিয়াহ পরিপালনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং কোনো ধরনের বিচ্যুতির সাহস যেন কেউ না করে।
মালয়েশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনেও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ইসলামি ব্যাংকিং ও আর্থিক ব্যবস্থার বিষয়ে তাদের দায়িত্ব কেমন হবে। যেমন সেটিতে বলা আছে, মালয়েশিয়ায় প্রচলিত ও ইসলামিক ব্যাংকিং সমান্তরালভাবে চলবে এবং মালয়েশিয়াকে ইসলামিক অর্থ ব্যবস্থার একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠায় এর কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকার ও অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে কাজ করবে। একই রকমভাবে পুঁজিবাজার আইনে ইসলামি পুঁজিবাজার শক্তিশালী করার বিষয়ে বিভিন্ন বিধান সংযোজন করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা একটু দেরিতে শুরু হলেও এখন তাদের অগ্রগতি খুবই দ্রুত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে তাদের প্রথম ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়, আর ইসলামি ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করে ২০০৮ সালে। বর্তমানে দেশটি কেবল ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা নয়, ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থায় মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার এগিয়ে যাওয়ার কারণ কেবল একটি আইন থাকা নয়, বরং এই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে। ২০১৬ সালে ইন্দোনেশিয়া জাতীয় ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতি কমিটি প্রতিষ্ঠা করে, যার প্রধান দেশটির প্রেসিডেন্ট। সদস্যদের মধ্যে আছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়, জাতীয় ওলামা কাউন্সিল ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো। মালয়েশিয়াও বিভিন্ন পর্যায়ে একই ধরনের কমিটি গঠন করেছে। দুই দেশই ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা ও অর্থনীতির বিষয়ে মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন করেছে, যেখানে পরিকল্পনার পাশাপাশি নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেছে। অর্থাৎ কত বছরের মধ্যে তারা কী অর্জন করতে চায় তা নির্ধারণ করেছে।
ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থায় লোকজনকে আকৃষ্ট করার জন্য দেশ দুটি নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে। যেমন, মালয়েশিয়ায় ইসলামি ব্যাংকিং শুরুর পর থেকে প্রতিটি বাজেটে ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থার জন্য কোনো না কোনো প্রণোদনা ছিল। ইসলামি অর্থনীতি-বিষয়ক শিক্ষা-গবেষণায়ও তারা ব্যাপক বিনিয়োগ করছে। মালয়েশিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনেক ধরনের উদ্যোগের পাশাপাশি একটি পূর্ণাজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছে কেবল ইসলামি অর্থনীতির বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার জন্য। মালয়েশিয়ার ২০২৫ সালের বাজেটে ১০ মিলিয়ন রিঙ্গিত বরাদ্দ দেওয়া হয় ইসলামি অর্থনীতি-বিষয়ক গবেষণায়। এর আগের বছর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল ২০ মিলিয়ন রিঙ্গিত।
প্রকৃত অর্থে ইসলামি অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ অন্য দেশগুলোর অভিজ্ঞতার দিকে তাকাতে পারে। কেবল ইসলামি ব্যাংকিং আইন নয়, প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উপযোগী আইনি কাঠামো। তার আগে প্রয়োজন ইসলামি অর্থনীতির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করা এবং এর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিত করা। সব থেকে জরুরি ইসলামি অর্থনীতি বিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করা।
লেখক: ইসলামি আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে মালয়েশিয়ার ইন্সইফ ইউনিভার্সিটিতে গবেষক হিসেবে কর্মরত
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
৮ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
৮ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
৮ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
১ দিন আগে