আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

সংকটাপন্ন হাদি ও গুলিবিদ্ধ ভোটের তফসিল

এম আবদুল্লাহ
সংকটাপন্ন হাদি ও গুলিবিদ্ধ ভোটের তফসিল
এম আবদুল্লাহ

জুলাই বিপ্লবী শরীফ ওসমান হাদির ঝাঁকড়া চুলের মাথা ঘাতকের গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছে। অজ্ঞান ও সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছেন হাসপাতালে। চিকিৎসকরা আশার কথা শোনাতে পারছেন না। এ লেখার সময় পর্যন্ত ডাক্তারের ভাষায় তিনি বেঁচে আছেন, তবে ডিপ কোমায়। শুক্রবার জুমার নামাজের পর দিনদুপুরে রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র পুরানা পল্টন কালভার্ট রোডে পয়েন্ট ব্ল্যাংক গুলি হাদির মাথার একদিক থেকে ঢুকে মগজ ভেদ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। চলন্ত রিকশায় বসা হাদিকে মোটরসাইকেল আরোহী নরপিশাচ ঘাতকরা পেছন থেকে অনুসরণ করে খুব কাছে রিভলভারের গুলিতে হত্যা নিশ্চিত করতে চায়। পালিয়ে যায় নির্বিঘ্নে। খবরটি জেনে স্তম্ভিত ও কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা অতিক্রান্ত না হতেই প্রচার চালানোর সময় একজন প্রার্থীকে হত্যাচেষ্টা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে।

ওসমান হাদি জুলাই বিপ্লবের আইকনিক ফিগার। ভারতীয় আগ্রাসন ও আওয়ামী ফ্যাসিবাদ থেকে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে অন্যতম নায়ক। তেত্রিশ বছর বয়সি হাদি এক দুরন্ত সাহসী ও অকুতোভয় দ্রোহের নাম। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও তাদের কালচারাল এস্টাব্লিশমেন্ট গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে হাদির সংগ্রামকে ভিলিফাই করে তাকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। শত্রুর সঙ্গেও ইনসাফ চাওয়া হাদিকেই আগ্রাসী ভারত ও তাদের সেবাদাস পতিত লীগ ভয় পেয়েছে। তার ইনসাফের কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে। জুলাই বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে ওসমান হাদি ইনসাফভিত্তিক নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য নিরলসভাবে লড়ে যাচ্ছিলেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আর শাহবাগিদের বিরুদ্ধে ওসমান হাদি এক উচ্চকিত কণ্ঠ।

বিজ্ঞাপন

চব্বিশের জুলাইয়ের পটভূমিতে জন্ম নেওয়া ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরীফ ওসমান বিন হাদি আগামী বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী। ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় তৎপর হয়েছিলেন তিনি। প্রতি শুক্রবারে জনসংযোগ করতেন। সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা রাজনৈতিক অঙ্গনে শুধু নয় সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক বিবেকবান মানুষকে ক্ষুব্ধ ও আলোড়িত করেছে। সুবিধাবাদিতা, চাটুকারিতা আর নতজানু মানসিকতার মানুষের ভিড়ে হাদিদের মতো নির্ভীক ও নির্ভেজাল দেশপ্রেমিকের সংখ্যা হাতে গোনা। সে কারণেই মহান আল্লাহর দরবারে হাদির জীবন ভিক্ষা চাচ্ছে অগণন মানুষ।

হাদির জীবন যে অনিরাপদ ছিল, তা একাধিকবার জানান দিয়েছেন তিনি নিজেই। গত নভেম্বরে হাদি নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট দিয়ে বলেন, দেশি-বিদেশি অন্তত ৩০টি ফোন নম্বর থেকে তাকে ফোন এবং মেসেজ পাঠিয়ে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে, তার বাড়িতে আগুন দেওয়া ও তার মা, বোন ও স্ত্রীকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, আওয়ামী লীগের ‘খুনি’ সমর্থকরা তাকে সর্বক্ষণ নজরদারিতে রাখছে। ‘জীবননাশের আশঙ্কা’ সত্ত্বেও তিনি ‘ইনসাফের লড়াই’ থেকে পিছিয়ে যাবেন না। ভারতীয় আগ্রাসন ও সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নিরাপস ভূমিকা এবং কড়া অথচ যুক্তিনির্ভর বক্তব্যের জন্য তিনি সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ আলোচিত ছিলেন।

আমার দেশ-এ প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় আগ্রাসন এবং আওয়ামী লীগের দেশবিরোধী কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অন্যতম সোচ্চার কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত শরীফ ওসমান হাদিসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন জুলাইযোদ্ধার ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা হতে পারে—এমন স্পর্শকাতর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরকারকে আগেই জানানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। টার্গেট কিলিংয়ের ওই তালিকায় হাদি ছাড়াও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ ও আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদসহ আরো কয়েকজন জুলাই সংগঠক রয়েছেন বলে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। গত সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী জনৈক আইনজীবীর সূত্রে প্রাপ্ত এ-সংক্রান্ত তথ্য যথাসময়ে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাসহ উচ্চপর্যায়ের কাছেও পৌঁছে দেওয়া হয়। এমনকি খোদ ওসমান হাদিসহ তিন জুলাইযোদ্ধা নিজেরাই হুমকির বিষয়টি সরকারের দায়িত্বশীলদের নজরে আনেন। এছাড়া পৃথকভাবে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী ওই আইনজীবী নিজেও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কয়েক দফা আলাপ করেন।

প্রতিবেদনে জানানো হয়, হত্যার হুমকির বিষয়টি নিয়ে ওই আইনজীবী সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে তার কাছে আসা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন। এ সময় তিনি তথ্যপ্রাপ্তির সুনির্দিষ্ট সূত্রেরও উল্লেখ করেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, পেশাগত কাজে বিশ্বের কয়েকটি দেশের গুরুত্বপূর্ণ সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার হাতে স্পর্শকাতর এসব তথ্য এসেছে। দ্রুততম সময়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া না হলে বিপদ আসন্ন বলেও সতর্ক করেন তিনি। এ ধরনের আগাম তথ্য আমলে না নেওয়া দুঃখজনক। এ ব্যাপারে সরকারের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া জরুরি।

Hadi

হাদিকে হত্যার চেষ্টাকে নির্বাচন ভন্ডুলের নীলনকশার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। হাদি বুলেটবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনি তফসিলেও সেই বুলেট আঘাত করেছে। প্রার্থীদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর আগে গত ৫ নভেম্বর চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামীতে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ও নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহর নির্বাচনি গণসংযোগে গুলির ঘটনা ঘটে। সেদিন বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে থাকা সরোয়ার হোসেন বাবলা নামের এক সন্ত্রাসী নিহত হয়। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অবশেষে ২৫ ডিসেম্বর দেশে ফিরছেন। এতদিন তার দেশে ফেরার বিলম্বের সঙ্গে নিরাপত্তার ইস্যুটি আলোচিত হয়েছে।

হাদিকে হত্যাচেষ্টার সঙ্গে নির্বাচন ভন্ডুলের লক্ষ অর্জনের চেষ্টা যতটা না রয়েছে, তার চেয়ে অধিকতর সম্পর্ক রয়েছে জুলাই বিপ্লবে বলিষ্ঠ ভূমিকা এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তার বুলন্দ আওয়াজ। সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী ইনফ্লুয়েন্সাররা একদিকে হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়াকে জাস্টিফাই করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, অন্যদিকে হত্যাচেষ্টার দায় নির্বাচনি আসনে বিএনপি প্রার্থীর দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। যদিও প্রাথমিকভাবে ঘাতকের যে মুখ চিহ্নিত হয়েছে, সে রাজধানীর আদাবর থানা ছাত্রলীগ নেতা। নাম ফয়সল করীম মাসুদ ওরফে দাউদ খান। ‘দ্য ডিসেন্ট’ নামক একটি সংবাদমাধ্যম ঘটনার ভিডিও ফুটেজ ও ৫০টিরও বেশি ছবি বিশ্লেষণ করে কিলারকে শনাক্ত করার দাবি করেছে।

শরীফ ওসমান হাদি দুর্বৃত্তদের গুলিতে গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দ্রুত ও ব্যাপক তদন্ত চালিয়ে হামলায় জড়িত সবাইকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তাৎক্ষণিক ফেসবুক পোস্টে দেওয়া বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এ হামলা বাংলাদেশের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। নির্বাচনি পরিবেশে এমন সহিংস হামলা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য এবং দেশের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য এটি অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশ সত্ত্বেও ঘটনায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে খুনিকে ছুঁতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকগুলো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডে খুনিরা ধরা পড়েছে বেশ দ্রুতই। আশা করা যায়, হাদির ঘটনায়ও ঘাতক ফসকে যাবে না বা সীমানা অতিক্রম করতে পারবে না।

দুই মাস পর অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলাই যে বড় চ্যালেঞ্জ, তা ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন। প্রতিবেশী দেশ থেকে কিলার গ্রুপকে দেশে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে পলাতক লীগ নেতাদের এক অডিওতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে প্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবার নিরাপত্তাবোধ নিশ্চিত করা না গেলে ইতিহাসসেরা নির্বাচনের প্রত্যাশা ফিকে হয়ে যেতে পারে। নির্বাচনি প্রচারণার সময় ওসমান হাদিকে একেবারে কাছে থেকে গুলির ঘটনায় দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতারা যে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠিত হয়েছেন, তাতেও এ বিষয়টিই স্পষ্ট হয়েছে।

গুলিবর্ষণের নিন্দা জানিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশ এখন অত্যন্ত সংকটের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী প্রতিটি দল ও ব্যক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তারেক রহমান বলেন, ‘আমরা দেখেছি গত এক বছরে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা হুমকি দিয়েছে প্রকাশ্যে যে প্রত্যাশিত নির্বাচন আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে, সে নির্বাচন তারা হতে দেবে না, বাধাগ্রস্ত করবে।’ একটি দল, গোষ্ঠী বা কিছু ব্যক্তি এই দেশকে দেশের মানুষের শান্তি স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

কারো নাম উল্লেখ না করে হাদির ওপর হামলাকে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বর্ণনা করে তারেক রহমান বলেন, ‘যারা এই দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতে চায়, তারা তাদের ষড়যন্ত্র ইতোমধ্যেই শুরু করেছে—ওসমান হাদির ঘটনাই তার প্রমাণ।’

গুলির ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, কেউ যদি আবার বাংলাদেশে নতুন করে ফ্যাসিজম বা সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চান, তাহলে খুব দেরি হবে না, যথাযথ জবাব পেয়ে যাবেন। জনগণ সব ষড়যন্ত্র রুখে দেবে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, কাউকে এ ধরনের নোংরামি করার সুযোগ দেওয়া হবে না। বাংলাদেশের মাটি কারো বাপ-দাদার জমিদারি নয়, এটা ১৮ কোটি মানুষের সম্পদ। তিনি বলেন, ‘একটা মেসেজ ভেরি ক্লিয়ার (বার্তা সুস্পষ্ট)—এই জাতি কোনো গুলিকে পরোয়া করবে না—ইনশাআল্লাহ। আমরা কোনো গুলির তোয়াক্কাও করি না।’

হাদির ওপর গুলির ঘটনায় দলমত-নির্বিশেষে যেসব প্রার্থী নির্বাচনি প্রচারের জন্য মাঠে থাকবেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জোরদার হয়েছে। বিশেষ করে, জুলাই বিপ্লবে সম্মুখসারির নেতাদের মধ্যে যারা নির্বাচনি মাঠে নামছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকারকে যে মনোযোগ দিতে হবে, তা এখন জোর দিয়েই বলা যায়। অনেকে বলছেন, জুলাই আন্দোলনের সৈনিকদের নিরাপত্তা এখন আর দাবি নয়, এটা রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত বাধ্যবাধকতা। হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা কোনো ব্যক্তির বিষয় নয়, জুলাই বিপ্লবের ওপর সরাসরি আঘাত হিসেবে দেখতে হবে। ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় কণ্ঠগুলোকে স্তব্ধ করাই এখন ফ্যাসিবাদের দেশি-বিদেশি ক্রীড়নকদের লক্ষ্য। তাই একে একে জুলাইযোদ্ধাদের টার্গেট করা হচ্ছে।

ভাইরাল অডিওতে এক আওয়ামী ক্যাডার দিল্লিতে আশ্রিত তার নেত্রীকে জুলাই বীরদের হত্যার পরিকল্পনার কথা জানালে অন্য প্রান্ত থেকে উসকানি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘পারলে করে দেখাও’। তার একদিনের মাথায় হাদিকে হত্যার চেষ্টা হলো। শুটার হিসেবে যার পরিচয় ইতোমধ্যে সামনে এসেছে, সে ভারতে পলাতক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খান কামাল ও জাহাঙ্গীর কবির নানকের লালিত কিলার গ্রুপের সদস্য। এর আগে অস্ত্রের মুখে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বড় অঙ্কের অর্থলুটের ঘটনায় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েও এক মাসের মধ্যে কীভাবে জামিনে মুক্তি পেল, তা এক বড় বিস্ময়।

ওসমান হাদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১০-১১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। একসময় ইংরেজি শেখার কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করেছেন হাদি। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব স্কলারস নামে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা করছিলেন বলেও জানা যায়। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না হাদি; তিনি সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কাজ করতেন, একাধিক বইও লিখেছেন। অদম্য তরুণ হাদি নির্ঝঞ্জাট, নিরাপদ স্বাচ্ছন্দ্যের জীবন বেছে নিতে পারতেন। কিন্তু অপরিমেয় দেশপ্রেম ও জাতির প্রতি, গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে জীবন তুচ্ছ করে লড়াই করে যাচ্ছিলেন।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ওসমান হাদির হাত ধরে গড়ে ওঠে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম ‘ইনকিলাব মঞ্চ’। ‘সব ধরনের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ’ সংগঠনটির ঘোষিত মূল লক্ষ্য। হাদি প্রচলিত ধারার সব রাজনৈতিক দলেরই কমবেশি সমালোচনা করতেন। গত জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাদি বলেছিলেন, বিএনপি যদি ‘পুরোনো ধারায়’ রাজনীতি করে ক্ষমতায় আসে, তবে তারা দুই বছরও ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। শহীদ জিয়ার আদর্শে অনুরক্ত ছিলেন। জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্বকে পূর্বসূরিদের ত্যাগ ও আদর্শের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। নবগঠিত এনসিপিরও কোনো কোনো পদক্ষেপের গঠনমূলক সমালোচনা করতেন কড়া ভাষায়।

গুলিবিদ্ধ হওয়ার একদিন আগে ওসমান হাদি বলেছিলেন, ‘আমাদের বুকে গুলি চালানোর আগ পর্যন্ত কাউকে আমরা প্রতিরোধ করব না’—সেই মানুষটা আজকে গুলিবিদ্ধ হয়ে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তার নিরাপত্তা রাষ্ট্র দিতে পারেনি, নাগরিক হিসেবেও পাশে দাঁড়িয়ে নিরাপত্তাবর্ম তৈরিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। হাদি প্রমাণ করেছেন, তাদের মতো বিপ্লবীদের কোনো ভয় থাকে না, মৃত্যুকে পরোয়া করে না। যারা কাপুরুষের মতো গুলি করে বিপ্লবকে শেষ করতে চায়, তারাই প্রকারান্তরে বিপ্লবের যথার্থতা প্রমাণ করছে। ওরা পিশাচ, নরাধম। তারা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য হত্যা করে, ক্ষমতায় থাকার জন্য নির্বিচারে খুন-গুম করে, আবার পলাতক অবস্থান থেকে ক্ষমতায় ফেরার নেশায় ছাত্র-জনতার জীবন নিয়ে খেলা করে। তাদের শেষ ঠিকানা যে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে তা অনুধাবনের সক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় ফ্যাসিবাদবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তিকে দলীয় সংকীর্ণ স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে, একচ্ছত্র ক্ষমতার উচ্চাভিলাষ ত্যাগ করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন