বিবেকবর্জিত সেইসব নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২: ২৮

মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে সোহাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের বিবেককে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। জানা গেছে, যারা হত্যা করেছে এবং হত্যার শিকার সোহাগ—উভয় পক্ষই বিএনপির অঙ্গসংগঠন যুবদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। প্রথমে শোনা গিয়েছিল, চাঁদা না দেওয়ায় সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে। পরে জানা গেল, চাঁদা নয়, ব্যবসার হিস্যা নিয়ে বিরোধের জের। তবে যে কারণেই ঘটে থাকুক না কেন—এই নিষ্ঠুর, এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড কেউ মেনে নিতে পারছে না। পুরো দেশের মানুষ স্তম্ভিত।

বিজ্ঞাপন

তবে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, তা হচ্ছে—আওয়ামী শাসন আমলে এ ধরনের অপরাধের দায় স্বীকার করা হতো না; কিন্তু বিএনপি আর যাই হোক দায় স্বীকার করে অপরাধীদের দল থেকে বহিষ্কার করছে। এটি ভালো একটা দিক। কিন্তু বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ইতোমধ্যে তিন হাজারের অধিক দলীয় নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করা হলেও চাঁদাবাজিসহ ইত্যাদি অপরাধের ঘটনা থামছেই না। এতে মনে হচ্ছে, দলের নেতাকর্মীদের ওপর শীর্ষ নেতাদের নিয়ন্ত্রণ হয়তো শিথিল হয়ে পড়েছে।

যাইহোক, সোহাগ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করা হচ্ছে। তবে কোনো কোনো মহল থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় এমনভাবে বিস্ময় ও ঘৃণা প্রকাশ করছে, তাতে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসন কত না ভালো ছিল! তাই আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের নিবর্তনমূলক শাসনের আগে ও পরের কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করা দরকার হয়ে পড়েছে। তার অর্থ এই নয় যে সোহাগ হত্যাকাণ্ডকে পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বরং ওইসব ঘটনা এ কারণেই উল্লেখ করতে হচ্ছে, আমরা খুব তাড়াতাড়ি সবকিছু ভুলে যাই।

নিশ্চয়ই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের কথা অনেকের মনে আছে। সেদিন ছিল বিএনপি সরকারের ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার দিন। সে উপলক্ষে বিএনপি নয়াপল্টনে, জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে সমাবেশের আয়োজন করেছিল। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার আহ্বানে লগি-বৈঠা হাতে নিয়ে দলীয় নেতাকর্মী উপস্থিত হয়েছিল গুলিস্তানে। তারপর শুরু হয় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকাশ্যে দিবালোকে পিটিয়ে হত্যা করার সেই নিষ্ঠুর ঘটনা। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা লগি-বৈঠা নিয়ে মিছিল করে জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশে আক্রমণ চালিয়ে পিটিয়ে অনেককে হত্যা করে। সারা দেশেই তিন দিন ধরে চলেছিল লগি-বৈঠার হত্যালীলা। সেই তিন দিনে সারা দেশে ৪০ জনের মতো নিহত হওয়ার ঘটনা তখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আহত হয়েছিল আরো অনেকে।

অন্যদিকে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর জগন্নাথ কলেজ এলাকায় বিশ্বজিৎ দাস হত্যার সেই নিষ্ঠুর ঘটনা তো সহজে কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। সেদিন সরকারবিরোধী একটি আন্দোলন চলছিল। দরজির কাজ করে জীবন নির্ভাহকারী বিশ্বজিৎ নিত্যদিনের মতো পার হচ্ছিল জগন্নাথ কলেজ এলাকা। আর তখনই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা অসহায় এই তরুণ যুবককে প্রথমে কিল-চড়-ঘুসি, তারপর চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। বিশ্বজিৎ কোনো দলের ছিল না। তাই নিরপরাধ যুবকের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড তখন সারা দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক ঘৃণা ও ক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল।

কিংবা বুয়েটের সেই মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এদেশের মানুষের স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করছে। আহ! কি নিষ্ঠুরভাবে এই প্রতিভাবান তরুণকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিটিয়ে হত্যা করেছিল, তা স্মরণ করে এখনো এদেশের মানুষ শিউরে ওঠে। কী অপরাধ ছিল তার? শুধু সে ফেসবুকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসী ভূমিকা সম্পর্কে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিল মাত্র। সেই অপরাধে তাকে এভাবে পৈশাচিক উল্লাসে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। যদিও পরে আবরারের সেই দেশপ্রেম জুলাই বিপ্লবের মুখ্য প্রেরণা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর আবরারের পথ অনুসরণ করে এই প্রজন্মের তরুণরা ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রাখা একটি ঐক্য গড়ে তুলেছে। সেই সঙ্গে জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা দলবল নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অতি সাধারণ মানুষও বুঝতে সক্ষম হয়েছে, ভারত কীভাবে আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদী শাসন চালিয়ে যেতে সহায়তা করেছিল।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতি পর্বে পর্বেই আওয়ামী লীগ কিংবা ছাত্রলীগ-যুবলীগের অহিংসতা ও নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের অনেক ঘটনা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে। বিশিষ্ট সাংবাদিক আহমদ মুসার লেখা ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক গ্রন্থে ১৯৭২-৭৫ সালের আওয়ামী জামানার অনেক নিষ্ঠুর ঘটনার কথা বিধৃত হয়েছে।

এদিকে উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ছাত্রলীগের হামলায় কমপক্ষে ৩৩ জন নিহত এবং ৫০০ জন গুরুতর আহত হয়। আবার ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ কর্তৃক ১২৯ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৭ সালে ৩১ জন নিহত হয়। এ সময়ের মধ্যে ছাত্রলীগ নিজেদের মধ্যে ৫০০ বার সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল। এতে নিজেদের কর্মী নিহত হয়েছিল ৫৫ জন। পরে জুলাই বিপ্লবের সময় সরকার বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরাও আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। ওই যৌথ আক্রমণে ১৪০০ নিহত এবং আহত হয়েছিল ২২ হাজার। এসব সহিংস আক্রমণ ছাড়াও ছাত্রলীগ ক্রমাগতভাবে ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রদের ওপর আক্রমণ চালাত। তারই প্রেক্ষাপটে ১৯২২ সালের ২৬ মে আটটি বাম ছাত্র সংগঠন একটি জোট গঠন করে ছাত্রলীগকে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করেছিল।

যাইহোক, ছাত্রলীগের ওইসব সন্ত্রাসী ঘটনার উদ্ধৃতি দেওয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে : জুলাই বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে এ ধরনের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও সহিংসতা এদেশের মানুষ আর দেখতে চায় না। তাই সোহাগ হত্যার ঘটনা মানুষের মধ্যে এতটা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। সুতরাং যারা এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হবে, তাদেরই জনগণ নিক্ষেপ করবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।

পরিশেষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আমাদের এই আহ্বান থাকবে, আপনারা পরিবহন চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবেন। ইতোমধ্যে বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও নিষ্ঠুর সব হত্যাকাণ্ডের জন্য জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। তাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সরকারের দায়িত্ব।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত