ড. মু. মোসলেহ উদ্দীন হাসান
দ্য ইকোনমিস্টের বিচারে ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর এত দেশের মধ্যে বর্ষসেরা, তা আমরা সবাই জানি। ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ দেশে এটাই যেন ফ্যাসিবাদের শেষ অধ্যায় হয়, এ জন্য বিভিন্ন সংস্কার চলছে। সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো নিয়ে সমালোচনা আছে; তবু এরা এমন এমন বিষয়ের উন্মোচন করছে কিংবা প্রশ্ন নিয়ে আসছে, যা পঞ্চাশ বছর ধরে সবাই অনুভব করেছে কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারেনি। দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধে বসে আছে। দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে এবার রাষ্ট্র সংস্কার হতেই হবে।
প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে প্রাথমিক একটা সংবাদ সম্মেলন হতেই বিতর্কের শুরু। উপসচিব এবং তদূর্ধ্ব পদগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ, ৫০ শতাংশের প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব এসেছে। এতে উভয় পক্ষ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের যুক্তি, প্রত্যেক ক্যাডারে কিছু শীর্ষ পদ আছে। যার যে ক্যাডার, তারা সেই ক্যাডারের বা সংস্থার শীর্ষ পদে চলে যেতে পারেন। প্রশাসন ক্যাডারের তো মন্ত্রিপরিষদ কিংবা জনপ্রশাসন সচিব ছাড়া এ ধরনের নির্ধারিত শীর্ষ পদ নেই। এ জন্য তারা অন্যসব মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলো নিজেদের পদ হিসেবে গণ্য করেন।
অন্য ক্যাডারের যুক্তি হলোÑএত দিন এভাবেই হয়ে এসেছে। দেশের সমস্ত শীর্ষ পদ, সমস্ত সুযোগ প্রশাসন ক্যাডার একা ভোগ করেছে। কিন্তু এতে কতটা এগিয়েছে দেশ? অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুযোগ কুক্ষিগত করে দেশের কী লাভ হয়েছে? বরং প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া দাপট দেশকে ফ্যাসিবাদের পূর্ণ কবজায় ঢুকে যেতে সাহায্য করেছে।
ফ্যাসিবাদের পক্ষে শক্তভাবে মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মসজিদ মাদরাসায় পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসরদের তারা বসিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ টিকেই ছিল, প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারের ওপর ভর করে, এমন কথা বারবার এসেছে। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার বিনিময় তারা দুহাত ভরে নিয়েছেন। পদ না থাকা সত্ত্বেও শত শত সুপারনিউমারি পদোন্নতি, উপসচিব হতেই ভাতাসহ গাড়ি নিয়েছেন, উপজেলাপর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকারকে অকার্যকর করে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন।
অন্যদিকে ২৬ ক্যাডার কি ধুয়া তুলসীপাতা ছিল? নিশ্চয় নয়। আর অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর নামে সংগঠন গড়ে তুলে অনৈতিক সুবিধা, পদপদবি বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে সম্মিলিতভাবে সারাদেশে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে একজোট হয়ে ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য নির্বাচন পাল্টে দেওয়াসহ বড় ধরনের অপরাধ করার অভিযোগ একমাত্র প্রশাসন এবং পুলিশের বিরুদ্ধেই উঠেছে।
বাংলাদেশে কিছু নিয়োগ নিয়ে ইদানীং খুব হাসাহাসি হয়েছে। মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পারসোতে নিয়োগ পেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত একজন কৃষিবিদ, যিনি জীবনে কখনো এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেননি। একইভাবে বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটে শীর্ষ পদ দখল করেছেন নদী গবেষণার সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই যুগ্মসচিব পর্যায়ের প্রশাসন ক্যাডার।
বাংলাদেশ অসংখ্য সরকারি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ও জোগানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে শুধু অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতাবিহীন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শীর্ষ পদগুলোয় পদায়নের জন্য। বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা স্বাধীনতার পর থেকে শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এদের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো গল্প তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমালোচনা ‘ইগোসেন্ট্রিক’ হওয়া। ওনাদের অনেকেই নিজেদের সব সময় ‘সুপেরিয়র’ ভাবতে ভালোবাসেন। তাদের ‘স্যার’ না ডাকলে কী হয়, সেটা আমরা জেলা এবং উপজেলাপর্যায়ে বিগত বছরগুলোয় দেখেছি। ঔদ্ধত্য দেখানোর একপর্যায়ে দলবাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক উপজেলাপর্যায়ের অন্য কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরানোর উদাহরণও আমরা দেখেছি। কথায় কথায় নির্বাহী বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যদের শাসন করার অনেক উদাহরণ তৈরি হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য ‘ইকোনমিক ক্যাডার’ নামে একটি ক্যাডার ছিল। কারণ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প, অর্থনৈতিক সম্পর্ক- বিদেশি দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ধারাবাহিক এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। পদোন্নতি নিয়ে এই ক্যাডারের কিছু ক্ষোভ ছিল। কম জনসংখ্যার ছোট ক্যাডার।
এ তুলনায় সিনিয়র পদ কম। এই সুযোগে প্রশাসন ক্যাডার ইকোনমিক ক্যাডারকে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। পরিকল্পনা কমিশনে সব ক্যাডারের প্রকল্প নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। সব এক ক্যাডারের হাতে থাকলে বাকিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয় বৈকি। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পার পাবে না।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রকল্পে যে পরিমাণ অপচয় হয়েছে, গত ৫৩ বছরেও তা হয়নি। এত মুখরোচক উদাহরণ কখনো শোনা যায়নি। উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট করার জন্য কোনো ‘এস আলম’ প্রশাসনে সরাসরি ঢোকেনি। সবকিছুই প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের হাত দিয়েই গেছে। ওনারাই সংস্থা থেকে প্রকল্প পাঠিয়েছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ওনারাই প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন।
সিনিয়র কর্মকর্তারা সবাই একতাবদ্ধ। লুটপাটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের কজন নজির সৃষ্টি করতে পেরেছেন বিগত ফ্যাস্টিস্ট আমলে? লুটপাট, ভোট ডাকাতি, গণ-আন্দোলন দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা একতাবদ্ধ থাকার ক্ষেত্রেই বরং অনেক নজির স্থাপন করেছেন।
ব্রিটেনে, নেদারল্যান্ডসে মেধাভিত্তিক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন সার্ভিস যেমন জেনারেল, টেকনোক্র্যাট, ডিপ্লোম্যাট, ইকোনমিক, পুলিশÑ এসব সার্ভিসে সবার চাকরি শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকারের জন্য ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস চালু আছে। এখানে ক্যাডার, নন-ক্যাডার এ ধরনের কোনো শব্দ নেই। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের দায়িত্ব হলো মেধা, দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদায়ন।
ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে জেনারেল, টেকনোক্র্যাট স্পেশালিস্ট (যেমন : অর্থনীতি, পররাষ্ট্র) এ ধরনের সার্ভিস আছে। এক সার্ভিসের লোক নিজের ক্যারিয়ার, যোগ্যতা, আগ্রহ এবং স্কিলের ওপর ভিত্তি করে সহজেই অন্য সার্ভিসে যেতে পারেন। সিনিয়র পদগুলো প্রতিযোগিতামূলক। মেধা, যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে এসব পদে নিয়োগ হয়। জেনারেল ক্যাডার টেকনোক্র্যাটনির্ভর পদে যেতে পারবে না কিংবা টেকনোক্র্যাটরা জেনারেল পদে যেতে পারবেন নাÑ এ ধরনের কোনো প্রথা নেই। ২৫-৩০ বছর চাকরি করলে একজন কর্মকর্তার একটা পোর্ট ফোলিও দাঁড়িয়ে যায়।
তার নিজের কাজের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, স্কিল, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অতীত অবদান এসব পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্রিটেনে সিনিয়র পদে নিয়োগ হয় এসবের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
তাই বলে প্রশাসনের একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের জন্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, নদী গবেষণা কেন্দ্র কিংবা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি সরাসরি উন্মুক্ত হয়ে যায় না। একইভাবে সচিব, সিনিয়র সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডার হলেই তিনি সরাসরি নিয়োগের সুযোগ লাভ করেন না। তাকে পরীক্ষা দিয়ে, পোর্ট ফোলিও তৈরি করে, প্রতিযোগিতা করেই পদে আসীন হতে হয়।
বাংলাদেশ আজ একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ যেমন অনেক, সম্ভাবনাও তেমনি বিশাল। তদুপরি রয়েছে খুবই দ্রুত বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ধরার অনিবার্য তাগিদ। এই যুগসন্ধিক্ষণে দেশের নীতিনির্ধারণে খুবই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত আসা প্রয়োজন।
এমন প্রশাসন ও পরিচালন (governance) দরকার, যা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, দ্রুত নিতে পারে, সরকারি দল বা শীর্ষ কোনো ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে শ্বেতহস্তী হতে পারে-এ রকম যেকোনো প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তাই প্রশাসন বা বাকি ২৬ ক্যাডার কোনোপক্ষের আন্দোলন বিবেচনা না করে, সবার যুক্তি শুনে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক, নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
দ্য ইকোনমিস্টের বিচারে ২০২৪ সালের বর্ষসেরা দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কেন পৃথিবীর এত দেশের মধ্যে বর্ষসেরা, তা আমরা সবাই জানি। ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।
এ দেশে এটাই যেন ফ্যাসিবাদের শেষ অধ্যায় হয়, এ জন্য বিভিন্ন সংস্কার চলছে। সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলো নিয়ে সমালোচনা আছে; তবু এরা এমন এমন বিষয়ের উন্মোচন করছে কিংবা প্রশ্ন নিয়ে আসছে, যা পঞ্চাশ বছর ধরে সবাই অনুভব করেছে কিন্তু কোনো সুরাহা করতে পারেনি। দেশের মানুষ আশায় বুক বেঁধে বসে আছে। দেড় হাজারের অধিক ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে এবার রাষ্ট্র সংস্কার হতেই হবে।
প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে প্রাথমিক একটা সংবাদ সম্মেলন হতেই বিতর্কের শুরু। উপসচিব এবং তদূর্ধ্ব পদগুলোয় প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা গ্রহণ, ৫০ শতাংশের প্রশাসন ক্যাডারের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রস্তাব এসেছে। এতে উভয় পক্ষ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।
প্রশাসন ক্যাডারের যুক্তি, প্রত্যেক ক্যাডারে কিছু শীর্ষ পদ আছে। যার যে ক্যাডার, তারা সেই ক্যাডারের বা সংস্থার শীর্ষ পদে চলে যেতে পারেন। প্রশাসন ক্যাডারের তো মন্ত্রিপরিষদ কিংবা জনপ্রশাসন সচিব ছাড়া এ ধরনের নির্ধারিত শীর্ষ পদ নেই। এ জন্য তারা অন্যসব মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদগুলো নিজেদের পদ হিসেবে গণ্য করেন।
অন্য ক্যাডারের যুক্তি হলোÑএত দিন এভাবেই হয়ে এসেছে। দেশের সমস্ত শীর্ষ পদ, সমস্ত সুযোগ প্রশাসন ক্যাডার একা ভোগ করেছে। কিন্তু এতে কতটা এগিয়েছে দেশ? অন্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের সুযোগ কুক্ষিগত করে দেশের কী লাভ হয়েছে? বরং প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া দাপট দেশকে ফ্যাসিবাদের পূর্ণ কবজায় ঢুকে যেতে সাহায্য করেছে।
ফ্যাসিবাদের পক্ষে শক্তভাবে মাঠ নিয়ন্ত্রণ করে নির্বাচনগুলো পরিচালনা করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ, মসজিদ মাদরাসায় পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের দোসরদের তারা বসিয়েছেন। ফ্যাসিবাদ টিকেই ছিল, প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারের ওপর ভর করে, এমন কথা বারবার এসেছে। ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার বিনিময় তারা দুহাত ভরে নিয়েছেন। পদ না থাকা সত্ত্বেও শত শত সুপারনিউমারি পদোন্নতি, উপসচিব হতেই ভাতাসহ গাড়ি নিয়েছেন, উপজেলাপর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান স্থানীয় সরকারকে অকার্যকর করে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেছেন।
অন্যদিকে ২৬ ক্যাডার কি ধুয়া তুলসীপাতা ছিল? নিশ্চয় নয়। আর অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর নামে সংগঠন গড়ে তুলে অনৈতিক সুবিধা, পদপদবি বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তবে সম্মিলিতভাবে সারাদেশে সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে একজোট হয়ে ফ্যাসিবাদ টিকিয়ে রাখার জন্য নির্বাচন পাল্টে দেওয়াসহ বড় ধরনের অপরাধ করার অভিযোগ একমাত্র প্রশাসন এবং পুলিশের বিরুদ্ধেই উঠেছে।
বাংলাদেশে কিছু নিয়োগ নিয়ে ইদানীং খুব হাসাহাসি হয়েছে। মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্পারসোতে নিয়োগ পেয়েছেন প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত একজন কৃষিবিদ, যিনি জীবনে কখনো এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেননি। একইভাবে বাংলাদেশ নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটে শীর্ষ পদ দখল করেছেন নদী গবেষণার সঙ্গে কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই যুগ্মসচিব পর্যায়ের প্রশাসন ক্যাডার।
বাংলাদেশ অসংখ্য সরকারি মালিকানাধীন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ও জোগানের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে শুধু অভিজ্ঞতা ও সংশ্লিষ্টতাবিহীন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শীর্ষ পদগুলোয় পদায়নের জন্য। বিসিআইসি (বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন), বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থা স্বাধীনতার পর থেকে শুধু রুটিন দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এদের ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো গল্প তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে জনপ্রশাসনের সবচেয়ে বড় সমালোচনা ‘ইগোসেন্ট্রিক’ হওয়া। ওনাদের অনেকেই নিজেদের সব সময় ‘সুপেরিয়র’ ভাবতে ভালোবাসেন। তাদের ‘স্যার’ না ডাকলে কী হয়, সেটা আমরা জেলা এবং উপজেলাপর্যায়ে বিগত বছরগুলোয় দেখেছি। ঔদ্ধত্য দেখানোর একপর্যায়ে দলবাজ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক উপজেলাপর্যায়ের অন্য কর্মকর্তাকে হাতকড়া পরানোর উদাহরণও আমরা দেখেছি। কথায় কথায় নির্বাহী বিচারিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে অন্যদের শাসন করার অনেক উদাহরণ তৈরি হয়েছে।
উন্নয়ন প্রকল্প বিষয়ে বিশেষজ্ঞ জ্ঞান নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পরিচালনার জন্য ‘ইকোনমিক ক্যাডার’ নামে একটি ক্যাডার ছিল। কারণ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে প্রকল্প, অর্থনৈতিক সম্পর্ক- বিদেশি দাতা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ধারাবাহিক এবং বিশেষজ্ঞ জ্ঞানের প্রয়োজন হয়। পদোন্নতি নিয়ে এই ক্যাডারের কিছু ক্ষোভ ছিল। কম জনসংখ্যার ছোট ক্যাডার।
এ তুলনায় সিনিয়র পদ কম। এই সুযোগে প্রশাসন ক্যাডার ইকোনমিক ক্যাডারকে নিজেদের সঙ্গে একীভূত করে ফেলে। পরিকল্পনা কমিশনে সব ক্যাডারের প্রকল্প নিয়ে আসা-যাওয়া করতে হয়। সব এক ক্যাডারের হাতে থাকলে বাকিদের নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয় বৈকি। কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে পার পাবে না।
সাম্প্রতিক উন্নয়ন প্রকল্পে যে পরিমাণ অপচয় হয়েছে, গত ৫৩ বছরেও তা হয়নি। এত মুখরোচক উদাহরণ কখনো শোনা যায়নি। উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট করার জন্য কোনো ‘এস আলম’ প্রশাসনে সরাসরি ঢোকেনি। সবকিছুই প্রশাসনের সিনিয়র কর্মকর্তাদের হাত দিয়েই গেছে। ওনারাই সংস্থা থেকে প্রকল্প পাঠিয়েছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে ওনারাই প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন।
সিনিয়র কর্মকর্তারা সবাই একতাবদ্ধ। লুটপাটের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের কজন নজির সৃষ্টি করতে পেরেছেন বিগত ফ্যাস্টিস্ট আমলে? লুটপাট, ভোট ডাকাতি, গণ-আন্দোলন দমনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা একতাবদ্ধ থাকার ক্ষেত্রেই বরং অনেক নজির স্থাপন করেছেন।
ব্রিটেনে, নেদারল্যান্ডসে মেধাভিত্তিক নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন সার্ভিস যেমন জেনারেল, টেকনোক্র্যাট, ডিপ্লোম্যাট, ইকোনমিক, পুলিশÑ এসব সার্ভিসে সবার চাকরি শুরু হয়। ব্রিটিশ সরকারের জন্য ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিস চালু আছে। এখানে ক্যাডার, নন-ক্যাডার এ ধরনের কোনো শব্দ নেই। ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের দায়িত্ব হলো মেধা, দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মকর্তা নিয়োগ, প্রশিক্ষণ ও পদায়ন।
ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসে জেনারেল, টেকনোক্র্যাট স্পেশালিস্ট (যেমন : অর্থনীতি, পররাষ্ট্র) এ ধরনের সার্ভিস আছে। এক সার্ভিসের লোক নিজের ক্যারিয়ার, যোগ্যতা, আগ্রহ এবং স্কিলের ওপর ভিত্তি করে সহজেই অন্য সার্ভিসে যেতে পারেন। সিনিয়র পদগুলো প্রতিযোগিতামূলক। মেধা, যোগ্যতার ওপর ভিত্তি করে এসব পদে নিয়োগ হয়। জেনারেল ক্যাডার টেকনোক্র্যাটনির্ভর পদে যেতে পারবে না কিংবা টেকনোক্র্যাটরা জেনারেল পদে যেতে পারবেন নাÑ এ ধরনের কোনো প্রথা নেই। ২৫-৩০ বছর চাকরি করলে একজন কর্মকর্তার একটা পোর্ট ফোলিও দাঁড়িয়ে যায়।
তার নিজের কাজের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, স্কিল, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে অতীত অবদান এসব পরিষ্কার হয়ে যায়। ব্রিটেনে সিনিয়র পদে নিয়োগ হয় এসবের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে।
তাই বলে প্রশাসনের একজন কর্মকর্তাকে পদায়নের জন্য মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র, নদী গবেষণা কেন্দ্র কিংবা ট্রান্সপোর্ট কো-অর্ডিনেশন অথরিটি সরাসরি উন্মুক্ত হয়ে যায় না। একইভাবে সচিব, সিনিয়র সচিব নিয়োগের ক্ষেত্রেও নির্দিষ্ট কোনো ক্যাডার হলেই তিনি সরাসরি নিয়োগের সুযোগ লাভ করেন না। তাকে পরীক্ষা দিয়ে, পোর্ট ফোলিও তৈরি করে, প্রতিযোগিতা করেই পদে আসীন হতে হয়।
বাংলাদেশ আজ একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের চ্যালেঞ্জ যেমন অনেক, সম্ভাবনাও তেমনি বিশাল। তদুপরি রয়েছে খুবই দ্রুত বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীর ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ধরার অনিবার্য তাগিদ। এই যুগসন্ধিক্ষণে দেশের নীতিনির্ধারণে খুবই সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত আসা প্রয়োজন।
এমন প্রশাসন ও পরিচালন (governance) দরকার, যা নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে, দ্রুত নিতে পারে, সরকারি দল বা শীর্ষ কোনো ব্যক্তির দিকে না তাকিয়ে শ্বেতহস্তী হতে পারে-এ রকম যেকোনো প্রকল্পকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। তাই প্রশাসন বা বাকি ২৬ ক্যাডার কোনোপক্ষের আন্দোলন বিবেচনা না করে, সবার যুক্তি শুনে দেশ ও জনগণের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই এখন সময়ের দাবি।
লেখক : অধ্যাপক, নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
এই বছর অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে উদ্ভাবন ও সৃজনশীল ধ্বংসের প্রক্রিয়া (creative destruction) কীভাবে দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে সেই গবেষণার ওপর। নতুন প্রযুক্তি ও ধারণা পুরোনো ব্যবস্থাকে প্রতিস্থাপন করে সমাজ যখন পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত থাকে, তখনই টেক
১৪ ঘণ্টা আগে‘মনের তালা খুলল কে, চাবিওয়ালা, চাবিওয়ালা!’ প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লার সেই সুরেলা প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি! তবে ব্যক্তিগত জীবনে নয়, রাষ্ট্রীয় জীবনে। এই রাষ্ট্রের জীবনেও একটা বিশেষ তালা আছে, আর তার নাম আর্টিকেল ৭০! এই তালা লাগানো হয়েছিল সেই সব মাননীয়র জন্য, যাদের মধ্যে ‘ছাগলীয়’ প্রবৃত্তি রয়ে
১৪ ঘণ্টা আগেভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে প্রায়ই তার পরম বন্ধু বলে বেশ গৌরবের সঙ্গে প্রচার করে থাকেন। ভিন্ন দেশের এ দুই রাজনীতিবিদের প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মূল সূত্র হলো মুসলমানদের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা। বর্তমান বিশ্বে ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত শীর্ষ দুটি
১৪ ঘণ্টা আগেগাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন হতাশা চরমে, তখনই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন এক নতুন ‘২০ দফার শান্তি পরিকল্পনা’। সেখানে তিনি নিজেকে বসিয়েছেন একটি তথাকথিত ‘বোর্ড অব পিস’-এর চেয়ারম্যান হিসেবে।
২ দিন আগে