আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

রেমিট্যান্স বনাম মেধাপাচার

আকবর আলী রাতুল
রেমিট্যান্স বনাম মেধাপাচার
ছবি: সংগৃহীত

উন্নত শিক্ষা ও ভবিষ্যতের আশায় বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার মেধাবী শিক্ষার্থী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। অনেকে স্কলারশিপে, কেউবা পরিবার বা আত্মীয়স্বজনের আর্থিক সহায়তায় উচ্চশিক্ষার গন্তব্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া কিংবা ইউরোপের বিভিন্ন দেশকে বেছে নিচ্ছে। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো, এই শিক্ষার্থীদের বিশাল একটি অংশ শিক্ষাজীবন শেষে দেশে ফিরে আসছে না। একইভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সমৃদ্ধ করে, যা আমদানি ব্যয় মেটাতে সহায়ক। তবে এই রেমিট্যান্সের আড়ালে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সেখানে স্থায়ী হচ্ছে। এ প্রবণতাকে বলা হচ্ছে মেধাপাচার, যা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনিসংকেত।

এর পেছনে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নিরাপত্তাহীনতাই বিদেশে স্থায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ। অধিকাংশ মানুষই মনে করে, দেশে ফিরে নিজেদের স্বপ্ন বা গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব, বিশেষ করে যারা উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, চিকিৎসা কিংবা উচ্চতর বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত। দেশে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ ও সম্মানজনক সুযোগের অভাবের পাশাপাশি গবেষণার যথাযথ অবকাঠামো, স্বাধীন চিন্তার পরিসর ও মেধার যথাযথ মূল্যায়নের ঘাটতি অনেক প্রতিভাবান তরুণকে বিদেশে স্থায়ী হতে প্ররোচিত করছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশে উচ্চ বেতন ও জীবনযাত্রার মান বিদেশের তুলনায় অনেক কম। যেখানে বিদেশে তারা সহজেই নিজেদের মেধা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে, সেখানে দেশে ফিরে বেকারত্বের মুখোমুখি হওয়া কিংবা দক্ষতার তুলনায় কম মর্যাদাপূর্ণ পেশায় নিযুক্ত হওয়া তাদের দেশে ফেরার জন্য নিরুৎসাহজনক।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (BMET) তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১১ দশমিক ৩৫ লাখ এবং ২০২৩ সালে ১৩ দশমিক ০৭ লাখ এবং ২০২৪ সালে ১০ দশমিক ১১ লাখের বেশি কর্মী বিদেশে গেছেন। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশই অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার এবং চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৯ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত ২৪ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। তবে এই রেমিট্যান্সের বেশিরভাগই অদক্ষ বা স্বল্পদক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো। অন্যদিকে উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ পেশাজীবীরা উন্নত জীবনের খোঁজে উন্নত দেশগুলোয় পাড়ি জমাচ্ছেন এবং সেখানেই স্থায়ী হয়ে সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন, যা মেধাপাচার হিসেবে বিবেচিত এবং দেশের জন্য উদ্বেগজনক।

ইউনেস্কোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে বাংলাদেশ থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গেছেন ২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী এবং কর্মসংস্থানের জন্য গেছেন প্রায় ৩৪ দশমিক ৩ লাখ কর্মী। এই পরিসংখ্যান দেশের মানবসম্পদ ও অর্থনীতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলছে। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে গমনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, যা দেশের জন্য মেধাপাচার হিসেবে বিবেচিত। এই প্রবণতা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়ন, গবেষণা, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে দীর্ঘমেয়াদি বাধা সৃষ্টি করবে।

একটি রাষ্ট্রের উন্নয়ন নির্ভর করে তার দক্ষ মানবসম্পদের ওপর। কিন্তু মেধাবীদের একের পর এক দেশত্যাগের ফলে দক্ষ ও উচ্চ প্রশিক্ষিত জনশক্তির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসা, প্রযুক্তি, প্রকৌশল, গবেষণা, নীতিনির্ধারণসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই যোগ্য নেতৃত্বের সংকট ক্রমেই বাড়ছে। এই অভাব পূরণে যখন অদক্ষ বা মাঝারি মানের জনবল দিয়ে কাজ চালানো হবে, তখন দীর্ঘ মেয়াদে কাজের মানে প্রভাব পড়ায় উন্নয়ন থেমে যাবে পরিকল্পনার আগেই। উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যাওয়া এবং স্থায়ী হওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীই দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করে, সরকারি ভর্তুকিতে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায় অতিক্রম করে। তাদের মেধা ও জ্ঞান ভবিষ্যতে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার কথা থাকলেও তারা বিদেশে থেকে গিয়ে অন্য দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। এতে করে বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া ধীরগতির হয়ে পড়বে এবং মানবসম্পদের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। বিরাট শূন্যতা তৈরি হচ্ছে গবেষণা ও উদ্ভাবনেও। যারা পদার্থবিজ্ঞান, বায়োটেকনোলজি, তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাখায় গবেষণায় পারদর্শী, তারা উন্নত সুযোগ-সুবিধার আশায় দেশ ত্যাগ করছে। ফলে দেশীয় গবেষণায় সংকট তৈরি হচ্ছে এবং টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে দেশে নিজস্ব প্রযুক্তি, ওষুধ, কৃষি উন্নয়ন বা জ্বালানি উদ্ভাবনের হার কমে যায়। উদ্ভাবননির্ভর না হয়ে দেশ হয়ে পড়বে দীর্ঘ মেয়াদে প্রযুক্তিনির্ভর। এতে আত্মনির্ভরশীলতা হারিয়ে বিদেশনির্ভরতা বাড়বে। একইভাবে সংকট তৈরি হচ্ছে প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ে ভবিষ্যতের দক্ষ নেতৃত্বেরও। কারণ নেতৃত্ব দেওয়ার উপযুক্ত ব্যক্তিরা বিদেশে গিয়ে করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা করছেন বা অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করছেন। এর ফলে দীর্ঘ মেয়াদে দক্ষ ও আদর্শ নেতৃত্ব থেকে বাংলাদেশের বঞ্চিত হওয়ার তীব্র আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

বিশ্বব্যাপী যেসব দেশ নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদের রয়েছে নিজস্ব থিংক ট্যাংক ও পলিসি মেকারদের একটি শক্তিশালী ভান্ডার। তবে আমাদের মেধাবীদের যথেষ্ট সক্ষমতা থাকলেও তারা বিদেশে থেকে উন্নত দেশগুলোকেই সমৃদ্ধ করছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সিদ্ধান্তগ্রহণকারী দেশগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তেমনিভাবে মেধাবীরা বিদেশে থাকলে দেশে উদ্যোক্তা বাড়ে না, বরং রেমিট্যান্সনির্ভর মনোভাব গড়ে ওঠে। বিদেশে বসে অনেকে দেশে অর্থ পাঠালেও তা দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই উন্নয়ন সৃষ্টি করতে পারে না। উদ্যোক্তা না থাকলে নতুন শিল্প, কর্মসংস্থান ও পুঁজির প্রবাহ ব্যাহত হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়ে এবং দেশের মধ্যে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, যেখানে সবাই মনে করে ‘দেশে কিছু হয় না’। এ অবস্থা সামাজিকভাবে ‘উন্নত জীবনমান’ বা ‘বিদেশ মানেই ভালো’ এমন মানসিকতা তৈরি করছে, যা তরুণসমাজকে দেশপ্রেমের বদলে স্বার্থনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে জাতীয়তাবোধ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা কমে যাচ্ছে।

মেধাপাচার একদিকে যেমন ব্যক্তি উন্নয়নের গল্প, অন্যদিকে তা জাতীয় অগ্রগতির এক নীরব বিপর্যয়। এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য দেশের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো, আন্তর্জাতিক মানের কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং মেধাবীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি যারা বিদেশে পড়াশোনা শেষে ফিরতে চান, তাদের জন্য চাকরি বা গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। অতএব মেধাপাচার শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের বিষয় নয়, এটি একটি জাতীয় সংকট। এই সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রকে সুপরিকল্পিত ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে, নতুবা আগামী দিনে আমাদের উন্নয়ন কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

লেখক : শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

নির্বাচনে কোনো দলে নয়, স্বতন্ত্র হয়ে লড়বেন আসিফ মাহমুদ

নিজের পোস্টার নিজেই নামালেন জামায়াত প্রার্থী শিশির মনির

বদরুন্নেসার শিক্ষা সফরে ঢাকা কলেজের বাস, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে জব্দকৃত ট্যাংকার বন্দরে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

মাঝ আকাশে বিমানের দরজা খোলার চেষ্টা, যাত্রী গ্রেপ্তার

এলাকার খবর
খুঁজুন