Ad T1

শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার

খোন্দকার মো. নাজমুল হুদা শামিম
প্রকাশ : ১১ মে ২০২৫, ১১: ৪৯

স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার দেশের সব নাগরিকের একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫(ক) নম্বর অনুচ্ছেদে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আবার সংবিধানের ১৮(১) নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্যের উন্নতি রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য। এ কারণে গ্রাম কিংবা শহরাঞ্চলে বসবাসকারী স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া জনগণের একটি সাংবিধানিক অধিকার। বিশ্বের যেসব দেশে শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মস্থান শহরমুখী হওয়ায় প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে।

বাংলাদেশের আদমশুমারি অনুসারে ১৯৭৪ সালে শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা যেখানে ছিল মোট জনসংখ্যার মাত্র ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ, বর্তমানে তা ৩০ শতাংশে উপনীত হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০৪০ সালের মধ্যে দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেক শহরাঞ্চলে বসত গড়বে। নগরায়ণ তথা অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে একসময়ের গ্রাম্য এলাকাগুলো শহর হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে, যা শহরাঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

বাড়ন্ত জনসংখ্যার চাপে শহরগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে না, ফলে শহরে বসবাসকারীদের প্রাপ্য ন্যূনতম নাগরিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থাপনাও কঠিন হয়ে পড়েছে। শহরের ধনী ও সচ্ছল শ্রেণির মানুষ এ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হলেও দরিদ্র জনগণ অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা শহরের বিভিন্ন অনুন্নত এলাকায় এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তথা বস্তিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, কমিউনিটি ক্লিনিক, স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র এবং উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সমন্বিত নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সেখানে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা সহজেই দেওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে, টারশিয়ারি স্তরের হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকের ভিড়ে শহরাঞ্চলে অনুরূপ নেটওয়ার্ক তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। এর প্রভাবে শহরের দরিদ্র মানুষ, যাদের কাছে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চিকিৎসাব্যয় বহন কষ্টসাধ্য, তারা নানা সংক্রামক-অসংক্রামক, জটিল ও দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।

২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন এবং স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন অনুযায়ী দেশের সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকাবাসীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত। একই সঙ্গে, এলাকায় রোগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, জাতীয় জনসংখ্যা নীতি ও লক্ষ্য অর্জন, পুষ্টি বিষয়ে জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, স্বাস্থ্যসেবা জোরদার করা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন এবং কর্মক্ষমতার উন্নয়ন, প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে টেকসই স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করার দায়িত্বও তাদের ওপর বর্তায়।

২০০৯ সালে স্থানীয় সরকারবিষয়ক দুটি আইন পাসের অনেক আগেই সরকার ১৯৯৮ সালে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার প্রজেক্ট শুরু করে। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় স্থানীয় সরকার বিভাগ প্রকল্পটি চলমান রেখে ২০১২ সালে আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রজেক্ট (ইউপিএইচসিএসডিপি) নামে এর ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। বর্তমানে ইউপিএইচসিএসডিপির দ্বিতীয় পর্যায়ে ১১টি সিটি করপোরেশন এবং ১৮টি পৌরসভা এলাকায় ৪৫টি মাতৃসদন, ১৬৭টি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং ৩৩৪টি স্যাটেলাইট ক্লিনিকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট শহরবাসী, বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, মা ও শিশুদের স্বল্পমূল্যে উন্নত প্রাথমিক চিকিৎসা এবং রোগপ্রতিরোধী সেবা দেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিকভাবে সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভাগুলোর স্বাস্থ্য বিভাগ এই বৃহৎ কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রস্তুত না থাকায় অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রকল্পটি শুরু হয়েছিল। এই অংশীদারত্ব বর্তমানেও অটুট আছে কেননা স্বাস্থ্যসেবার মতো একটি কার্যক্রমে ক্রমবিকাশমান বেসরকারি খাতের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। তবে প্রকল্পভুক্ত প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের কার্যক্রমে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধিদের।

ইউপিএইচসিএসডিপি-দ্বিতীয়পর্যায়ের মাধ্যমে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ২ লাখের বেশি লাল কার্ড বিতরণ করে অতি দরিদ্রদের বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হচ্ছে। দেশের শহরাঞ্চলের ১ কোটি ৭০ লাখের বেশি মানুষ বর্তমানে এ প্রকল্পে সেবার আওতাভুক্ত। এই যে এক বিশাল কর্মযজ্ঞ, এর কার্যকারিতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে প্রয়োজন জনপ্রতিনিধিদের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব। স্বাস্থ্যসেবার মতো একটি মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে তারা তাদের জনভিত্তি আরো মজবুত করতে পারবেন।

চিকিৎসক এবং জনপ্রতিনিধিদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে চিকিৎসাসেবার গুণগত মানের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং পর্যায়ক্রমে জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে সেবাকেন্দ্রগুলো টেকসই করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ইউপিএইচসিএসডিপি প্রকল্পে যুক্ত সংশ্লিষ্ট সবাইকে দরিদ্র জনসাধারণের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবার আলো ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : যুগ্মসচিব ও প্রকল্প পরিচালক

আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিস ডেলিভারি প্রজেক্ট- দ্বিতীয়পর্যায়

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত