
মাহমুদুর রহমান

আমাদের প্রবল প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি বিশ্বে ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান ও ভারত নামে পরিচিত। আজকের আলোচনা অর্থবহ করার জন্য আমাদের ‘ভারত’ নামের উৎপত্তি সংক্ষেপে জেনে রাখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এই উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের সঙ্গেই ‘ভারত’ নামটি সম্পর্কিত। ব্রাহ্মণদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে এই ‘ভারত’ শব্দটি বহু শ্লোকে ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে ‘ভারত’ বলতে ক্ষেত্রবিশেষে বাইরে থেকে এই উপমহাদেশে আগত আর্যগোষ্ঠী ও কাল্পনিক প্রাচীন প্রতাপশালী কোনো একজন আর্য রাজাকেও বোঝানো হয়েছে। বায়ু পুরাণে লেখা আছে, ‘যে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ জয় করবে, তাকে সম্রাটের অভিধায় ভূষিত করা হবে।’
বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, ‘যে দেশটি সমুদ্রের উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণের তুষারমণ্ডিত পর্বতরাশি পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে ভারতের বংশধররা বসবাস করে।’ অত্যন্ত জনপ্রিয় পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতের ভাষ্য অনুযায়ী, দুষ্মন্তের পুত্রের নাম ভারত। ভারতের পুত্ররা বংশপরম্পরায় কথিত ‘আর্যাবর্ত’ শাসন করেছে এবং এই ভারত থেকেই ‘ভারতবর্ষ’ এসেছে। ভারত নামের পেছনে যে নানারকম সাংস্কৃতিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, সেটা বোঝার জন্যই এসব হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি জানা দরকার। সেসব পৌরাণিক ব্যাখ্যার আলোকেই আমি বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী ভারতপন্থিদের শ্রেণিবিভাগ করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ভারতপন্থিরা চরিত্রভেদে পাঁচ প্রকারে বিভক্ত।
১ .
অখণ্ড ভারতপন্থি : নব্বই দশকের প্রথমার্ধে আমি চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ বহুজাতিক কোম্পানির আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যনগরীর অন্যান্য করপোরেট হাউসের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে নিয়মিত আড্ডায় বসতাম। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করার পর একদিন আমরা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে তর্ক করছিলাম। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ে বেজায় হতাশ এক তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ ভদ্রলোক সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন, “১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়াটাই বিরাট ভুল হয়েছে।
জিন্নাহ ‘দেশভাগ’ না করলে ভারত বিশ্বে আজ এক প্রধান শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারত এবং আমরা সেই দেশের নাগরিক থাকতাম।” আড্ডার বিএনপি-সমর্থকরা তাকে ভারতে মুসলমানদের দুর্দশার কথা মনে করিয়ে দিলেও খুব একটা লাভ হলো না। বাবরি মসজিদ নিয়ে চরমপন্থি হিন্দুরা তখন তুমুল আন্দোলন করছিল। কদিন পরপর ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লোমহর্ষক কাহিনি সারা দুনিয়ার মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছিল। সেসব উদাহরণও তাকে দেখালাম। কিন্তু তাতেও কোনো ফায়দা হলো না। ভদ্রলোকটি তার অখণ্ড ভারততত্ত্বে অবিচল রইলেন। আসলে লোকটি ঘটনাচক্রে মুসলমান পরিবারে জন্মলাভ করলেও ইসলাম ধর্ম অথবা বিশ্বের মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি তিনি কোনোরকম নৈকট্য অনুভব করতেন না। তার মতো লোকরা নাস্তিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ নন, তারা সবাই চরম ইসলামবিদ্বেষী। আওয়ামী লীগ, দেশের বাম দলগুলো ও সুশীল গোষ্ঠীর মধ্যে চট্টগ্রামের সেই ব্যক্তির মতো অখণ্ড ভারতপন্থিদের সংখ্যা নিতান্ত কম হবে না।
২.
ধর্মীয় ভারতপন্থি : লেখার প্রথমেই হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ‘ভারত’ শব্দটির নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছি। যদিও আর্যরা উপমহাদেশের পূর্বাংশের আদি জনগণকে অনেকটা ঘৃণার নজরেই দেখত, তবু বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতের সঙ্গে কেবল ধর্মীয় কারণে অধিকতর একাত্মতা অনুভব করে থাকেন। ঋগ্বেদে আমাদের অঞ্চলের কালো গাত্রবর্ণের অধিবাসীদের দস্যু, রাক্ষস প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্র জনগোষ্ঠীকে (উত্তরবঙ্গ) দস্যু এবং মহাভারত ও ভগবৎ পুরাণে বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী জনগণকে ম্লেচ্ছ, কিরাত, যবন প্রভৃতি নামে উল্লেখ করে তাদের পাপিষ্ঠ বলা হয়েছে। এসব ইতিহাস জানা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতকের হিন্দু লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁর নামে বাঙালি হিন্দুদের অখণ্ড ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। হিন্দু মানসে সেই বাঙালি রেনেসাঁর নিট ফল হয়েছিল, উপমহাদেশের মুসলমানদের বহিরাগত ধরে নিয়ে তাদের চিরশত্রু রূপে গণ্য করা। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাসবিমুখতা ও মুসলমান-বিদ্বেষের দুটি উদাহরণ এখানে দেওয়া আবশ্যক মনে করছি।
প্রথম উদাহরণ হলো, মোদির ভারতের স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইতে কুষাণ বংশের সম্রাট কনিষ্ককে এক মহান ভারতীয় সম্রাট হিসেবে প্রচার করলেও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরকে একজন বহিরাগত এবং ঘৃণ্য ও অত্যাচারী শাসক রূপে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। অথচ কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাবর উভয়ই মধ্য এশিয়া অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে এসে প্রায় দেড় হাজার বছরের ব্যবধানে যার যার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চীন ও মোঙ্গল মিলিত বংশের ইউয়েজি গোত্রের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কনিষ্ককে ভারতীয় হিসেবে মেনে নিলেও কেবল মুসলমান হওয়ার কারণে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মোঙ্গল ও উজবেক বংশোদ্ভূত ফারগানার বাবরকে ভারতীয় সম্রাট মানতে একেবারেই রাজি নন। কট্টর হিন্দুরা বাইরে থেকে আসা কনিষ্ককে রীতিমতো পূজা করলেও বাবরকে প্রবলভাবে ঘৃণা করে। দ্বিতীয় উদাহরণ তুলনামূলকভাবে অনেক সাম্প্রতিক। বাঙালি হিন্দুরা
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল, কারণ তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ১৫০ বছর ধরে অত্যাচারিত ও অবহেলিত বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রোধ করে তবেই ছয় বছরব্যাপী সন্ত্রাসী আন্দোলনে ক্ষান্ত দিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতাকারী সেই বাঙালি হিন্দুরাই ১৯৪৭ সালে পুরো ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গিয়ে বাংলা ভাগ করতে ব্রিটিশদের বাধ্য করেছিল, কারণ তারা একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি। তাদের ভাষায় ম্লেচ্ছ বাঙালি মুসলমানরা শাসকের আসনে বসবে, এটা শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুরা কিছুতেই মানতে পারেনি। তারা ১৯০৫ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ ভাগ করে হলেও ১৯৪৭ সালে ভারতের অংশ হতে চেয়েছিল। একই ধরনের হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও ইসকন চট্টগ্রামের নেতা চিন্ময়ের মতো কট্টর ‘ধর্মীয় ভারতপন্থি’ হিন্দুরা বাংলাদেশকে ভারতভুক্ত করার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি।
৩.
সাংস্কৃতিক ভারতপন্থি : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক জগৎ ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতপন্থিদের করায়ত্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে লেখা হয়েছিল, সেই গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান তাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কে মূর্খতার প্রমাণ দিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের নির্বুদ্ধিতার ফলে ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেবতা হিসেবে দেখার যে প্রবণতা আরম্ভ হয়েছিল, সেটা অনেকাংশে এ দেশে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব বিস্তারের পথ সুগম করেছে। সেই থেকে বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ক্রমেই অবহেলিত হয়েছে। প্রায় ৮০০ বছর আগে বাংলায় স্বাধীন মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস আমরা অনেক আগেই বিস্মৃত হয়েছি। বৃহত্তর বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের স্ত্রী ফুলওয়ারা বেগম যে বাঙালি ছিলেন এবং তাদের সন্তান আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ পিতার মৃত্যুর পর যে দীর্ঘ ৩২ বছর (১৩৫৮-১৩৯০) বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব করেছেন, সেই ইতিহাসই বা আমরা কতজন জানি? অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পিতা পারস্যের সিস্তান অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে এলেও তার মা বাঙালি ছিলেন।
১৯৪৭ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু জমিদারদের অবজ্ঞা ও জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের পক্ষে যে গণতান্ত্রিকভাবে রায় দিয়েছিলেন, সেই সত্যটাও বিগত আট দশকে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বাঙালিত্ব অর্জন করতে গিয়ে সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামকে পরিত্যাগ করতে চেয়েছে। একাত্তরের চেতনার নামে যে বয়ান ফেরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করেছে। এ দেশে অধিকাংশ মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে মাথায় টুপি এবং মুখে দাড়ি থাকা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি নাট্যপরিচালক ও লেখকরা অধিকাংশ হিন্দু চরিত্রকে মহৎ হিসেবে দেখিয়েছেন।
অপরদিকে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতিটি সোপ অপেরায় পূজা-অর্চনা করা বাঙালি হিন্দু সমাজের এক অতিগুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র কাজ হিসেবে দেখালেও বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম পালনকে ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতা হিসেবেই দেখিয়েছেন আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মহান কবি আল মাহমুদ ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়লে তার মতো এত বিরাট মাপের কবিকেও অনাদরে ও অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ‘সাংস্কৃতিক ভারতপন্থিরা’ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে দেড় দশকে সর্বপ্রকারে সহায়তা দিয়েছে। এদের হাত থেকে মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মুক্তি ঘটিয়েই এ দেশের বাঙালি মুসলমানের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। আশা করা গিয়েছিল, জুলাই বিপ্লবের পর ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অবসান ঘটবে। বিস্ময়করভাবে একসময়কার কথিত ভারতবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা আবারও আওয়ামী ও ভারতীয় বয়ানে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থা এবং মৌলবাদের উত্থানের ভয় দেখাচ্ছেন।
৪.
দাসানুদাস ভারতপন্থি : আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দল দিল্লির সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে আবদ্ধ। এই অঞ্চলের বাম রাজনৈতিক দলের দাসসুলভ মানসিকতার সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। উদাহরণস্বরূপ সিলেট রেফারেন্ডামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের সেই রেফারেন্ডামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ সিলেট ও করিমগঞ্জের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিলেও কমিউনিস্ট পার্টির ভারতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে পার্টির পূর্বাঞ্চলের সদস্যরা ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার তোয়াক্কা কমিউনিস্ট পার্টি কখনো করেনি। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলেও সেক্যুলারিজমের মুখোশে এসব বাম দল চরম ইসলামবিদ্বেষ লালন করেছে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ডিপ স্টেটের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর। ব্রিটিশ আমলে যুক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে বাঙালি হিন্দুরা প্রকৃতপক্ষে কোনোদিনই পছন্দ করেনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রধানত মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে দাঙ্গায় মুসলমানদের পক্ষাবলম্বনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে তার প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের বিদ্বেষ আরো তীব্র হয়। সোহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালের পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করলে দিল্লির সঙ্গে দলটির নিবিড় যোগাযোগের পথ সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বহুল আলোচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সংযোগের কথা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কারণে অস্বীকার করলেও শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা আগরতলা ষড়যন্ত্রের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে শেখ মুজিব ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী রূপে চরম বিতর্কিত ও অত্যাচারী ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের সামরিক বাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হলে তার দুই কন্যা দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছিলেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ছয় বছর দিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ট্রেনিং নিয়ে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। ৪৩ বছর পর গত বছরের জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি পালিয়ে দিল্লিতে সেই ‘র’-এর কাছেই ফিরে গিয়ে ভারতের ডিপ স্টেটের প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। আওয়ামী লীগ এবং উপরে বর্ণিত বামদের বাইরে উল্লেখযোগ্য দলগুলোর মধ্যে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিও ‘দাসানুদাস ভারতপন্থিদের’ অন্তর্ভুক্ত। পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, ২০২৪ সালের ‘আমি ও ডামির’ নির্বাচনের কিছুদিন আগে দলটির তৎকালীন প্রধান নেতা জিএম কাদের দিল্লি সফর করে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বলেছিলেন, ভারতের নির্দেশ ছাড়া তিনি সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা জনগণকে বলতে পারবেন না। দাসত্বের এর চেয়ে খোলামেলা স্বীকারোক্তি আর হতে পারে না। উপরোক্ত ‘দাসানুদাস ভারতপন্থি’ গোষ্ঠী সর্বদাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে।
৫.
হীনম্মন্য ভারতপন্থি : বাংলাদেশের একদল ভীরু ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা, বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী, টকশো স্টার এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে প্রায়ই এই নসিহত শুনতে পাবেন যে, ভারতের মতো এক বিশাল এবং শক্তিধর প্রতিবেশীকে সন্তুষ্ট না রেখে আমরা নাকি সঠিকভাবে ও শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হব না। এই শ্রেণিকেই আমি ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ নামে ডেকে থাকি। অথচ বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর আমরা ভারতের ওপর রাজনৈতিক, সামরিক, কিংবা অর্থনৈতিক—কোনো কারণেই আর একতরফাভাবে নির্ভরশীল নই। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিবেচনায় ভারত বরঞ্চ বাংলাদেশ দ্বারা বিপুলভাবে উপকৃত। ১৮ কোটি নাগরিকের এই দেশটি ভারতের এক বিশাল রপ্তানি বাজার ও প্রবাসী আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ড. ইউনূস সরকারের বিগত এক বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উদ্ধত শাসকগোষ্ঠী কোনো অযৌক্তিক বিরোধ সৃষ্টি করলে আমাদের বৃহৎ ও শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বরং বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পলাতক হাসিনা ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার যে ‘মিথ’ ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে তৈরি করেছিলেন, সেটি আল্লাহর অসীম রহমতে বাংলাদেশের জনগণ স্বল্প সময়ের মধ্যে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে আমরা ভারতবেষ্টিত, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও বাস্তবতা যে, ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ রাজ্যগুলো বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করা গেলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশের এসব হীনম্মন্য ব্যক্তিদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো শেখাতে আমাদের হয়তো আরো কিছুকাল অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। হীনম্মন্যতা রোগটি যেহেতু মানসিক, তাই চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি হওয়া আবশ্যক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য উপরোক্ত পাঁচ শ্রেণির ভারতপন্থিদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কৌশল প্রণয়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নব্বই দশকের শেষার্ধ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছে যে, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘দাসানুদাস ভারতপন্থি’ ও ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ হওয়ার বেশ দৃশ্যমান প্রবণতা রয়েছে। ভারতের সম্মতি ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না, অথবা গেলেও টিকে থাকা যায় না বলেও অনেক নেতা মনে করেন। ২০১৮ সালে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে আমি নরেন্দ্র মোদিকে হিন্দুত্ববাদী ও গুজরাটের কসাই বলায় দলটির নীতিনির্ধারকরা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে আমার সমালোচনা বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা সেদিন মনে করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে হাসিনার প্রচ্ছন্ন দালাল হিসেবেও সাব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন।
সেদিনই আমি শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলটির ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। এখন অবশ্য একসময়কার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলটি আমাকে মৌলবাদী, ইসলামি চরমপন্থি এবং একাত্তরের চেতনাবিরোধী মনে করে থাকে। যাই হোক, আজকের দীর্ঘ লেখায় আমি আগের মতোই জনগণকে সতর্ক করার জন্য নানারকম লেবাসে ভারতীয় দালালগোষ্ঠীর চেহারা চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের আদর্শকে ধারণ করে যারা রাজনীতি করতে চান, ভারতপন্থার বিষয়ে তাদের অন্তত চোখ খুলুক—এই আশাবাদ নিয়েই আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করলাম।

আমাদের প্রবল প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি বিশ্বে ইন্ডিয়া, হিন্দুস্থান ও ভারত নামে পরিচিত। আজকের আলোচনা অর্থবহ করার জন্য আমাদের ‘ভারত’ নামের উৎপত্তি সংক্ষেপে জেনে রাখা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। এই উপমহাদেশে আর্যদের আগমনের সঙ্গেই ‘ভারত’ নামটি সম্পর্কিত। ব্রাহ্মণদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদে এই ‘ভারত’ শব্দটি বহু শ্লোকে ব্যবহার করা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে ‘ভারত’ বলতে ক্ষেত্রবিশেষে বাইরে থেকে এই উপমহাদেশে আগত আর্যগোষ্ঠী ও কাল্পনিক প্রাচীন প্রতাপশালী কোনো একজন আর্য রাজাকেও বোঝানো হয়েছে। বায়ু পুরাণে লেখা আছে, ‘যে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ জয় করবে, তাকে সম্রাটের অভিধায় ভূষিত করা হবে।’
বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, ‘যে দেশটি সমুদ্রের উত্তর অংশ থেকে দক্ষিণের তুষারমণ্ডিত পর্বতরাশি পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে ভারতের বংশধররা বসবাস করে।’ অত্যন্ত জনপ্রিয় পৌরাণিক গ্রন্থ মহাভারতের ভাষ্য অনুযায়ী, দুষ্মন্তের পুত্রের নাম ভারত। ভারতের পুত্ররা বংশপরম্পরায় কথিত ‘আর্যাবর্ত’ শাসন করেছে এবং এই ভারত থেকেই ‘ভারতবর্ষ’ এসেছে। ভারত নামের পেছনে যে নানারকম সাংস্কৃতিক ও ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মীয় ব্যাখ্যা রয়েছে, সেটা বোঝার জন্যই এসব হিন্দু পৌরাণিক কাহিনি জানা দরকার। সেসব পৌরাণিক ব্যাখ্যার আলোকেই আমি বাংলাদেশের হিন্দুত্ববাদী ভারতপন্থিদের শ্রেণিবিভাগ করার চেষ্টা করেছি। আমি মনে করি, বাংলাদেশের ভারতপন্থিরা চরিত্রভেদে পাঁচ প্রকারে বিভক্ত।
১ .
অখণ্ড ভারতপন্থি : নব্বই দশকের প্রথমার্ধে আমি চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ বহুজাতিক কোম্পানির আঞ্চলিক প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই বাণিজ্যনগরীর অন্যান্য করপোরেট হাউসের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে নিয়মিত আড্ডায় বসতাম। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে জয়লাভ করার পর একদিন আমরা নতুন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে তর্ক করছিলাম। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ে বেজায় হতাশ এক তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ ভদ্রলোক সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন, “১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়াটাই বিরাট ভুল হয়েছে।
জিন্নাহ ‘দেশভাগ’ না করলে ভারত বিশ্বে আজ এক প্রধান শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারত এবং আমরা সেই দেশের নাগরিক থাকতাম।” আড্ডার বিএনপি-সমর্থকরা তাকে ভারতে মুসলমানদের দুর্দশার কথা মনে করিয়ে দিলেও খুব একটা লাভ হলো না। বাবরি মসজিদ নিয়ে চরমপন্থি হিন্দুরা তখন তুমুল আন্দোলন করছিল। কদিন পরপর ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার লোমহর্ষক কাহিনি সারা দুনিয়ার মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছিল। সেসব উদাহরণও তাকে দেখালাম। কিন্তু তাতেও কোনো ফায়দা হলো না। ভদ্রলোকটি তার অখণ্ড ভারততত্ত্বে অবিচল রইলেন। আসলে লোকটি ঘটনাচক্রে মুসলমান পরিবারে জন্মলাভ করলেও ইসলাম ধর্ম অথবা বিশ্বের মুসলমান জনগোষ্ঠীর প্রতি তিনি কোনোরকম নৈকট্য অনুভব করতেন না। তার মতো লোকরা নাস্তিক কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ নন, তারা সবাই চরম ইসলামবিদ্বেষী। আওয়ামী লীগ, দেশের বাম দলগুলো ও সুশীল গোষ্ঠীর মধ্যে চট্টগ্রামের সেই ব্যক্তির মতো অখণ্ড ভারতপন্থিদের সংখ্যা নিতান্ত কম হবে না।
২.
ধর্মীয় ভারতপন্থি : লেখার প্রথমেই হিন্দু ধর্মের সঙ্গে ‘ভারত’ শব্দটির নিবিড় সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছি। যদিও আর্যরা উপমহাদেশের পূর্বাংশের আদি জনগণকে অনেকটা ঘৃণার নজরেই দেখত, তবু বাঙালি হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতের সঙ্গে কেবল ধর্মীয় কারণে অধিকতর একাত্মতা অনুভব করে থাকেন। ঋগ্বেদে আমাদের অঞ্চলের কালো গাত্রবর্ণের অধিবাসীদের দস্যু, রাক্ষস প্রভৃতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুণ্ড্র জনগোষ্ঠীকে (উত্তরবঙ্গ) দস্যু এবং মহাভারত ও ভগবৎ পুরাণে বাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী জনগণকে ম্লেচ্ছ, কিরাত, যবন প্রভৃতি নামে উল্লেখ করে তাদের পাপিষ্ঠ বলা হয়েছে। এসব ইতিহাস জানা সত্ত্বেও ঊনবিংশ শতকের হিন্দু লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তথাকথিত বাঙালি রেনেসাঁর নামে বাঙালি হিন্দুদের অখণ্ড ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী চেতনা ও দর্শনের সঙ্গে মিলিত হয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রাণিত করেছেন। হিন্দু মানসে সেই বাঙালি রেনেসাঁর নিট ফল হয়েছিল, উপমহাদেশের মুসলমানদের বহিরাগত ধরে নিয়ে তাদের চিরশত্রু রূপে গণ্য করা। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাসবিমুখতা ও মুসলমান-বিদ্বেষের দুটি উদাহরণ এখানে দেওয়া আবশ্যক মনে করছি।
প্রথম উদাহরণ হলো, মোদির ভারতের স্কুল-কলেজের ইতিহাস বইতে কুষাণ বংশের সম্রাট কনিষ্ককে এক মহান ভারতীয় সম্রাট হিসেবে প্রচার করলেও মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবরকে একজন বহিরাগত এবং ঘৃণ্য ও অত্যাচারী শাসক রূপে চিত্রিত করা হয়ে থাকে। অথচ কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং বাবর উভয়ই মধ্য এশিয়া অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে এসে প্রায় দেড় হাজার বছরের ব্যবধানে যার যার সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। চীন ও মোঙ্গল মিলিত বংশের ইউয়েজি গোত্রের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী কনিষ্ককে ভারতীয় হিসেবে মেনে নিলেও কেবল মুসলমান হওয়ার কারণে কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা মোঙ্গল ও উজবেক বংশোদ্ভূত ফারগানার বাবরকে ভারতীয় সম্রাট মানতে একেবারেই রাজি নন। কট্টর হিন্দুরা বাইরে থেকে আসা কনিষ্ককে রীতিমতো পূজা করলেও বাবরকে প্রবলভাবে ঘৃণা করে। দ্বিতীয় উদাহরণ তুলনামূলকভাবে অনেক সাম্প্রতিক। বাঙালি হিন্দুরা
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল, কারণ তৎকালীন বড়লাট লর্ড কার্জনের সিদ্ধান্তের ফলে প্রায় ১৫০ বছর ধরে অত্যাচারিত ও অবহেলিত বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সেদিন হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গ রোধ করে তবেই ছয় বছরব্যাপী সন্ত্রাসী আন্দোলনে ক্ষান্ত দিয়েছিল। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতাকারী সেই বাঙালি হিন্দুরাই ১৯৪৭ সালে পুরো ১৮০ ডিগ্রি উল্টে গিয়ে বাংলা ভাগ করতে ব্রিটিশদের বাধ্য করেছিল, কারণ তারা একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের বাস্তবতা মেনে নিতে পারেনি। তাদের ভাষায় ম্লেচ্ছ বাঙালি মুসলমানরা শাসকের আসনে বসবে, এটা শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দুরা কিছুতেই মানতে পারেনি। তারা ১৯০৫ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘সোনার বাংলা’ ভাগ করে হলেও ১৯৪৭ সালে ভারতের অংশ হতে চেয়েছিল। একই ধরনের হিন্দুত্ববাদী মানসিকতার ফলেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও ইসকন চট্টগ্রামের নেতা চিন্ময়ের মতো কট্টর ‘ধর্মীয় ভারতপন্থি’ হিন্দুরা বাংলাদেশকে ভারতভুক্ত করার স্বপ্ন বিসর্জন দিতে পারেনি।
৩.
সাংস্কৃতিক ভারতপন্থি : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক জগৎ ইসলামবিদ্বেষী ও ভারতপন্থিদের করায়ত্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে গানটি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে লেখা হয়েছিল, সেই গান বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করার মাধ্যমে বাঙালি মুসলমান তাদের সাংস্কৃতিক দেউলিয়াত্ব ও ইতিহাস সম্পর্কে মূর্খতার প্রমাণ দিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের নির্বুদ্ধিতার ফলে ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমান পরিবারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেবতা হিসেবে দেখার যে প্রবণতা আরম্ভ হয়েছিল, সেটা অনেকাংশে এ দেশে ভারতের সাংস্কৃতিক প্রভুত্ব বিস্তারের পথ সুগম করেছে। সেই থেকে বাঙালি মুসলমানের হাজার বছরের ঐতিহ্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি ক্রমেই অবহেলিত হয়েছে। প্রায় ৮০০ বছর আগে বাংলায় স্বাধীন মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ইতিহাস আমরা অনেক আগেই বিস্মৃত হয়েছি। বৃহত্তর বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের স্ত্রী ফুলওয়ারা বেগম যে বাঙালি ছিলেন এবং তাদের সন্তান আবুল মুজাহিদ সিকান্দার শাহ পিতার মৃত্যুর পর যে দীর্ঘ ৩২ বছর (১৩৫৮-১৩৯০) বাংলার স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব করেছেন, সেই ইতিহাসই বা আমরা কতজন জানি? অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের পিতা পারস্যের সিস্তান অঞ্চল থেকে উপমহাদেশে এলেও তার মা বাঙালি ছিলেন।
১৯৪৭ সালে আমাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু জমিদারদের অবজ্ঞা ও জুলুম থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রত্যাশায় মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় পাকিস্তানের পক্ষে যে গণতান্ত্রিকভাবে রায় দিয়েছিলেন, সেই সত্যটাও বিগত আট দশকে প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। বাঙালিত্ব অর্জন করতে গিয়ে সমাজের এক উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলামকে পরিত্যাগ করতে চেয়েছে। একাত্তরের চেতনার নামে যে বয়ান ফেরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে, সেটি ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনকে অব্যাহতভাবে সহায়তা করেছে। এ দেশে অধিকাংশ মঞ্চ ও টেলিভিশন নাটকে মাথায় টুপি এবং মুখে দাড়ি থাকা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি নাট্যপরিচালক ও লেখকরা অধিকাংশ হিন্দু চরিত্রকে মহৎ হিসেবে দেখিয়েছেন।
অপরদিকে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর প্রতিটি সোপ অপেরায় পূজা-অর্চনা করা বাঙালি হিন্দু সমাজের এক অতিগুরুত্বপূর্ণ ও পবিত্র কাজ হিসেবে দেখালেও বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম পালনকে ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতা হিসেবেই দেখিয়েছেন আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীরা। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মহান কবি আল মাহমুদ ইসলামের প্রতি ঝুঁকে পড়লে তার মতো এত বিরাট মাপের কবিকেও অনাদরে ও অবহেলায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। ‘সাংস্কৃতিক ভারতপন্থিরা’ শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে দেড় দশকে সর্বপ্রকারে সহায়তা দিয়েছে। এদের হাত থেকে মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মুক্তি ঘটিয়েই এ দেশের বাঙালি মুসলমানের স্বকীয়তা ও ঐতিহ্য রক্ষা করতে হবে। আশা করা গিয়েছিল, জুলাই বিপ্লবের পর ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের অবসান ঘটবে। বিস্ময়করভাবে একসময়কার কথিত ভারতবিরোধী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতারা আবারও আওয়ামী ও ভারতীয় বয়ানে বাংলাদেশে দক্ষিণপন্থা এবং মৌলবাদের উত্থানের ভয় দেখাচ্ছেন।
৪.
দাসানুদাস ভারতপন্থি : আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অধিকাংশ বাম রাজনৈতিক দল দিল্লির সঙ্গে প্রভু-ভৃত্যের সম্পর্কে আবদ্ধ। এই অঞ্চলের বাম রাজনৈতিক দলের দাসসুলভ মানসিকতার সূত্রপাত হয়েছিল ব্রিটিশ আমলেই। উদাহরণস্বরূপ সিলেট রেফারেন্ডামের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৪৭ সালের সেই রেফারেন্ডামে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণ সিলেট ও করিমগঞ্জের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ভোট দিলেও কমিউনিস্ট পার্টির ভারতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশে পার্টির পূর্বাঞ্চলের সদস্যরা ভারতভুক্তির পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। অর্থাৎ, পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার তোয়াক্কা কমিউনিস্ট পার্টি কখনো করেনি। পরবর্তীকালে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলেও সেক্যুলারিজমের মুখোশে এসব বাম দল চরম ইসলামবিদ্বেষ লালন করেছে। আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভারতের ডিপ স্টেটের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর। ব্রিটিশ আমলে যুক্ত বঙ্গের প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে বাঙালি হিন্দুরা প্রকৃতপক্ষে কোনোদিনই পছন্দ করেনি। ১৯৪৬ সালে কলকাতার ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রধানত মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণি বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীকে দাঙ্গায় মুসলমানদের পক্ষাবলম্বনের জন্য অভিযুক্ত করেছিল। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলে তার প্রতি ভারতীয় হিন্দুদের বিদ্বেষ আরো তীব্র হয়। সোহরাওয়ার্দীর ইন্তেকালের পর শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সর্বময় কর্তৃত্ব লাভ করলে দিল্লির সঙ্গে দলটির নিবিড় যোগাযোগের পথ সৃষ্টি হয়েছিল। পাকিস্তান আমলে বহুল আলোচিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় সংযোগের কথা শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কারণে অস্বীকার করলেও শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনামলে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা আগরতলা ষড়যন্ত্রের সত্যতা স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে শেখ মুজিব ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী রূপে চরম বিতর্কিত ও অত্যাচারী ‘রক্ষী বাহিনী’ গঠন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালের সামরিক বাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হলে তার দুই কন্যা দিল্লিতে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করেছিলেন। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ছয় বছর দিল্লিতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর ট্রেনিং নিয়ে ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন। ৪৩ বছর পর গত বছরের জুলাই বিপ্লবে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হয়ে তিনি পালিয়ে দিল্লিতে সেই ‘র’-এর কাছেই ফিরে গিয়ে ভারতের ডিপ স্টেটের প্রত্যক্ষ সহায়তায় রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। আওয়ামী লীগ এবং উপরে বর্ণিত বামদের বাইরে উল্লেখযোগ্য দলগুলোর মধ্যে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিও ‘দাসানুদাস ভারতপন্থিদের’ অন্তর্ভুক্ত। পাঠকদের স্মরণে থাকার কথা, ২০২৪ সালের ‘আমি ও ডামির’ নির্বাচনের কিছুদিন আগে দলটির তৎকালীন প্রধান নেতা জিএম কাদের দিল্লি সফর করে ঢাকা বিমানবন্দরে নেমে বলেছিলেন, ভারতের নির্দেশ ছাড়া তিনি সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, সেটা জনগণকে বলতে পারবেন না। দাসত্বের এর চেয়ে খোলামেলা স্বীকারোক্তি আর হতে পারে না। উপরোক্ত ‘দাসানুদাস ভারতপন্থি’ গোষ্ঠী সর্বদাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে।
৫.
হীনম্মন্য ভারতপন্থি : বাংলাদেশের একদল ভীরু ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতা, বিশ্লেষক, বুদ্ধিজীবী, টকশো স্টার এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের কাছে প্রায়ই এই নসিহত শুনতে পাবেন যে, ভারতের মতো এক বিশাল এবং শক্তিধর প্রতিবেশীকে সন্তুষ্ট না রেখে আমরা নাকি সঠিকভাবে ও শান্তিতে দেশ পরিচালনা করতে সক্ষম হব না। এই শ্রেণিকেই আমি ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ নামে ডেকে থাকি। অথচ বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দী পর আমরা ভারতের ওপর রাজনৈতিক, সামরিক, কিংবা অর্থনৈতিক—কোনো কারণেই আর একতরফাভাবে নির্ভরশীল নই। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিবেচনায় ভারত বরঞ্চ বাংলাদেশ দ্বারা বিপুলভাবে উপকৃত। ১৮ কোটি নাগরিকের এই দেশটি ভারতের এক বিশাল রপ্তানি বাজার ও প্রবাসী আয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
ড. ইউনূস সরকারের বিগত এক বছরের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের উদ্ধত শাসকগোষ্ঠী কোনো অযৌক্তিক বিরোধ সৃষ্টি করলে আমাদের বৃহৎ ও শত্রুভাবাপন্ন প্রতিবেশী রাষ্ট্রটি তুলনামূলকভাবে অর্থনৈতিক বিবেচনায় বরং বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পলাতক হাসিনা ভারতের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতার যে ‘মিথ’ ফ্যাসিবাদের ১৫ বছরে তৈরি করেছিলেন, সেটি আল্লাহর অসীম রহমতে বাংলাদেশের জনগণ স্বল্প সময়ের মধ্যে ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে। ভৌগোলিকভাবে আমরা ভারতবেষ্টিত, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও বাস্তবতা যে, ভারতের ‘সেভেন সিস্টার’ রাজ্যগুলো বাংলাদেশ দ্বারা বেষ্টিত। সুতরাং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করা গেলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার সক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশের এসব হীনম্মন্য ব্যক্তিদের মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো শেখাতে আমাদের হয়তো আরো কিছুকাল অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। হীনম্মন্যতা রোগটি যেহেতু মানসিক, তাই চিকিৎসাও দীর্ঘমেয়াদি হওয়া আবশ্যক।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য উপরোক্ত পাঁচ শ্রেণির ভারতপন্থিদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার কৌশল প্রণয়ন করা অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। নব্বই দশকের শেষার্ধ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের সঙ্গে মেলামেশার অভিজ্ঞতা থেকে আমার ধারণা হয়েছে যে, আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘দাসানুদাস ভারতপন্থি’ ও ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ হওয়ার বেশ দৃশ্যমান প্রবণতা রয়েছে। ভারতের সম্মতি ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়া যায় না, অথবা গেলেও টিকে থাকা যায় না বলেও অনেক নেতা মনে করেন। ২০১৮ সালে নির্বাসনে যেতে বাধ্য হওয়ার আগে বিএনপির এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে আমি নরেন্দ্র মোদিকে হিন্দুত্ববাদী ও গুজরাটের কসাই বলায় দলটির নীতিনির্ধারকরা ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে আমার সমালোচনা বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে বলে তারা সেদিন মনে করেছিলেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আমাকে হাসিনার প্রচ্ছন্ন দালাল হিসেবেও সাব্যস্ত করতে চেয়েছিলেন।
সেদিনই আমি শহীদ জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দলটির ‘হীনম্মন্য ভারতপন্থি’ মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েছিলাম। এখন অবশ্য একসময়কার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দলটি আমাকে মৌলবাদী, ইসলামি চরমপন্থি এবং একাত্তরের চেতনাবিরোধী মনে করে থাকে। যাই হোক, আজকের দীর্ঘ লেখায় আমি আগের মতোই জনগণকে সতর্ক করার জন্য নানারকম লেবাসে ভারতীয় দালালগোষ্ঠীর চেহারা চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে জুলাই বিপ্লবের আদর্শকে ধারণ করে যারা রাজনীতি করতে চান, ভারতপন্থার বিষয়ে তাদের অন্তত চোখ খুলুক—এই আশাবাদ নিয়েই আজকের মন্তব্য প্রতিবেদন শেষ করলাম।

বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসার আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। দেশকে দ্রুতই প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অর্জন করতে হবে, যাতে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, বায়োমাস, বর্জ্য থেকে জ্বালানি, জৈবজ্বালানি, ভূ-তাপীয় শক্তি, জোয়ার-ভাটা শক্তি...
১০ ঘণ্টা আগে
রাজশাহীর যে শহর একসময় পদ্মা, বারনই, নবগঙ্গা, বারহী, বড়াল, শিবনদী আর অসংখ্য খাল-বিলের জলধারায় জীবন্ত ছিল, আজ সেখানে কেবল শুকিয়ে যাওয়া নদীর তলদেশ আর বিষাক্ত বর্জ্যের স্তুপ। নদী ছিল এই শহরের প্রাণ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যের মূল উৎস।
১০ ঘণ্টা আগে
সাধারণত কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা জানেন সময় কত বেশি মূল্যবান। একটি প্রবাদ আছেÑ‘সময় হলো সোনার মতো দামি’। অনেকেই এ কথা বিশ্বাস করেন। আর ইসলামে সময় স্বর্ণ কিংবা বিশ্বের যেকোনো মূল্যবান বস্তুর চেয়ে বেশি দামি। সময়ের মূল্য কী, ইসলাম শুধু তা-ই শেখায় না। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ইসলাম মানবজাতিকে বিশেষভাবে শেখ
১৭ ঘণ্টা আগে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগে গাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সংশ্লিষ্টতার পক্ষে ঢোল জোরেশোরেই বাজছে ওয়াশিংটনে। নীতিনির্ধারণী মহলে কেউ কেউ ফিসফিস করে আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে চিৎকার করে বলছেন গাজায় সরাসরি মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য।
১৭ ঘণ্টা আগে