চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে একবারের জন্য এসেছিল অবিস্মরণীয় ১৯৭১। এটা ছিল আমাদের জীবনবদলের আকাঙ্ক্ষাযুক্ত সামাজিক সম্মিলন প্রয়াস, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এমন উজ্জ্বল উদ্ধারের কাল আমরা ইতোপূর্বে কখনো দেখিনি। ইতিহাসের ঘুরপথে তা সেতু থেকে সেতুলোক পার হওয়া। এক্ষেত্রে কিছু স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া সবাই যুক্ত হয়েছিল প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। শহরে-গ্রামে, নগরে-বন্দরে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক, দলীয়-দলবিহীন, বেসামরিক-সামরিক, শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত-অশিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র, চাকরিজীবী, দোকানদার, কর্মচারী, রিকশাওয়ালা, চাষি-মজুর, ছাত্র-শিক্ষক, চিকিৎসক-প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক, আলিম-উলামা, তরুণ-বৃদ্ধ, সরকারি কর্মকর্তা-করণিক, পুরুষ-নারী সবাই অংশগ্রহণ করেছেন, ভূমিকা রেখেছেন। সেইসঙ্গে সক্রিয়ভাবে সামরিক বাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈন্য, ইপিআরের বাঙালি সদস্য, পুলিশ বাহিনীর অফিসার ও সদস্যরা ছিলেন গণমানুষের সঙ্গে। মূলত, সামরিক প্রশিক্ষণ, অস্ত্রচালনা ও যুদ্ধকৌশল শিক্ষাদানসহ লড়াইয়ে ছিলেন তারা। সেক্টর কমান্ডার, সাবসেক্টর কমান্ডাররা সশস্ত্রযুদ্ধে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন নির্দেশনা দিয়ে। সেজন্যই গেরিলাযুদ্ধ ও সম্মুখযুদ্ধ সফল হয়েছিল সমগ্র জনসমাজের অংশগ্রহণে। মুক্তিযুদ্ধ তাই সর্ববিচারে, প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়, চাক্ষুষ প্রমাণে, তথ্যের ব্যাপকতা ও গভীরতায়, বাস্তবতার তীব্রতম কশাঘাতে আর ইতিহাস বিশ্লেষণে প্রকৃত অর্থেই ছিল এক অনন্যসাধারণ জনযুদ্ধ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের দ্বীনি বিশ্বাস ও জীবনযাপন বোধের বাস্তবতার অন্তঃসলিলা স্রোতোধারায় সিক্ত। নিরঙ্কুশ মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বদেশ একাত্তরে বাংলাদেশে রূপ পায়। বিশ্বাস, ভূগোল ও ইতিহাসের মেলবন্ধন ও বাস্তবতা না থাকলে কখনোই একাত্তরকে আমাদের মতো করে পাওয়া যেত না। সেইসঙ্গে এটা আমাদের নিজস্ব স্বাধীন অস্তিত্ব, ভাষা ও স্বকীয়তার প্রতিষ্ঠা প্রয়াস। এটা আমাদের সামাজিক সত্তার ঐক্য, সামাজিক সংগ্রাম ও সমষ্টিউত্থানের পরিচায়ক। আমাদের সমাজচুক্তির নির্ণায়ক ও জনসমাজের মৌল সম্মিলিত অস্তিত্বের ঘোষণা। আমাদের ভূগোলের আত্মপরিচয়ের প্রত্যক্ষ নির্মাণ। আমাদের মুসলিম পরিচয়সহ বাংলাভাষা ও স্বদেশপ্রাপ্তির স্পষ্ট চিত্র। লক্ষণীয়, আল্লাহ কোরআনে যেমন আমাদের মুসলিম হতে বলেছেন, তেমনি মানুষের ব্যবহৃত ভাষা বৈচিত্র্যও তাঁরই সৃষ্টি বলে জানিয়েছেন।
তাই একাত্তর আমাদের রাষ্ট্র গঠন, জাতীয় সংহতি, জাতীয় স্বার্থ, নিজস্ব শাসনব্যবস্থা, স্বাধীন পতাকা, স্বনিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার এবং সম্মিলিত স্বাধীন ভবিষ্যৎ নির্মাণের ভিত্তি প্রতিষ্ঠাকারী। এটা আমাদের শিকড়-উত্থিত সত্য উচ্চারণের, আমাদের জীবনযাপনে দ্বীনি স্বকীয়তার, আদিগন্ত ভূগোলের জনইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো নিজস্ব উদ্ধারকৃত বদ্বীপ। এটা রাষ্ট্রব্যবস্থাপনায়, সরকার পরিচালনায় এবং সেইসঙ্গে সব মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রশ্নে সমষ্টি মানুষের চূড়ান্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্মারক। নাগরিকদের সামষ্টিক বিজড়ন, অংশগ্রহণ, ক্ষমতায়ন, প্রবেশগম্যতা, মর্যাদা, প্রাপ্যতা ও শেষকথা বলার শর্ত নির্মাণকারী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিজেই সাক্ষ্য, ইতিহাস ও দালিলিক প্রমাণ। এর মধ্য দিয়ে আমাদের জনসমাজ তাদের দ্বীনি বিশ্বাস, ভাষা ও ভূখণ্ড, স্বাধীন জীবনযাপনের এবং নিজেদের কেন্দ্রীয় অস্তিত্বের প্রবলতম ঘোষণাসহ সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচারসহ আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমষ্টিমানুষের সম্মিলিত উন্নত জীবনের দাবি উঠিয়েছে। এসবই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা যা ব্যক্তি, পরিবার, দল, সংকীর্ণ স্বার্থ, ধনিক প্রাধান্য, চেপে বসা এবং যেকোনো কৃত্রিম ও বানোয়াট উপকথার বাইরে। কেউ না চাইলেও এসব প্রকৃত ইতিহাসের অন্তর্গত। ইসলাম ও বাংলাদেশি সত্তা একযোগে তাই আমাদের জাতীয় স্বাতন্ত্র্যের মূলভিত্তি। দূরের চেপে বসা শাসন এবং কাছের হিন্দুত্ববাদী আধিপত্য উভয় থেকে স্বাধীনতার গ্যারান্টি। এখানে বাধা এলেই ১৫ আগস্ট, ৭ নভেম্বর ও ৫ আগস্ট ঘটে। এ পথেই স্বেচ্ছাচার ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ মুক্তি, আধিপত্যবাদের মরণকামড় মুক্তি, দীর্ঘ প্রলম্বিত ফ্যাসিনার ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি ঘটে বিদ্রোহ, প্রতিরোধ, গণঅভ্যুত্থান ও বর্ষাবিপ্লব সংঘটনের মাধ্যমে।
একাত্তরের পর বাহাত্তর থেকেই উপরের সত্যকে অস্বীকার করে বানোয়াট ইতিহাস, কৃত্রিম সম্মতি উৎপাদন, গণভবনে নির্বাচনি ফলাফল নির্ধারণ, জনবিহীন জনরায়, নিশিরাতের নষ্টামি, গুম, খুন, পীড়ন ও ভয়ের সংস্কৃতিসহ রাষ্ট্রীয় ও শাসনিক পর্যায়ে সর্বত্র ব্যক্তি, পরিবার, সংকীর্ণ স্বার্থ, দলীয় অন্ধত্ব ও হিন্দুস্তানি হিন্দু আধিপত্যবাদী থাবা সর্বোচ্চ প্রাধিকার পায়। একসময় মুজিববাদী আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়। পরবর্তীকালে অনাচারসহ পরপর চারটি নির্বাচনি প্রহসনে হাসিনার অবৈধ জবরদখলকারী স্বেচ্ছাচার, মাফিয়াতন্ত্র এবং ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠার কারণেই ছাত্র-জনতা ইতোমধ্যে একাত্তরের লব্ধ স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জীবনপণ লড়াইয়ে নামে। হাজারো হত্যা ও বিশাল ক্ষতি স্বীকার করে শেষাবধি বর্ষাবিপ্লবের মাধ্যমে হিন্দুস্থানের ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদী শক্তির সেবাদাসী হাসিনা প্রাণভয়ে পলায়নকরত দিল্লিতে আরএসএস-বিজেপির মোদির কোলে আশ্রয় নেওয়ার ভেতর দিয়ে তার মাফিয়াতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদকে উৎখাত করে জনগণ। দখল করে বাংলার বাস্তিল তথা গণভবন। আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার সালাত, সিজদা, দু’হাত তোলা মুনাজাত, অশ্রু আর আনন্দের সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এভাবেই একাত্তরের জাগৃতির উত্তরাধিকার হিসেবে চব্বিশের বর্ষাবিপ্লব নিয়ে আসে ইতিহাস সৃষ্টিকারী নবজাগৃতি।
একাত্তরের শিকড়সূত্র বুঝতে পারলে যথার্থই অনুধাবন করা যাবে যে, এই দুইয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। একাত্তরের বৈষম্যমুক্তির আকাঙ্ক্ষা, সাম্যের দাবি, মানবিক মর্যাদার উচ্চারণ এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই বর্ষাবিপ্লবের নতুন বৈষম্যবিরোধী নতুন বন্দোবস্ত, জনমালিকানাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা, গণ ও নাগরিক নিয়ন্ত্রিত সম্মতিভিত্তিক শাসন শর্ত এবং প্রকৃত ন্যায়ানুগ সমাজ প্রতিষ্ঠা দাবিকে সমগ্র ভূগোলের গণউচ্চারণে পরিণত করেছে। একাত্তর ও চব্বিশ যথাক্রমে পূর্বসূরি ও উত্তরসূরি হিসেবে এযাবৎকালের আমাদের যাপিত জীবনের সর্বাধিক আলোড়নকারী পরস্পর অবিচ্ছেদ্য বিষয়দ্বয়। একাত্তর তার রিলে রেইসের কাঠি চব্বিশকে দিয়ে বলে গেছে, এবার তুমি এগিয়ে যাও। দেখতে পাবে, আকাশের ওপারে আকাশ। দিগন্তপারে নতুন দিগন্ত। জনমানুষের পথচলা এখনো শেষ হয়নি। এখনো বহুকাল জেগে থাকতে হবে মানবমুক্তির আশায়।
ইতিহাসের দিকে তাকাই। সপ্তম শতকেই আমাদের এই ভূখণ্ডে এবং এর অনিবার্য সংযুক্তির ভূগোলে একত্ববাদী ইসলাম বিস্তৃত হয়েছিল। আরব বণিকরা তৃতীয় শতক থেকেই সমুদ্রপথে চট্টগ্রাম, আকিয়াব হয়ে বাংলাদেশ দিয়ে চীনে যেত। ইসলামের দাওয়াতের কাজ তারা করত সততা, প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, চরিত্র, সংহতি দ্বারা এবং অতি অবশ্যই কোরআন-সুন্নাহর আলোকে। ফলে বাংলা ভূখণ্ড, বার্মা এবং চীনে ইসলামের প্রসার ঘটে। আকিয়াব (আজকের সিত্তো) বন্দরের কাছে সেই সপ্তম শতকে মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়। মিনার থেকে আল্লাহু আকবার উচ্চারিত হতে থাকে। মালাবার উপকূলেও এমনটা ঘটে। এদিকে ইয়েমেন থেকে সিলেটে হজরত শাহজালালের আগমনের পূর্বেই ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়। জনৈক বুরহানউদ্দিন শাহজালালের কাছে পত্র প্রেরণপূর্বক নালিশে জানান যে, রাজা গৌরগোবিন্দ তার ছেলেকে হত্যা করেছে, তিনি এর বিচার চান। শাহজালাল তার তরবারি ও সঙ্গিগণসহ সিলেটে আগমন করেন সেই কয়েকশ বছর আগেই এবং এ অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটে। খুলনায় খানজাহান আলী, চট্টগ্রামের বায়েজিদ, রাজশাহীর শাহ মখদুম ইসলামের প্রসার ঘটান। এরাসহ সমগ্র বাংলা ভূখণ্ডে আসা আরো ব্যক্তি কেউই পীর নন বরং দ্বীনের মুজাহিদ। শাহজালালের নিজস্ব তরবারি লেখক নিজেই দেখেছেন।
আকিয়াব অঞ্চল ঘিরে বিরাট ভূগোলে ইসলাম আসে সপ্তম শতকেই। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এভাবেই মুসলিম হয়ে যায় এবং সেখানে মুসলিম আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। অনেক ইতিহাসহ ১৭৯৯ সালে লেখা ফ্রান্সিস বুকাননের প্রবন্ধে এ সত্য উন্মোচিত। তার মতে, ‘মুহাম্মদগণ দীর্ঘকাল ধরে আরাকানে বসতি প্রতিষ্ঠা করেন এবং তারা নিজেদেরকে রুঈঙ্গা বা আরাকানের অধিবাসী বলে পরিচয় দেন।’ আরো সত্য এই যে, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবি সাদ বিন আবি ওয়াক্কাসসহ আরো সাহাবি চট্টগ্রাম ও আকিয়াব হয়ে ইসলাম প্রচার করেছেন চীন ও অন্যান্য অঞ্চলে। এদের কারো কারো কবর রয়েছে চীনের ভূখণ্ডে।
এরপর বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ বিজয় সুবিদিত। রাজা লক্ষণসেনকে তিনি পরাজিত করেন। যেমন রাজা গৌরগোবিন্দ পরাজিত ও পলায়নে বাধ্য হয় শাহজালালের অগ্রাভিযানের ফলে। এভাবেই বাংলা ও তৎকালে আসামভুক্ত সিলেট অঞ্চলে ইসলাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হয়। তবে মুসলিম মুজাহিদ, ইসলামের দাওয়া দানকারী, কিংবা এমনকি আরব মুসলিম ব্যবসায়ীরা শেষাবধি সবাই খিলজি ও শাহজালাল বাদে স্থানীয় মেয়েদের মুসলিম বানিয়ে বিয়ে করে এখানেই সংসার করে জীবন সমাপ্ত করেন।
আবার আরেকদিক দিয়ে দেখলে স্পষ্ট যে, প্রাচীন বাংলার বিশাল অংশ হিন্দু বৌদ্ধ ও প্রকৃতপূজক থেকে কালক্রমে মুসলিম হয়ে যায় ইসলামের সমতা, সৌন্দর্য ও মানবমুক্তির পথ দেখে। এরা আরব ভূখণ্ড থেকে আসা মুসলিমদের মাধ্যমে আলোকপ্রাপ্ত হয়। এরপর স্বাধীন সুলতানিবাংলা, সুবেবাংলা পর্যায়ে শত শত বছরে বহু মানুষ মূর্তিপূজা ছেড়ে তাওহিদভিত্তিক ইসলামের মধ্যে প্রবেশ করে। সুলতানি আমলে বাংলা ভাষারও ব্যাপক উৎকর্ষ ঘটে। আরো পরে আলীবর্দী খান ও সিরাজুদ্দৌলার শাসনে বাংলা বিহার উড়িষ্যায় ইসলামের ব্যাপ্তি ঘটে। বাংলায় সিরাজুদ্দৌলা জীবন দেন পলাশীতে, মীর নিসার আলী তীতুমীর নারকেলবাড়িয়ায়, এরপর ১৮৫৮ সালে হাবিলদার রজব আলীসহ অন্যান্য মুসলিম জীবন দেন দখলদার কোম্পানির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার লড়াইয়ে।
১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ হলে সেটাকে ‘সেটেল্ড ফ্যাক্ট’ থেকে ‘আনসেট্ল’ করে জমিদার হিন্দুরা ১৯১১ সালে। লাল-বাল-পাল আর রবীন্দ্রনাথসহ হিন্দু স্বদেশিরা মুসলিদের আলাদা সত্তাকে এভাবেই পদে পদে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯০৬ সালে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। তারই উদ্যোগে ও প্রচেষ্টায় রবীন্দ্রনাথসহ ‘মক্কা বিশ্ববিদ্যালয়’ বলে ব্যঙ্গকারী অন্যদের প্রবল বাধার মুখেও সলিমুল্লাহর দানকরা জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহোর অধিবেশনে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের প্রস্তাব উত্থাপন করেন ফজলুল হক। মুসলিম গরিষ্ঠতা নিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দাবিও উত্থাপিত হয়েছিল ১৯৪৬-১৯৪৭ সালে মুসলিম সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাসিম কর্তৃক। সাতচল্লিশে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলই একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশরূপে আত্মপ্রকাশ করে নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। ইতিহাসে প্রমাণিত যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী মুসলিম লীগ না থাকলে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলা জমিদারি উচ্ছেদ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হতো না।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়। মুর্শিদাবাদে সিরাজুদ্দৌলা, বারাসাতে তীতুমীর, ঢাকায় রজব আলীসহ জীবনদানকারী অন্য সবাই মুসলিম, ভাষা আন্দোলনে জীবনদানকারী সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউদ্দিনসহ সবাই মুসলিম, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আগে ও চলাকালে জহুরুল হক, আসাদ, মতিয়ুর, ফারুক, ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল, সুন্দর আলীসহ সবাই মুসলিম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী সাত জন বীরশ্রেষ্ঠ সবাই মুসলিম। আবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দেন মুসলিম মেজর জিয়াউর রহমান। উচ্চারণ করেন ‘উই রিভোল্ট’। তিনিই ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণায় বলেন, ‘আই মেজর জিয়া ডু হিয়ারবাই ডিক্লেয়ার দি ইন্ডিপেন্ডেনস অব বাংলাদেশ’। তিনি নিহত হন হিন্দুস্তানি আধিপত্যবাদ ও দেশীয় শত্রুদের চক্রান্তে। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধে জীবনদানকারী বিশাল ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ যোদ্ধাই ছিলেন মুসলিম। পুরো মুক্তিযুদ্ধকালে মুক্তিযোদ্ধারা আল্লাহর কাছেই নিরাপত্তা এবং শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্য সাহায্য চেয়েছে, তাকবির উচ্চারণ করেছে।
আরো পরে এসে দেখি, মুজিব ও তার কন্যা হাসিনার ব্যক্তিক স্বৈরাচারের আওয়ামী মাফিয়া ফ্যাসিস্ট আমলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জীবনদানকারী মানুষই ছিল মুসলিম। বিডিআর হত্যাকাণ্ডে সেনা অফিসারগণ, হেফাজত হত্যাকাণ্ডের শিকার আর মোদির আগমনের বিরোধিতাকারী হিসেবে নিহত ১৭ জনই মুসলিম। সবশেষে ২০২৪-এর বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও লড়াইয়ে সব সমন্বয়কারী ছিলেন মুসলিম। আবু সাঈদ, ওয়াসিম, মুগ্ধ, ফাইয়াজ, আনাস, সিয়ামসহ প্রায় সবাই জীবনদানকারী (২-৩ জন বাদে) মুসলিম।
ইতিহাসের প্রমাণ মোতাবেক বাংলা ভূখণ্ডের পথপরিক্রমায়, মুসলিমদের নিজস্ব ভূখণ্ড গঠনে, রূপায়ণে, লড়াই সংগ্রামে জীবনদানকারী সবাই মুসলিম। এই সত্য বলে দেয়, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪-এর বর্ষাবিপ্লবের মর্মার্থকে আত্মস্থকরত জীবনকে বদলাতে গেলে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উঠে আসা স্পষ্টতম অন্তর্গত সত্যকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি দিতে হবে। সেজন্যই বর্ষাবিপ্লবকালে ও পরে সারা দেশে রাজনৈতিক ফ্যাসিস্টের মূর্তি ভেঙেছে মানুষ ব্যক্তি, নেতা ও পরিবারপূজাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যানকরত। ইসলামের দাবিÑএকমাত্র লা শরিক আল্লাহর উলুহিয়াহ মেনে একমাত্র আল্লাহরই উবুদিয়াহতেই থাকা তাওহিদ, মসজিদ, আজান আর সুজুদ এই জনপদের মানুষদের মহাবৈশ্বিক বোধ ও জীবন। ওটাই মুসলিমের ঈমান, ওটাই সিরাতুল মুসতাকিম। একাত্তর আর চব্বিশের অন্তর্গত মিল ওখানেই।
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

