দরকার নিজেদের সংস্কার

মো. আশরাফুল আলম
প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৫, ১১: ৩৫

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান একটানা দেড় দশক ধরে দেশ শাসন করা ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনকালে খুন, গুম, অর্থ পাচার, দুর্নীতি, কালোবাজারি এবং সিন্ডিকেটে ভরে গিয়েছিল।

দেশে স্বৈরশাসন কায়েম হয়েছিল, যা দেশের মানুষ নীরবে মেনে নিলেও একটা সময়ের পর ছাত্র-জনতা ফুঁসে উঠেছিল। যার অবধারিত ফল হলো নিজের জীবন বাঁচাতে শেখ হাসিনার দেশত্যাগ। এরপর গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

বিজ্ঞাপন

দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, এ সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক অনিয়ম ও ফাঁকফোকর বন্ধ করে একটি সুন্দর আগামীর বাংলাদেশ উপহার দিতে চাচ্ছে। তবে রাতারাতি গুটি কয়েক ব্যক্তির দ্বারা এই মহাযজ্ঞ কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।

এর জন্য প্রয়োজন সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের সদিচ্ছা ও সহযোগিতা। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাবে, তা হচ্ছে ধৈর্য। বিগত বছরগুলোয় যেভাবে দলীয়করণ করে রাষ্ট্র পরিচালিত হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে আসতে গেলে আমাদের অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে কোনো কাজই সুন্দরভাবে করা সম্ভব নয়।

আমরা ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ থেকে যে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারি, তা হচ্ছে, সবকিছুর ওপরে দরকার ধৈর্য আর সহনশীলতা। কোটা আন্দোলনের বিষয়টি অত্যন্ত যৌক্তিক ছিল। প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার অভাবের পরিণাম শত শত লাশ এবং পরিণতিতে তার দেশ থেকে পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করা। সঠিক ও সহনশীলতার সঙ্গে তিনি যদি কোটার বিষয়টি অনুধাবন করতেন, তাহলে হয়তো আজকে তাকে দেশ থেকে পালাতে হতো না। তাই ছাত্র-জনতার যেকোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন মোকাবিলা করার জন্য ধৈর্য ধারণ করাটা খুব জরুরি।

দেশের বিভিন্ন অফিস-আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সর্বক্ষেত্রে সংস্কারের ছোঁয়া লাগছে। তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই সংস্কারের পূর্বশর্ত হচ্ছে ব্যক্তি সংস্কার। আজকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধানরা স্বেচ্ছায় কিংবা বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করছেন, বাধ্যতামূলক অবসর পাচ্ছেন, চাকরি হারিয়ে বিচারের সম্মুখীন হচ্ছেন, দুর্নীতির কারণে অপমানিত হচ্ছেন, জেলেও যেতে হচ্ছে অনেককে।

এর কোনো মূল্যই থাকবে না, যদি আমরা নিজেদের সংস্কার না করি। সরকার শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার করে যাবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ ও জনগণ শুধু সেই সংস্কারের ভুলত্রুটি ধরে যাবে, তাহলে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর দেশের সংস্কার হবে না। আর হলেও তা বেশিদিন টিকে থাকবে না।

অনেক কর্মকর্তার পদত্যাগ বা বাধ্যতামূলক অবসরের পর সেসব পদে যারা আসবেন, তারা নিজেদের কতটুকু সংস্কার করছেন, সেটা যেমন জরুরি, তেমনি আমরা কতটুকু ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের সংস্কার করতে পারছি, সেটিও জরুরি। আমাদের নিজেদের জায়গা থেকে স্বপ্রণোদিতভাবে সংস্কারে উৎসাহী হতে হবে। বিগত সময়গুলোয় আমরা কী করেছি, তা না ভেবে, এখন থেকেই সংস্কারকাজ শুরু করতে হবে নিজের ঘর থেকে, নিজের প্রতিষ্ঠান থেকে, নিজের জায়গা থেকে।

আমাদের ছোট্ট এই দেশে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠী ছাড়াও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অনেক ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বসবাস। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের যেমন গৌরবময় ইতিহাস, তেমনি কিছু লজ্জার বিষয়ও আছে। অধিকার আদায়ে আমরা সোচ্চার হয়ে আন্দোলন করি, বুকের তাজা রক্ত বিলিয়ে দিয়ে ভাষা এনেছি, দেশ স্বাধীন করেছি, স্বৈরাচারের পতন করেছি। কিন্তু অতীতের এত এত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকলেও বর্তমানে আমরা তা বেমালুম ভুলে গেছি।

আমরা ভিন্নমত সহ্য করি না, নিজের স্বার্থ ত্যাগ করতে পারি না, সুযোগ পেয়েও দুর্নীতি থেকে সরে আসতে পারি না, গঠনমূলক সমালোচনা সহ্য করতে পারি না, অন্যের জন্য কাজ করতে পারি না। পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের নেই বললেই চলে। আমরা খুব সহজেই অন্যের দোষ ধরতে পারি, কিন্তু নিজেদের বেলায় অন্ধ। সুযোগ পেলেই আমরা নিজের স্বার্থোদ্ধারে সচেষ্ট থাকি।

ভালোমন্দ কোনো বোধ বিবেচনা আমাদের মধ্যে নেই। জাতি হিসেবে আমরা বিভিন্ন সময় দুর্নীতিতে বিশ্বসেরা হয়েছি, খারাপ সূচকে প্রথম সারিতে অবস্থান করলেও কখনো আমাদের মনে হয়নি আমরা ভালো কিছু করে দেখাতে পারি কি না।

সব সময় ভেবে আসছি আমার দিক ঠিক থাকলেই হবে, অন্যরা গোল্লায় যাক। আর এই ধ্যান-ধারণার ফসল সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সীমাহীন দুর্নীতি করে সম্পদ ও টাকার পাহাড় গলে তোলা, স্বৈরাচারী মনোভাব ইত্যাদি। শিক্ষাব্যবস্থাকে রসাতলে নিয়ে যাওয়া, বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা ও চাকরির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস, টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়াসহ সব ক্ষেত্রে সীমাহীন দুর্নীতির কারণেই আমরা জাতিগতভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছি।

বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। পতিত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গত দেড় দশকে বৈধ-অবৈধ উপায়ে প্রতিবছর দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে ১৬ বিলিয়ন ডলার। প্রায় সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম নিয়ে যেভাবে ছাত্র-জনতা ফুঁসে উঠেছে, তা সত্যিই প্রশংসার দাবিদার। দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষোভ, হতাশার বিস্ফোরণ ঘটে কোটা সংস্কারের দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলনে। শেষ পর্যন্ত তা গণবিক্ষোভে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

ব্যাংক খাতে ধস, স্টকমার্কেটসহ অর্থনৈতিক খাতের অস্থিতিশীলতার কারণে প্রায় সব ক্ষেত্রেই বিরাজ করছে অস্থিরতা। বিগত সময়গুলোয় যেভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দেখিয়ে নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে টাকা ও সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তার সম্পূর্ণ প্রভাব পড়েছে আমাদের অর্থনীতিতে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঘাটতি, কিছু ব্যাংকের মূলধন ঘাটতিসহ নানা রকম অর্থনৈতিক তছরুপের ঘটনায় দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।

গত ডিসেম্বর, ২৪-এ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ২৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যদিও তা বিশ্বব্যাংকের মতে মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার। যেখানে আমাদের অনেক পরে স্বাধীনতা পেয়ে মালয়েশিয়া বিশ্ব অর্থনীতিতে ৩৬তম আর আমরা আছি ৩৯তমতে (আইএমএফের মতে)। এলডিসি থেকে উত্তরণের যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ আগাচ্ছে, সেটাতেও এখন হয়তো ভাটা পড়তে পারে। তাই দেশকে সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে গড়ে তুলতে গেলে অন্তর্বর্তী সরকারকে যথাযথভাবে কাজ করার জন্য যথেষ্ট সময় দেওয়া প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে দেশের প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে উপভোগ করার জন্য এবং একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলাকে এড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর এর জন্য প্রয়োজন ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে এবং সর্বোপরি সামাজিকভাবে নিজেদের সংস্কার করা। তবেই অর্জিত হবে দ্বিতীয় স্বাধীনতার প্রকৃত সুফল।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত