সহায়হীন মানুষের বন্ধু

ওমর শাহেদ
প্রকাশ : ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ০২

গত বছর কী কী সাহায্য করেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি রেসপন্স টিম? তারা তো এই জানুয়ারিতেই কাজে নেমেছেন। গল্পগুলো লিখেছেন ওমর শাহেদ

বিজ্ঞাপন

কদিন আগের কথা, খুব ভালো একটি কাজ করেছেন তারা। ঢাকার টঙ্গী রেলস্টেশন, মেরুল বাড্ডা, ক্যাম্পাসের আশেপাশে, আফতাবনগর ও মহাখালীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ক্যাম্পাসের সামনে বিলিয়েছেন মোট ২৫০টি কম্বল। পুরোনো জামাকাপড়ও বিলি করেছেন তিন-চার বস্তা। যাদের কোনো সহায় নেই, সম্বলও নেই, তাদের দান করেছেন ছাত্র, ছাত্রী ও অধ্যাপকদের দেওয়া সাহায্য। তারপর হাসিমুখে ফিরেছেন বাড়ি।

কম্বলগুলোর মধ্যে সবকটিই নতুন। এগুলো ক্রাউড ফান্ডিং বা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাক্স বুথ, অনলাইন ও অফলাইনে প্রচারণা এবং বলে-কয়ে পাওয়া টাকায় কেনা। এসব সাহায্য বহু বছর ব্যবহার করতে পারবেন তারা, কেনার সামর্থ্যও নেই যাদের। আর এই জানুয়ারিতে তাদের এই কাজে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিয়েছে গাড়ি। এছাড়া রাতের বেলায় বেরিয়ে পুরোনো কাপড় ও কম্বল যাদের দেয়ার তাদের দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। রেলওয়ে পুলিশের সাহায্যে এবার রেলস্টেশনে কাপড় ও কম্বল বিলি করেছেন। মানুষের জন্য কাজ করা মহৎ হৃদয়ের মানুষগুলো সবাই পড়েন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে, নানা বিভাগে। তাদের একটি ছাতার নিচে নিয়ে এসেছে ‘ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি রেসপন্স টিম’, সংক্ষেপে ‘ব্র্যাকইউ রেসপন্স টিম’। ক্লাবের উপদেষ্টা হলেন—ফার্মেসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. এম রাইদ জমির উদ্দিন।

ক্লাবের প্রেসিডেন্ট আতাহার ইশতিয়াক জানালেন, একেবারে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করেন তারা। ছয়টি বিভাগ আছে—কমিউনিকেশন, হিউম্যান রিসোর্স (এইচআর), ফিন্যান্স, আইটি, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আরঅ্যান্ডডি) ও অপারেশন। একেক বিভাগে অনেক সদস্য কাজ করেন। আর ইশতিয়াকরা হলেন প্যানেল বডি। সেখানে ডিরেক্টর, অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর, সেক্রেটারি, এক্সিকিউটিভ ও ফ্যাসিলিটেটর আছেন। মুনতাসীর মাহমুদ এই প্যানেলের সেক্রেটারি জেনারেল। বছরজুড়ে অনেকগুলো প্রকল্প আকারের কাজ গরিব মানুষের উন্নয়নের জন্য ঘুরে ঘুরে করেন তারা। রক্তদান কর্মসূচি তার মধ্যে অন্যতম। সারা বছর ধরে তাদের কমিউনিকেশন বিভাগ স্বেচ্ছায় রক্ত জোগাড় করে দেয়। ছাত্রছাত্রীসহ সবাই তাদের মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহ করে জীবন বাঁচান। একটি বিশাল তথ্যভাণ্ডার তৈরি হয়েছে। গত বছরজুড়ে এক হাজার ৫০০ ব্যাগ রক্ত সংগ্রহ করেছেন তারা। নিয়ম করে প্রতি বছরই রক্ত সংগ্রহ করেন। সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা ও রক্ত সংগ্রহ করার জন্য বছরওয়ারি সহযোগী প্রতিষ্ঠান থাকে। গত বছর এই সহযোগী প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি।

নিয়মানুসারে তারাই যোগাযোগ করেন। একবারের রক্তদান কর্মসূচিতে ২১৫ ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন তারা। এর মধ্যে মেয়েরাও ছিলেন। আসলে তাদের রক্ত দেয়ার ব্যাপারে ভীতি কাটানোই মূল চ্যালেঞ্জ থাকে। রক্ত দিলে শরীর সুস্থ থাকে—এই কথাটি অনেকেই জানেন না। আবার যারা হাসপাতালে যেতে চান না, তাদের সবার প্রথম রক্তদানের অভিজ্ঞতা হয় এই রক্তদানের কর্মসূচিতে। ১০ ও ১১ সেপ্টেম্বর হয়েছিল এই কাজ। রেড ক্রিসেন্টের ১৫ জনকে নিয়ে ক্লাব অ্যাকটিভিটি রুমে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা রুমে রক্ত নেওয়া হয়েছে। কোনো সমস্যা যাতে না হয়, সেজন্য রেজিস্ট্রারসহ সিনিয়র প্রফেসররা এসেছেন, সাহস দিয়েছেন।

প্রজেক্ট হাসিমুখ তারা প্রতিবারের মতো করেছেন রমজানে। এই কার্যক্রমটিও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য। দরিদ্রদের কষ্ট বুঝতে পারা এবং তাদের জন্য কিছু একটা করতে পারা—রমজানের এই উদ্দেশ্য তারা বুঝতে পেরেছেন। সমাজে যারা ভালো আছেন, আর যারা ভালো নেই, সে ধরনের মানুষের জন্য তারা ক্রাউড ফান্ডিং করেছেন চারটি দিন ধরে। ১১ থেকে ১৫ রমজান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় বুথ স্থাপন করেছেন। এই বাক্সগুলোয় ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপক ও কর্মকর্তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে টাকা দিয়েছেন। মোট ৭৮০ মানুষের এভাবেই খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে একবেলা। ঢাকার এয়ারপোর্ট, রেলস্টেশন, মহাখালী, মেরুল বাড্ডা, মহানগর ডিআইটি প্রজেক্ট, মিরপুরের আল নাহিয়ান এতিমখানা, বাড্ডার তৌহিদুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা, ৩০০ ফিটের নীলা মার্কেট—এই জায়গাগুলোং ইফতার বিলি করেছেন। এই ইফতারি হলো চিকেন বিরিয়ানি। তাতে ফল ছিল ও খেজুর ছিল। একজন বাবুর্চি বিশেষ ধরনের এই রান্না করেছেন। মুরগি, মসলা, চাল, ডাল ও তেল তারা জোগান দিয়েছেন। রান্নার পর প্যাকেটিং করেছেন। যে টাকাগুলো বেঁচে গেছে, তা দিয়ে ঈদের আগে ৩০টি ছিন্নমূল ও দরিদ্র পরিবারকে ঈদের দিনের খাবার হিসেবে তেল, সেমাই, নুডুলস ও পোলাওর চাল উপহার দিয়েছেন প্যাকেটবন্দি করে ঢাকার আফতাব নগরে।

উত্তরণ প্রকল্পটি আসলে জীবনের উত্তরণ। ফেনীতে এবার ভয়াবহ বন্যার সময় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩টি ক্লাব মিলেছে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি রেসপন্স টিমের সঙ্গে। তারা সবাই মিলে টাকা তুলেছেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে, সঙ্গে জনপ্রতি কৃষককে আট প্রজাতির শাকসবজির এক হাজার ২৩০ গ্রাম বীজ এবং ১০ কেজি ড্যাব বা ড্রাই অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট দিয়েছেন। তাতে ৪০ শতক বা এক কানি জমিতে প্রতিজন কৃষক খুব ভালোভাবে ফসল ফলাতে পারবেন। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার মোট ১৭০ কৃষক এই সাহায্য পেয়েছেন। কৃষকরা বলেছেন, তাদের সাহায্য না পেলে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ত। এক দিনের মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবগুলোর আট সদস্য সেখানে গিয়েছিলেন। যাতায়াত খরচ দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এক কৃষক ঘরে কোনোভাবে বাঁচানো ১৫টি কমলালেবু তাদের খেতে দিয়েছেন। একবেলা খাওয়ানোর জন্য তার সে কী জোরাজুরি! ব্র্যাকইউ রেসপন্স টিমের সঙ্গে যোগাযোগ: https://bracurt.org

ইমতিয়াজ রাব্বি নামে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক ছাত্র হাড়ের ক্যানসারে আক্রান্ত। অনেক দিন ধরে তিনি মরণযুদ্ধ করে চলেছেন। ৫০ লাখ টাকা খরচ করে তার পরিবার নিঃস্ব প্রায়। এই মানুষটিকে বাঁচাতে ব্র্যাকইউ রেসপন্স টিম ক্রাউড ফান্ডিং করেছে। হাড়ের ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষ সেমিনার করেছে। ধূমপানসহ খারাপ অভ্যাসগুলোর জন্য মানুষের ক্যানসার হয়। রাব্বির জন্য যারা শখের ফটোগ্রাফার, যারা ছবি আঁকেন, তারা ছবি জমা দিয়েছেন। চিত্র ও ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। সেগুলো বিক্রির টাকাসহ মোট ২ লাখ ৬৭ হাজার ৯৮৫ টাকা তার পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি ল্যাব এইড ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি আছেন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত