প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) ছিলেন জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। ১৯৮১ সালের ৩০ মে ভোরে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়ার গুলিবিদ্ধ লাশ দেখে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন।
জিয়াউর রহমানের বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ করিডোরে পড়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি। সেই ভয়ংকর স্মৃতি তার মনে আজও গেঁথে আছে। সার্কিট হাউসের সেদিনের দৃশ্যকে অত্যন্ত ‘ভীতিপূর্ণ’ ছিল বলে তিনি বর্ণনা করেন। সেদিন তিনি সার্কিট হাউসে গিয়ে দেখতে পান ভবনের একটি অংশ গোলার আঘাতে ভেঙেচুরে কিছু পড়ে আছে নিচে এবং কিছু ঝুলে আছে। গাড়িবারান্দায় রক্তের দাগ, সেখানে পড়েছিল দুটি মৃতদেহ। একটি একজন পুলিশ কনস্টেবলের এবং অন্যটি প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড সেনাসদস্যের। সিঁড়ি ভেঙে উপরতলায় গিয়ে জিয়াউদ্দিন দেখেন, প্রেসিডেন্টের কামরার ঠিক দরজায় পড়ে আছে সাদা কাপড়ে ঢাকা একটি মৃতদেহ। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন একজন প্রেসিডেনশিয়াল গার্ড। জিয়াউদ্দিন বলেন, চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশের গোপন শাখার সহকারী কমিশনার আবদুস সাত্তার আমাকে মৃতদেহের দিকে আঙুল দিয়ে বললেন, ‘এটি প্রেসিডেন্ট জিয়ার লাশ।’ ‘কাপড় ওঠাতেই দেখলাম এক মর্মান্তিক দৃশ্য। গুলির আঘাতে জিয়ার মুখের এক পাশ উড়ে গিয়েছিল।’
চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি জিয়াউদ্দিন বলেন, সার্কিট হাউসের এই পরিবেশ দেখে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে যাই। দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, সর্বাধিনায়ক এবং জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের এমন মৃত্যু আমাকে চরম ব্যথিত করে। যে মানুষটির এক ডাকে পুরো সেনাবাহিনী সাড়া দিত, তাকেই নিজের বাহিনীর কিছু সদস্যের হাতে নিহত হতে দেখে আমি সেদিন বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। গুলিবিদ্ধ হয়ে জিয়াউর রহমানের লাশ মাটিতে পড়ে আছে, এটি বিশ্বাস করা যায়? আমি তাড়াতাড়ি নিচে নেমে আসি। তখন আমরা সবাই ভীতসন্ত্রস্ত ও হতভম্ব। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলাম। আমরা সম্মানিত একজন মানুষকে সুস্থ ও নিরাপদ রেখে এলাম আর তাকে খুন করা হয়েছে! রাতারাতি কীভাবে আমরা এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে পড়লাম!
আমার দেশকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে তৎকালীন জেলা প্রশাসক জিয়াউদ্দিন ৪৪ বছর আগে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে জিয়া হত্যার সেই নৃশংস ঘটনার হৃদয়বিদারক এ বিবরণ দেন। তিনি হত্যাকাণ্ডের আগের ও পরের ঘটনাবলি এবং ভয়ংকর মুহূর্তগুলোর কথাও তুলে ধরেন।
যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে গত ২৪ অক্টোবর মেরিল্যান্ডের পটোম্যাক শহরের নিজ বাসভবনে তার এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এ সময় আমার বন্ধু জন হপকিনস ইউনিভার্সিটির সাবেক গবেষক এবং বর্তমানে মন্টগোমারি কলেজের অ্যাডজাংক্ট প্রফেসর ড. শোয়েব চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন, যিনি এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেন। জিয়া হত্যার ঘটনা নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন জিয়াউদ্দিন। এর মধ্যে তার ‘অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারম্যাথ’ বইটি উল্লেখযোগ্য। বইটিতে তিনি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেছেন।
সাক্ষাৎকারে জিয়াউদ্দিন বলেন, ১৯৮১ সালের ৩০ মে যে আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক আর আতঙ্কের একটি দিন হবে, সে কথা আমি কোনো দিন দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। প্রেসিডেন্ট জিয়া ১৯৮১ সালের মে মাসের মাঝামাঝি কক্সবাজারে এসেছিলেন এক সামরিক মহড়া দেখতে। এ মাসেই তিনি যে আবার চট্টগ্রাম সফরে আসবেন, তা জানা ছিল না। মাত্র দুই সপ্তাহ পর তার আবার চট্টগ্রাম সফর আমাকে বিস্মিত করেছিল। আগের দিন ২৯ মে শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জিয়া মাত্র ৪৮ ঘণ্টার নোটিসে চট্টগ্রামে আসেন। কিন্তু সেই আসা যে তার চট্টগ্রামে শেষ আসা হবে, তা কি জানতাম?
তিনি আরো বলেন, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব হঠাৎ আমাকে ফোনে জানান, প্রেসিডেন্ট জিয়া জরুরি রাজনৈতিক কারণে চট্টগ্রামে আসছেন, থাকবেন মাত্র এক দিন। যেহেতু এটি রাজনৈতিক সফর, তার কোনো সরকারি কর্মসূচি থাকবে না। তবে জেলা প্রশাসক হিসেবে আমি ও বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিনকে তার কাছাকাছি থাকতে হবে, যদি প্রেসিডেন্টের কোনো প্রয়োজন পড়ে।
আমি জানতে পারি, প্রেসিডেন্টের এই সফরটি ছিল চট্টগ্রাম বিএনপির অন্তঃকোন্দল মেটানোর জন্য। বিবদমান দুই গ্রুপের এক পক্ষের পেছনে ছিলেন তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী জামালউদ্দিন আর আরেক পক্ষের সমর্থক ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার সুলতান আহমেদ চৌধুরী। দুজনই ছিলেন চট্টগ্রামের লোক। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে, বিএনপির দুই গ্রুপ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কয়েক মাস ধরেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে এবং শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। কোন্দল মেটানোর জন্য প্রেসিডেন্ট জিয়া ২৯ মে সকালে চট্টগ্রামে আসেন। দুপুরের খাবারের পর দুই গ্রুপ নিয়ে বৈঠক শুরু করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। গভীর রাত পর্যন্ত চলে বৈঠক। মাঝে নিজ কক্ষে রাতের খাবার খান প্রেসিডেন্ট। আবার বৈঠক করেন। এরপর বৈঠক শেষে সার্কিট হাউসে নিজ কক্ষে ঘুমিয়ে পড়েন। কিন্তু ভোরের আলো ফোটার আগেই ৪টা, ৫টার সময় একদল বিপথগামী সেনাকর্মকর্তা সার্কিট হাউস আক্রমণ করে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করে।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমি জানতে পারি ভোর ৪টার দিকে সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি গুলি করতে করতে সার্কিট হাউসে প্রবেশ করে। যেসব সেনা অফিসার সার্কিট হাউসে ঢোকে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব আর লে. কর্নেল ফজলে হাসান। মতিউর ও মাহবুব সার্কিট হাউস আক্রমণের পুরোভাগে ছিলেন। এদের মধ্যে লে. কর্নেল মতিউর নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করেন জিয়াউর রহমানকে । দুই খুনি মতি এবং মাহবুব জেনারেল মঞ্জুরের সঙ্গে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের গুলিতে নিহত হন।
জিয়াউদ্দিন তার ‘অ্যাসাসিনেশন অব জিয়াউর রহমান অ্যান্ড আফটারম্যাথ’ বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, চট্টগ্রাম সেনানিবাসের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুরকে ১৯৮১ সালের ৩০ মের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের প্রধান হিসেবে দায়ী করা হয়। তবে তার অনুমতি না নিয়েই সার্কিট হাউসে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে হত্যা করা হয়। মঞ্জুর জিয়া হত্যার বিষয়টি আগে থেকে জানতেন না এবং ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর জানতে পারেন।
এ প্রসঙ্গে জিয়াউদ্দিন বলেন, ‘ঘটনার পর সকালে যখন মেজর রেজাউল করিম জেনারেল মঞ্জুরকে জানান যে, জিয়াউর রহমানের মৃতদেহ সার্কিট হাউসে রয়েছে, তখন মঞ্জুর হতচকিত হয়ে পড়েন। মঞ্জুর দুবার বলে ওঠেন, ওহ, হোয়াট দে হ্যাভ ডান! হোয়াট দে হ্যাভ ডান!’
বইয়ে তার পর্যবেক্ষণে জিয়াউদ্দিন উল্লেখ করেন, জিয়া এবং মঞ্জুর উভয়কে তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। তাদের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে একটি আন্তরিকতার সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তারা একে অন্যের প্রতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং এই ঘনিষ্ঠতা বহু বছর ধরে ছিল। জিয়াউর রহমান যখন রাজনৈতিক দল গঠন করেন, তখনই তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। মঞ্জুর এতে অসন্তুষ্ট ছিলেন। জেনারেল মঞ্জুর আশা করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়া তাকে সেনাপ্রধান করবেন। কিন্তু সেনাপ্রধান করা হয় পাকিস্তানফেরত অমুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা জেনারেল এরশাদকে। এ নিয়ে মঞ্জুরের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। জেনারেল মঞ্জুর এরশাদকে দুর্নীতিবাজ মনে করতেন। এরশাদ তাকে চট্টগ্রামে বদলি করে দিলে মঞ্জুরের ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। তবে জিয়া ও মঞ্জুরকে আমি যতটুকু জানি এবং দেখেছি তাতে বলতে পারি, জিয়াউর রহমানের প্রতি ক্ষোভ-অসন্তুষ্ট সত্ত্বেও জেনারেল মঞ্জুরের এমন কোনো ব্যক্তিগত আক্রোশ ছিল না, যে কারণে তিনি জিয়াকে হত্যা করতে পারেন। যতটুকু জেনেছি, সার্কিট হাউস থেকে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ক্যান্টনমেন্টে তুলে নেওয়ার পরিকল্পনা ছিল জেনারেল মঞ্জুরের। সেখানে জিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করেন সেনাপ্রধান থেকে জেনারেল এরশাদকে অপসারণ করে জেনারেল মঞ্জুরকে সেনাপ্রধান করা।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের কারণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী বলেন, ‘এ সম্পর্কে আমি আমার বইগুলোতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছি। আমি মনে করি, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এর সঙ্গে দেশি-বিদেশি নানা পক্ষ, সেনাবাহিনীর একাধিক পক্ষের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। বিশেষ করে এই ষড়যন্ত্রে এরশাদ জড়িত ছিলেন। কারণ জিয়াকে হত্যার দুদিন আগে তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ চট্টগ্রাম ঘুরে যান। যার গুলিবর্ষণে জিয়া নিহত হন, সেই কর্নেল মতি ঘটনার আগে এরশাদের সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে আসেন।
তবে জিয়া হত্যায় এরশাদের জড়িত থাকার কথা জিয়াউদ্দিন তার বইয়ে এবং আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারের সুনির্দিষ্টভাবে না বললেও তিনি হত্যাকাণ্ড ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের এমন কিছু দিক তুলে ধরেন, যা সামরিক এবং রাজনৈতিক মহলে এরশাদের ভূমিকার বিষয়ে সন্দেহের জন্ম দেয়।’
জিয়াউদ্দিন মনে করেন, জেনারেল মঞ্জুরকে হত্যাও ষড়যন্ত্রের অংশ। এরশাদের নির্দেশে জেনারেল মঞ্জুরকে পুলিশের কাছ থেকে সেনা হেফাজতে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। মঞ্জুরকে একটি বৃহৎ ষড়যন্ত্রের বলির পাঁঠা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। জিয়াউদ্দিন মনে করেন, এরশাদ এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছেন। জিয়া হত্যার পর এরশাদের রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মাত্র এক বছরের মধ্যে তিনি বিচারপতি সাত্তারের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিএনপির নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন, যা ষড়যন্ত্রে এরশাদের জড়িত থাকার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
জিয়াউদ্দিন চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শেষ সফরকালে তার সঙ্গে আমার যে কথা হয়েছে, কোনো দিন তা ভুলতে পারব না। ২৯ মে প্রেসিডেন্টকে নিয়ে আমি চট্টগ্রাম চকবাজার-সংলগ্ন চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছি। প্রেসিডেন্ট জিয়া চট্টগ্রাম ক্লাবের খাবার পছন্দ করতেন। সেখানকার বাবুর্চি দিয়ে খাবার রান্না করিয়েছি। রাতের ডিনারে চট্টগ্রাম ক্লাব থেকে আনা তার প্রিয় খাবার তন্দুর রুটি, ডাল ও কাবাব তিনি খেয়েছেন। বলেছেন, খাবার সুস্বাদু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট জিয়া গুরুগম্ভীর ও সরল প্রকৃতির ছিলেন। তার মধ্যে রসকষ খুব একটা ছিল না। কথা বলতেন সোজাসাপ্টা এবং কমান্ডের সুরে। কথায় মারপ্যাঁচ থাকত না, যা বিশ্বাস করতেন অবলীলায় বলে দিতেন। স্বল্পাহারী এই মানুষটি ছিলেন ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সৎ। তার শত্রুরাও তার সততা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ পড়ুন ৪-এর পাতায়Ñ