হোম > আমার দেশ স্পেশাল

শ্রম রপ্তানির আড়ালে রাশিয়ায় সৈনিক নিয়োগের সিন্ডিকেট

পীর জুবায়ের

শ্রম রপ্তানির নামে বাংলাদেশি নাগরিকদের রাশিয়ায় পাঠিয়ে সৈনিক হিসেবে যুদ্ধে অংশ নিতে বাধ্য করছে সংঘবদ্ধ একটি চক্র। ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে তারা দেশের বিভিন্ন জেলার যুবকদের যুদ্ধের ময়দানে ঠেলে দিচ্ছে। মূলত ঢাকার বাইরের ২৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি তরুণ-যুবকদেরই টার্গেট করছে এ নেটওয়ার্ক।

ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, প্রথমে স্থানীয় দালালরা বিদেশে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখায়। পরে তাদের নিয়ে আসা হয় রিক্রুটিং এজেন্সিতে। এসব এজেন্সি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে পাঠায় রুশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায়। সেখান থেকে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিভিন্ন ফ্রন্টে অংশ নিতে তাদের বাধ্য করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করতে কাজ করছে একটি শক্তিশালী চক্র।

শ্রমিক ভিসায় গিয়ে রাশিয়া সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এবং পরবর্তী সময়ে নিখোঁজ হওয়া অন্তত ১৫টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে আমার দেশ। তারা জানে না তাদের ছেলে-স্বামী ‍কিংবা বাবার সর্বশেষ অবস্থা। জানা গেছে, সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিদেশ বিশেষ করে রাশিয়ায় গিয়ে নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের অধিকাংশই লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও চুয়াডাঙ্গা জেলার বাসিন্দা।

বিভিন্ন নথিপত্র ও পারিবারিক তথ্য অনুযায়ী, বন্যা বিজয় ওভারসিজ লিমিটেড (আরএল ১৩৩৪), এসপি গ্লোবাল রিসোর্স (আরএল ২২৫৩), ম্যানিজ পাওয়ার করপোরেশন (আরএল ৯৭৩) ও ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন রিক্রুটমেন্ট লিমিটেড নামের চারটি এজেন্সি রাশিয়ায় লোক পাঠায়।

প্রথমে তাদের স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে প্রলোভন দেখিয়ে এসব রিক্রুটিং এজেন্সিতে নেওয়া হয়। এরপর এজেন্সি এক থেকে দেড় লাখ টাকা বেতনের কথা বলে ৫-১১ লাখ টাকার চুক্তি করে। এসব লোকজনকে ‘সিনোপেক ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ রাশিয়া এলএলসি’ নামের একটি চীনা প্রতিষ্ঠানে কাজের কথা বলে পাঠানো হয়, কিন্তু সেখানে পৌঁছেই তারা জানতে পারেন, গন্তব্য আসলে যুদ্ধক্ষেত্র।

চুয়াডাঙ্গার কমলাপুরের লিপি বেগমের স্বামী মনিরুল ইসলাম সাত মাস ধরে নিখোঁজ। ঢাকার রেডিও কলোনিতে তিন বছরের মেয়েকে নিয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন তিনি। লিপির ভাষায়, আমার স্বামী ঢাকায় গাড়ির দোকানে কাজ করতেন। স্থানীয় দালাল রবিন ও তার মামা সজল রাশিয়ায় ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখায়। প্রায় ১১ লাখ টাকার মৌখিক চুক্তিতে বন্যা বিজয় এজেন্সির মাধ্যমে তাকে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। পৌঁছার কিছুদিন পর তাকে জোর করে সেনা প্রশিক্ষণে নিয়ে যায়। প্রশিক্ষণের পর রাশিয়ার হয়ে তাকে ইউক্রেনে যুদ্ধে পাঠানো হয়েছে। মনিরুলের সর্বশেষ বার্তা ছিল ১৬ এপ্রিল, আমি খুব বিপদে আছি। হয়তো আর কথা হবে না। মেয়ের খেয়াল রেখো। বিষয়টি স্থানীয় দালাল রবিনকে জানালে সে পাল্টা হুমকি দেয়। পরবর্তী সময়ে এজেন্সিও কোনো দায় নেয়নি।

২৫ বছর বয়সি গাজীপুরের অয়ন বন্যা বিজয়ের মাধ্যমেই রাশিয়া যান। তার বাবা রতন মণ্ডল জানান, স্থানীয় দালাল ইব্রাহিম ছয় লাখ টাকার চুক্তিতে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে অয়নকে রাশিয়া পাঠায়। এক মাস পর অয়ন জানায়, তাকে সেনাক্যাম্পে নেওয়া হয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন সীমান্তে পাঠানো হয়েছে। মে মাসের ১২ তারিখে সে জানায়, আমি নেটওয়ার্কের বাইরে চলে আসছি। যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এর পর থেকে তার কোনো খোঁজ নেই। দালাল ইব্রাহিমের নম্বরে একাধিকবার ফোন দিলেও রিসিভ না করায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

চট্টগ্রামের আনোয়ারার ৩০ বছর বয়সি অমিত বড়ুয়া শরিফুল্লাহ নামের এক দালালের মাধ্যমে বন্যা বিজয় এজেন্সিতে যোগাযোগ করেন। ভালো বেতনে চাকরির প্রস্তাবে প্রায় ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে রাশিয়া পাড়ি দেন। ৭ মাস ধরে নিখোঁজ। পরিবারের সঙ্গে শেষ কথা হয় এপ্রিলের ২৮ তারিখে। তার ভাই সুমিত বড়ুয়া বলেন, তার এক সহকর্মী ভয়েস মেসেজে জানায়, ইউক্রেনে যুদ্ধের সময় রকেট হামলায় অমিত নিহত হয়েছেন। ওই ভয়েস বার্তায় শোনা যায়, ‘আমি সোহাগ (মানিকগঞ্জ) ও অমিতের রুমমেট। অমিত আর নেই। রকেট হামলায় ও মারা গেছে, সোহাগ আহত। পরে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সোহাগও নিহত হয়েছে। অমিতকে রাশিয়ায় পাঠানো দালাল শরিফুল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি বলেন, অমিতের সঙ্গে আমার অনেক বছরের পরিচয়। আমি তো শুধু বন্যা বিজয়ের কাছে নিয়ে গেছি। আমিও চাই পরিবার যেন অমিতের সন্ধান পায়।

লক্ষ্মীপুর সদরের ভবানিগঞ্জের সাজ্জাদ হোসেন ছিলেন পরিবারের প্রধান চালিকাশক্তি। স্থানীয় দালাল আজাদ তাকে রাশিয়ায় উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখায়। পরে তাকে এস.পি গ্লোবাল রিসোর্সের মাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে রাশিয়ায় পাঠানো হয়। পরিবার বলছে, সেখানে পৌঁছে তাকে জোর করে সেনাবাহিনীতে যোগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

সাজ্জাদের পিতা সিরাজ মিয়া জানান, জানুয়ারির ১৪ তারিখে রাশিয়া গেলে তাকে প্রশিক্ষণের নামে আলাদা একটি ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সে সময় সাজ্জাদ জানিয়েছিল, যুদ্ধ না করলে দেশে ফিরতে পারব না, মেরে ফেলারও আশঙ্কা আছে। তাই বাধ্য হয়ে রাজি হয়েছি। পরিবারের সঙ্গে তার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল ফেব্রুয়ারিতে; তখন তিনি জানান, বড় ঝুঁকির মধ্যে আছেন। দালাল আজাদের ফোনে বারবার কল করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।

ময়মনসিংহের রসুলপুরের মহসিন আহমদের বিষয়টিও একই রকম। তিনি ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড কো-অপারেশন রিক্রুটমেন্টের মাধ্যমে আগস্টে রাশিয়া গিয়েছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী ওয়েল্ডারের কাজ পাওয়ার কথা থাকলেও পরে তাকে সেনা ক্যাম্পে পাঠানো হয়। তার ভাই মাহফুজ মিয়া জানান, এজেন্সি চুক্তি ভঙ্গ করেছে এবং মহসিনকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। বর্তমানে পরিবার ভয়ের মধ্যে আছে, কারণ ইউক্রেনে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধরত অবস্থায় তার জীবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ভুক্তভোগী পরিবারগুলো বলছেন, কেউ কি তাদের স্বামী-সন্তান কিংবা ছেলেকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইবে; তা-ও টাকা দিয়ে? আমাদের সবার সঙ্গে দালাল ও এজেন্সি প্রতারণা করেছে। আমাদের স্বামী-সন্তানকে সেনাবাহিনীতে বিক্রি করে দিয়েছে। এখন তারা কিছু জানে না বলে আবারও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছে।

এসপি গ্লোবাল রিসোর্সের অফিসিয়াল নম্বরে যোগাযোগ করলে ‘আজাদ’ নামের একজন বলেন, আমরা মালয়েশিয়া নিয়ে কাজ করি। আমাদের ৫০ জন এজেন্ট রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ যদি আমাদের এজেন্সি ব্যবহার করে এসব করে থাকে তাহলে তা আমরা কী করে বলব। তবে কেউ যদি বলে সরাসরি আমাদের হাতে টাকা দিয়েছে, তাহলে আমরা এর দায় নেব।

বন্যা বিজয় ওভারসিজ লিমিটেডের ম্যানেজার আকিব ইসলাম আমার দেশকে বলেন, তাদের পক্ষ থেকে কাউকে রাশিয়া সেনাবাহিনীতে বিক্রি করা হয়নি। সিনোপেক কোম্পানি বাংলাদেশ থেকে শত শত কোম্পানি নিচ্ছে। এখন এর মধ্যে ৫-১০ জন যদি চাকরি ছেড়ে সেনাবাহিনীতে চলে যান তাহলে এর দায় কেন আমরা নেব? তবে যারা নিখোঁজ হয়েছেন তাদের সন্ধান পেতে আমরাও খোঁজ-খবর নিচ্ছি।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির আমার দেশকে বলেন, শ্রমিকদের সেনাবাহিনীতে নিয়ে যাওয়া হবে এই বিষয়টি সাধারণত গোপন করা হচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য দুরভিসন্ধিমূলক হওয়ায় তারা ভালো বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখায়। আমাদের দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো এ প্রলোভনগুলো কাজে লাগায়।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে এ চক্র রাশিয়ায় সক্রিয়; একই পদ্ধতি আফ্রিকার মতো অন্যান্য অঞ্চলেও ব্যবহার করা হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে রাশিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে শ্রমিক প্রেরণ নিয়ন্ত্রণে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

তিনি আরো বলেন, যারা নিখোঁজ তাদের সন্ধান পেতে প্রয়োজনীয় তৎপরতা আরো জোরদার করতে হবে। অন্ততপক্ষে পরিবারগুলো যেন জানতে পারে তাদের আপনজন মৃত না জীবিত। যদি জীবিত থাকে তাহলে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান অনুবিভাগে দায়িত্বরত যুগ্মসচিব শহিদুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্য জানতে তার নম্বরে একাধিকবার কল দিলে রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।

মৃত্যু বাড়াচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ের চিকিৎসা ঘাটতি

হাইকোর্টের রায়ে জটিল পরিস্থিতিতে ইসি

১৩ নভেম্বর কী হবে ঢাকায়, চিন্তায় কলকাতার আ.লীগ নেতারাও

পুড়ে অঙ্গার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী জুলহাস

দেশজুড়ে চোরাগোপ্তা হামলার পরিকল্পনা

নামসর্বস্ব সংগঠনের ব্যানারে ফের সক্রিয় ইসকন

অমিত শাহের বন্ধু পরিচয়ে দাদাগিরি আ.লীগ নেতার

আওয়ামীপন্থি সিবিএ নেতাদের পুনর্বাসনকেন্দ্র যমুনা অয়েল

ঢাকার বিভিন্ন স্থানে একযোগে নাশকতা, সন্দেহে আ.লীগ

বিএনপিতে মনোনয়ন নিয়ে সংঘাত বাড়ছে