বিএনপির মনোনয়ন
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর থেকে রাজশাহী জেলার ছয়টি সংসদীয় আসনের গুরুত্বপূর্ণ চারটিতে দলীয় ঐক্যের বদলে তীব্র হয়েছে অস্থিরতা। স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশের তীব্র প্রতিক্রিয়া ও প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সৃষ্ট এ জটিলতা দলের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী), রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর), রাজশাহী-৪ (বাগমারা) এবং রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর)—এ চার আসনে বিএনপির প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ করছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তারা বলছেন, এ চার আসনে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে দল বড় ধরনের ত্রুটি করেছে, তৃণমূলের মতামতও উপেক্ষা করা হয়েছে। তবে রাজশাহী-২ ও ৬ আসনের মনোনয়ন নিয়ে কোনো অসন্তোষ নেই।
রাজশাহী-১ : কাফনের কাপড় পরে সড়ক অবরোধ
তানোর-গোদাগাড়ী আসনে বিএনপির প্রার্থী মেজর জেনারেল (অব.) শরিফ উদ্দিনের বিরুদ্ধে দলের কঠিন সময়ে এলাকায় অনুপস্থিতি, নির্দেশনা অমান্য এবং অন্যান্য বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ এতটা তীব্র যে, দলের একাংশের নেতাকর্মীরা ‘কাফনের কাপড়’ পরে প্রতীকী প্রতিবাদ জানাচ্ছেন তার বিরুদ্ধে। নিয়মিত সড়ক অবরোধ ও সমাবেশে বিক্ষোভকারীরা দাবি করছেন, শরিফ উদ্দিন স্থানীয় নেতাকর্মীদের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এ আসনে দলের জয়ের সম্ভাবনা কমে আসছে। তারা এ আসনে সুলতানুল ইসলাম তারেককে প্রার্থী করার দাবি জানাচ্ছেন।
গোদাগাড়ী-তানোর এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরিফ উদ্দিন ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে এলাকায় আসেননি। এছাড়া তার বিএনএমের মনোনয়ন নেওয়াসংক্রান্ত বিভিন্ন গুঞ্জন নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে প্রশ্ন রয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীদের আস্থা ও সমর্থন অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় নির্বাচনে বিজয় অর্জন করা তার পক্ষে কঠিন হবে।
রাজশাহী-৩ : ‘বহিরাগত’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে মশাল মিছিল
পবা-মোহনপুর আসনের প্রার্থী শফিকুল হক মিলনকে ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা তার মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে মানববন্ধন, মশাল মিছিল ও মহাসড়ক অবরোধ করছেন। তবে প্রার্থী মিলন দাবি করেন, ২০১৩ সাল থেকেই তিনি এ এলাকার মানুষের সঙ্গে মিশেছেন এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনে তার নিশ্চিত বিজয় ‘ছিনিয়ে নেওয়া’ হয়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মনোনয়নবঞ্চিত রায়হানুল হক বলেন, দলীয় নেতাকর্মীসহ এলাকাবাসী চায় তাদের আসনে এমপি হবেন তাদেরই প্রতিবেশী কেউ। আমি এলাকার মানুষ। দীর্ঘদিন জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েও নেতাকর্মীদের সঙ্গে ছিলাম। এছাড়া লোকজন মনে করে বিপদ-আপদে যাকে কাছে পাওয়া যাবে তাকেই প্রার্থী করা প্রয়োজন। দলের নেতাকর্মীরা এ আসনে প্রার্থী বদলের দাবিতে অনড় আছেন।
রাজশাহী-৪ : ‘ডিএম জিয়া ঠেকাও’ প্রচারণা
বাগমারা আসনে সবচেয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে প্রার্থী ডিএম জিয়াউর রহমান জিয়াকে ঘিরে। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, দলবিরোধী কার্যকলাপ এবং সন্ত্রাসী গ্রুপ লালন-পালনের অভিযোগ করছেন। এমনকি দল থেকে তার একবার বহিষ্কারের ইতিহাস টেনে এনেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা সমালোচনা করছেন। প্রার্থীর ভাইকেও সম্প্রতি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এ আসনে দলের ৩৭ জন পদধারী নেতা একযোগে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে লিখিত অভিযোগ করে তার মনোনয়ন বাতিল দাবি করেছেন। স্থানীয়দের মধ্যে ‘ডিএম জিয়া ঠেকাও’ মনোভাব জোরালো হয়ে উঠেছে।
রাজশাহী-৫ : আঁতাতের অভিযোগ
পুঠিয়া-দুর্গাপুর আসনের প্রার্থী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম মণ্ডলের বিরুদ্ধে উঠেছে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ, অতীতে ধানের শীষের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে ‘আঁতাত’-এর গুঞ্জন। বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা ‘নজরুল হটাও, পুঠিয়া-দুর্গাপুর বাঁচাও’ স্লোগান দিয়ে মহাসড়ক অবরোধ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাদের অভিযোগ, গত ১৭ বছর তিনি দলীয় কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলেন না।
বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করেন, নজরুল ইসলাম অতীতে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তিনি ধানের শীষের বিপক্ষে টেলিভিশন প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেন। ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট করে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ডা. মনসুর রহমানের সঙ্গে ‘আঁতাত’ করেছিলেন বলেও দাবি করেন তারা। ওই ঘটনায় সে সময় কেন্দ্রীয় বিএনপি তার বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিল।
বিশ্লেষকদের মূল্যায়ন
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক আব্দুল মজিদ বলেন, যে দলেরই হোক, তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে মনোনয়ন দিলে নির্বাচনের আগেই দলে ভাঙনের ঝুঁকি তৈরি হয়। রাজশাহীর এ চার আসনে সেটিই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
আরেক বিশ্লেষক আনোয়ার হোসেনের মতে, বিএনপির বর্তমান সংকটের মূল কারণ প্রার্থী নির্ধারণের প্রক্রিয়াগত ত্রুটি। তৃণমূলের কণ্ঠস্বর গুরুত্ব দিয়ে শোনা না হলে নির্বাচনি মাঠে ঐক্য বজায় রাখা অত্যন্ত কঠিন হবে।
বিএনপির ভোটাররা হতাশ, ক্ষুব্ধ
মনোনয়ন বিতর্ক ঘিরে শুধু দলের নেতাকর্মীরাই নন, বিএনপির সাধারণ ভোটাররাও ব্যাপকভাবে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, পবা, মোহনপুর, বাগমারা, পুঠিয়া ও দুর্গাপুরের বিভিন্ন এলাকার ভোটাররা জানিয়েছেন, তৃণমূলের মতামত অগ্রাহ্য করে হঠাৎ প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ায় তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে।
তানোরের এক বিএনপি সমর্থক শিক্ষক বলেন, দল যখন মাঠে টিকে থাকার লড়াই করছে, তখন ভুল ব্যক্তিকে মনোনয়ন দিলে তা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছুই নয়। আমরা আশা করেছিলাম তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
পবা-মোহনপুরের রিয়াজুল ইসলামসহ কয়েকজন ভোটার একসঙ্গে মতামত প্রকাশ করে বলেন, বিএনপি যদি নিজ ঘরের মানুষকে এক করতে না পারে, তাহলে নির্বাচনে জনগণকে এক করবে কীভাবে? আমরা হতাশ।
বাগমারা ও পুঠিয়া-দুর্গাপুর অঞ্চলের ভোটারদের বড় একটি অংশ মনে করছে, মনোনয়ন নিয়ে এ অনিশ্চয়তা ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল নির্বাচনের আগে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
একজন ব্যবসায়ী ভোটার বলেন, এভাবে নিজেদের মধ্যে অস্থিরতা থাকলে বিএনপির জন্য মাঠের পরিস্থিতি কঠিন হবে। এখনই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করলে ক্ষতি হবে দলেরই।
ভোটারদের অনেকেই দলের প্রতি অনুগত থাকলেও ভুল সিদ্ধান্ত, অনভিজ্ঞ প্রার্থী, মাঠপর্যায়ের মতামত উপেক্ষা ও কেন্দ্রের বাস্তবতা না বোঝা—এ চার কারণকে পরিস্থিতির মূল উৎস হিসেবে দেখছেন। স্থানীয় পর্যায়ের ভোটাদের একাংশ এটিকে বিএনপির নির্বাচনি প্রস্তুতির জন্য ‘খারাপ সংকেত’ বলেও মন্তব্য করেছে।
মনোনয়ন ঘিরে রাজশাহীর চার আসনে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ দুর্যোগ বিএনপির জন্য আগামী নির্বাচনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। স্থানীয় নেতাকর্মীদের জোরালো দাবি, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দ্রুত হস্তক্ষেপ এবং এ সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধান। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট আসনগুলোয় দলটির নির্বাচনি অবস্থান মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।