শতবর্ষী আলোকবর্তিকা
শিক্ষা-সংস্কৃতিসহ মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়তে কাজ করে যাচ্ছে মাদারীপুরের শিবচরের পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয়। এ অঞ্চলে অজ্ঞতার অন্ধকার ও কুসংস্কার থেকে আলোকিত মনন গড়ার অভিযাত্রায় অন্তহীন পথচলা অব্যাহত রেখেছে শতবর্ষী বিদ্যাপীঠটি। ১০৫ বছরে এখান থেকে জ্ঞান অন্বেষণ করে সমাজে বরেণ্য হয়েছেন অনেকেই। মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলন-সংগ্রামে রয়েছে তাদের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। পুঁথিগত শিক্ষার সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে সুদক্ষ শিক্ষকদের পাঠদানে বিদ্যালয়টি মেধাবী শিক্ষার্থী তৈরির সূতিকাগারে পরিণত হয়েছে।
একদল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তরুণ ও তাদের অগ্রজদের উদ্যোগে সমাজের সবার সম্পৃক্ততা আর সহযোগিতায় ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘দ্য পাঁচ্চর হাই ইংলিশ স্কুল’। উল্লেখযোগ্য উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ চ্যাটার্জী। উদ্যোগী তরুণরা বিনা বেতনেই সোৎসাহে পাঠদান শুরু করেছিলেন।
১৯৪৩ সালে বিদ্যালয়টির প্রথম ব্যাচ তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। ভারত ভাগের পর অনেক স্থানে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে থাকে। কোথাও কোথাও দাঙ্গা লাগার সম্ভাবনা তৈরি হলে পাঁচ্চর এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। ফলে পাঁচ্চর পরিণত হয় জনবিরল এলাকায়। এরপর ১৯৫২ সালে ফের শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও স্থবিরতা নেমে আসে বিদ্যালয়টির অগ্রযাত্রায়।
অবশেষে ১৯৫৪ সালে একদা প্রভাতী আলোয় আবার ঝলমল করে ওঠে স্কুল আঙিনা। শিক্ষার্থীদের কলরবে মুখরিত হয় চারপাশ। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু হয়। তৎপরতা চলতে থাকে আবার পূর্ণাঙ্গ হাই স্কুলে রূপদানের। এ সময় স্কুলের নাম ও কারিকুলামে পরিবর্তন আসে। কিছুদিনের মধ্যেই (১৯৫৫ সালে) এখানে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন নন্দকুমার ইনস্টিটিউশনের ম্যাট্রিকুলেট মো. দেলোয়ার হোসেন এবং মাইনাদ্দিন আহমেদ। ১৯৫৬ সালেই এখানে নবম শ্রেণির পাঠদান চালু হয়।
পরবর্তী ইতিহাসে যার নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক সামসুদ্দিন আহমেদ। ১৯৬২ সালে পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয়ে তিনি অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকেই রাতারাতি এটি একটি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়।
বর্তমানে স্কুলটিতে মোট শিক্ষার্থী ৯৫০ জন। রয়েছে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, ডিজিটাল শিক্ষা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের (স্মার্ট ক্লাসরুম, কম্পিউটার কক্ষ) সুযোগ। এছাড়াও খেলার মাঠসহ রয়েছে সৃজনশীলতা বিকাশের নানা সুযোগ-সুবিধা।
যারা সরকারি ও মেধাবৃত্তি পায়, তাদের জন্য রয়েছে ফ্রি পড়াশোনার সুযোগ। দরিদ্র মেধাবীদের জন্য রয়েছে ইউনিফর্ম দেওয়াসহ সব সুযোগ-সুবিধা। এছাড়া একই বাবা-মায়ের দুই সন্তান থাকলে একজনকে ফ্রি পড়াশোনা করার ব্যবস্থা রয়েছে।
ফলাফলের দিক থেকে পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয় বরাবরই ভালো অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৩ সালে এসএসসিতে অংশ নেয় ১১৬ জন। এদের মধ্যে কৃতকার্য হয় ১১৪ জন এবং জিপিএ-৫ অর্জন করে ২৭ জন। ২০২৪ সালে এসএসসিতে অংশ নেওয়া ১২৭ জন শতভাগ পাসসহ জিপিএ-৫ পেয়েছে ২৭ জন। সর্বশেষ ২০২৫ সালে এসএসসিতে অংশ নেওয়া ৯৮ জনের সবাই পাসসহ জিপিএ-৫ পেয়েছে ২১ জন।
৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের অনেকেই সে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন বীরবিক্রমে। পোদ্দারের চরের শহীদ আব্দুল মালেক তাদেরই একজন। শিবচরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ নাম চিরভাস্বর হয়ে আছে।
জানা যায়, বিদ্যালয়টির মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী, যিনি দৈনিক ইত্তেফাক ও নিউ নেশনের সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন ওই সময়ের মুসলমান মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে অন্যতম। পরবর্তীতে তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন। প্রিন্সিপাল দেলোয়ার হোসেন ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদের সদস্য ছিলেন। অধ্যাপক ড. ফরহাদ হোসেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (ভিসি) ছিলেন। এছাড়াও স্থানীয় জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবদান রাখা বহু পদস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারী, উদ্যোক্তা, পেশাজীবী, রাজনৈতিক কিংবা আলোকিত ব্যক্তিত্বকে জন্ম দিয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. মো. মেহেদী হাসান বলেন, আমি পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয়ের একজন প্রাক্তন ছাত্র হতে পেরে গর্বিত। আমি ধন্যবাদ জানাই শতবর্ষ পূর্বে যারা মহতী উদ্যোগ নিয়ে স্থানীয় আঞ্চলিক ঐতিহ্য ও সম্প্রীতিকে প্রতিনিধিত্ব করে সর্বজনগৃহীত বিদ্যালয়টি গড়ে তুলে সর্বস্তরে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে যথাযথ ভূমিকা রেখেছেন। প্রতিষ্ঠানটি ধারাবাহিক ফলাফল আরো ভালো করবে—এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহ আলম সিরাজী বলেন, আমি দীর্ঘ ১২ বছর যাবৎ এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছি। ইতোমধ্যেই স্কুলটি ১০০ বছর অতিক্রম করেছে। এখানকার রেজাল্ট খুবই ভালো। বরাবরের মতো এবারো শতভাগ পাসসহ জিপিএ-৫ পেয়েছে ২১ জন। ফলে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি উপজেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে।
তিনি বলেন, মাদারীপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর মডেল স্কুল হিসেবে ইতোমধ্যেই পরিচিত লাভ করছে পাঁচ্চর উচ্চ বিদ্যালয়। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা। যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকারা আন্তরিকতার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনা করান। স্কুলটি এলাকায় আলোকবর্তিকার মতো আলো ছড়াচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটি স্মার্ট স্কুল গড়ে তুলতে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারও আমরা করছি।
প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, আমাদের এখানে ছাত্রছাত্রী অনুযায়ী পর্যাপ্ত ভবন নেই। এজন্য অনেক সময় শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে কষ্ট হয়। এছাড়া বিদ্যালয়ে একটি কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা জরুরি।
স্কুল পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক কোচ, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ সাজ্জাদ হোসেন সিদ্দিকী লাবলু বলেন, উচ্চ বিদ্যালয়টি একটি শতবর্ষী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এ স্কুলে আমার বাবা মোতাহার হোসেন সিদ্দিকী প্রথম ছাত্র ছিলেন, তাই এই ঐতিহ্যবাহী স্কুলের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা কাজ করে। আমি সব সময় এই স্কুলের খোঁজ-খবর রাখার চেষ্টা করি। স্কুলের শিক্ষক, অভিভাবক ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আমি মাঝে মাঝেই কথা বলি। তাদের কোনো সমস্যা থাকলে আমি সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করি। আশা করি এই স্কুলটি আগামীতে আরো ভালো ফলাফল ও মানসম্মত শিক্ষা অব্যাহত রাখবে।