চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে মগধরা ইউনিয়নের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে উপকূলীয় বন কেটে সরকারি জমি দখলে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মুছাপুর ইউনিয়ন বিএনপি সাধারণ সম্পাদক ইদ্রিস আলমের বিরুদ্ধে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তার অনুসারীদের নিয়ে রাতের আঁধারে বন কেটে উজাড় করছেন তিনি। আর নদী ও সড়ক পথে এসব গাছ স্থানীয় বিভিন্ন ইটভাটাসহ হাতিয়া ও সুবর্ণচরে পাচার করে দিচ্ছেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে। এতে দ্বীপ উপজেলার প্রধান উপকূল রক্ষা বাঁধ মারাত্মক হুমকিতে পড়ে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সেইসাথে সরকারি অর্থে লাগানো হাজার হাজার গাছ ধ্বংস হচ্ছে। হুমকি পড়ছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
অভিযোগ ওঠেছে, বিএনপি নেতা ইদ্রিস আলম প্রকাশ্যে বন উজাড় করলেও উপকূলীয় বন বিভাগ, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। স্থানীয় বাসিন্দারাও ভয়ে মুখ খুলছেন না। স্থানীয়ভাবে প্রশাসনকে বিষয়টি জানানো হলেও কোন ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
শুক্রবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মগধরা ইউনিয়নে দ্বীপ সুরক্ষা বাঁধ সংলগ্ন বনবিভাগের সৃজিত বনের প্রায় ২০ একর জায়গার কেওড়া ও অন্যান্য ম্যানগ্রোভ প্রজাতির হাজার হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সেখানে অসংখ্য গাছের গুঁড়ি দৃশ্যমান। কাটা গাছের গুঁড়ি ও ডালপালা বিস্তৃত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। এছাড়াও দেখা গেছে, কাটা গাছের টুকরো কুড়াচ্ছেন স্থানীয় নারীরা।
স্থানীয় বাসিন্দা মাস্টার রফিক উল্ল্যাহর অভিযোগ, গাছ কেটে বন উজাড়ের ঘটনায় বনবিভাগের কিছু অসাধু লোকজনের যোগসাজশ রয়েছে৷ আমরা অভিযোগ দেওয়ার পরেও বনবিভাগের কেউ ঘটনাস্থল পরিদর্শনও করেনি৷ এভাবে দীর্ঘদিন উপকূলীয় বনায়ন উজাড় হলেও প্রশাসন কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না৷ সন্দ্বীপ চ্যানেল তীরবর্তী প্রতিরক্ষা-বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নদীভাঙনের ঝুঁকি ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে বলেও আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
বেড়িবাঁধসংলগ্ন বাসিন্দা হাসিনা বেগম আমার দেশকে বলেন, গত একবছর ধরে বন উজাড় করা হচ্ছে। কিন্তুু গেল তিন সপ্তাহ ধরে বনে প্রতিদিন গাছ কাটা হচ্ছে।
বেড়িবাঁধের চা দোকানদার আলাউদ্দিন (ছদ্মনাম) আমার দেশকে জানান, আগে শুধু রাতে বন কাটা হলেও এখন পালাক্রমে বন কাটা হচ্ছে। একটি গ্রুপ রাত ১১টা থেকে ভোর পর্যন্ত, একটি গ্রুপ ভোর থেকে সকাল নয়টা পর্যন্ত বন কাটছে। সবই হচ্ছে বিএনপি নেতা ইদ্রিস আলমের নেতৃত্বে। তিনি প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হওয়ায় কেউ ভয়ে মুখ খুলছে না।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত বিএনপি নেতা ইদ্রিস আলম বলেন, ১৭ বছর বঞ্চিত থাকার পরেও নিজের জায়গার গাছ কাটতে অনুমতি নিতে হবে কেন? আশেপাশের ১০ কানি জমি তার নামে লীজ নেওয়ার দাবি করলেও দেখাতে পারেননি কোনো কাগজপত্র। এছাড়া সেখানে তার মালিকানাধীন আরও জমি রয়েছে বলে দাবি এই বিএনপি নেতার।
তবে বনবিভাগ ইদ্রিসের এ দাবি মানতে নারাজ। সন্দ্বীপ উপজেলা বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন মুঠোফোনে বলেন, কেউ যদি বনবিভাগের সৃজিত বাগানের কোনো অংশ নিজের সম্পত্তি বলে দাবি করে, তাকে প্রথমে লিখিত আবেদন করতে হবে। আবেদনের পর জমি জরিপ করে প্রক্রিয়া অনুযায়ী সিদ্ধান্ত হবে। অনুমতি ছাড়া বনবিভাগের গাছ কাটলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী দণ্ড দেওয়া হবে।
তিনি আরো বলেন, জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকলেও গাছ কাটা যাবে না। যাচাই-বাছাই শেষে মালিকানা প্রমাণ হলে তবেই জমি বুঝিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মংচিংনু মারমা আমার দেশকে জানান, ঘটনাটি তদন্তের প্রস্তুতি নিচ্ছে বন বিভাগ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, মগধরা এলাকার বিস্তৃত বনটি ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর কোস্টাল গ্রিনবেল্ট প্রকল্পের মাধ্যমে বনায়ন করা হয়। যা ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস থেকে উপকূলীয় অঞ্চলকে সুরক্ষা দেবে।
উল্লেখ্য, অনুমতি ছাড়া বনের গাছ কাটা বন আইন, ১৯২৭–এর ২৬ ও ৩৩ ধারায় দণ্ডনীয় অপরাধ। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী উপকূলীয় বনায়ন ধ্বংসকে পরিবেশগত ক্ষতি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এ ধরনের অপরাধে কারাদণ্ড ও জরিমানা করার বিধান রয়েছে। উপকূলীয় সুরক্ষা বন হওয়ায় কোস্টাল গ্রিন বেল্ট নীতিমালা অনুযায়ী এসব গাছ কাটাকে বিশেষভাবে দণ্ডনীয় বিবেচনা করা হয়। কেওড়া–ম্যানগ্রোভ বনায়ন ধ্বংসে বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হলে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন, ২০১২ অনুযায়ী অতিরিক্ত শাস্তির ব্যবস্থাও প্রযোজ্য হতে পারে।