পাহাড়ি জনপদ, মিঠা পানির অভাব, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিসহ প্রাকৃতিক নানা কারণে কৃষিতে চট্টগ্রামের অবদান অনেকটাই কম। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। প্রতিবছর প্রবৃদ্ধি হচ্ছে ফসল উৎপাদনে। যার মধ্যে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অবদান সবচেয়ে বেশি। কৃষি বিভাগের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে একফসলি জমিগুলোতে এখন বছরে কমপক্ষে দুটি, কোথাও কোথাও তিনটি করে ফসল হচ্ছে। এতে একদিকে, যেমন কৃষকের মুখে হাসি ফুটছে, অন্যদিকে দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর হয়ে ওঠায় অবদান রাখছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে ফসলি মাঠের ভেতর দিয়ে খাল খনন করার ফলে।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশের নতুন চরখাগরিয়া এলাকা। বিশাল মাঠে ধান চাষে ব্যস্ত কয়েকশ’ কৃষক। কেউ ধান লাগাচ্ছেন কেউবা জমি প্রস্তুত করছেন। কৃষকরা জানান, গত বছর পর্যন্ত বর্ষা মৌসুমে কোথাও হাঁটু পানি আবার কোথাও কোমর পানিতে নিমজ্জিত থাকত পুরো মাঠ। দূর থেকে দেখে বিল মনে হতো। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ আলাদা।
এক ফসলি জমিটিতে এবারই প্রথমবারের মতো দুই ফসল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে কৃষকরা। মাঠের মধ্য দিয়ে খাল খননের কারণে বৃষ্টিতে জমে থাকা পানি এই খাল দিয়ে নিষ্কাশন হচ্ছে অনায়াসে। আবার জোয়ারের সময় শঙ্খ নদীর মিঠা পানি ঢুকছে খালে। সেখান থেকে কৃষকরা শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ফিতা পাইপ ব্যবহার করে নিয়ে যাচ্ছে মাঠে। ভাটার সময় আবার এই পানি নেমে যাচ্ছে। দিনে অন্তত দু’বার ভূ-উপরস্থ পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে ফসল উৎপাদনে।
এই মাঠে আড়াই একর চাষযোগ্য জমি আছে আব্দুল মজিদের। সেই জমিতে ধান চাষে ব্যস্ত তিনি। মজিদ জানান, শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে এসব খাল প্রথম খনন করা হয়েছিল। এরপর আর খালনির্ভর কৃষিতে মনোযোগী হয়নি কোনো সরকার। ফলে খালগুলো একরকম নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়েছিল।
সম্প্রতি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ভরাট হওয়া খালগুলো পুনঃখনন করায় কৃষকদের অনেক লাভ হয়েছে। বহু বছর পর জমিতে এবার দুই ফসল করছেন তারা। অনেক কৃষক একটু পরিকল্পিতভাবে ধানের সঙ্গে রবিশষ্য মিলিয়ে তিন ফসল উৎপাদনের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
চাষাবাদে ব্যস্ত নবী আলম জানান, শুষ্ক মৌসুমে আগে ডিপ টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করে চাষাবাদ করতেন তারা। এবার প্রথমবারের মতো নদী থেকে আসা জোয়ারের পানি দিয়ে চাষাবাদ করছেন। টিউবওয়েলের পানিতে এক একর জমিতে ৮০ মণ ধান হলে জোয়ারের পানিতে ১০০ হয় মণ। অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রেও অন্তত ২০ ভাগ ফলন বেশি হয়।
কৃষক আব্দুল মাবুদ জানান, একটি খালের কারণে কয়েক হাজার একর জমি চাষাবাদের সুফল পাচ্ছে। চন্দনাইশ ছাড়াও সাতকানিয়ার কয়েকটি মাঠ এই একটি খালের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
একইভাবে সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নয়াখালটিও পুনঃখনন করা হয়েছে। এতে কৃষিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলার পাশাপাশি খালনির্ভর জীববৈচিত্র্যে ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য। স্থানীয় কৃষকরা জানান, খালটি ভরাট ও দখল হয়ে যাওয়ার কারণে দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে পূর্ব কাঞ্চনা বিলে বর্ষাকালে জলাবদ্ধতা ও শুষ্ক মৌসুমে সেচের পানির অভাবে কয়েকশ হেক্টর জমি দীর্ঘদিন ধরে অনাবাদি হিসেবে পড়ে আছে। বর্ষাকালে জলাবদ্ধতার কারণে আমন ধানের চাষাবাদ এবং বোরো মৌসুমে পানির অভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব হতো না। কিন্তু খালটি খনন করায় জলাবদ্ধতা নিরসন হয়েছে।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ ও সাতকানিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ভরাশঙ্খ-সাতছড়ি খাল। প্রায় ১৮ কিলোমিটার লম্বা এই খালটি বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে বৈলতলী, খাগরিয়া, সাতবাড়িয়া, দোহাজারী ও হাসিমপুর ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে শঙ্খ নদীতে মিশেছে। এই খালের উপরের অংশে বিভিন্ন পাহাড়ি ছড়ার পানি ও নিচের অংশে শঙ্খ নদীর জোয়ার-ভাটার প্রভাব স্পষ্ট। এতে পাহাড়ি ও সমতলের বিপুল পরিমাণ জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। অথচ দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে খালটি পুনঃখনন না হওয়ায় বর্ষায় জলাবদ্ধতা, শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে ভুগছিল কৃষি জমি ও জীববৈচিত্র্য।
চাষাবাদের পাশাপাশি খালের মাছ, কাঁকড়া, শামুকসহ নানা জলজ প্রাণী বিলুপ্তির পথে চলে গিয়েছিল। পুনঃখননের পর খালটির নাব্য ফেরার পাশাপাশি বিলুপ্তপ্রায় জলজ প্রাণীর দেখা মিলছে। ছোট মাছ, ব্যাঙ, জলজ উদ্ভিদসহ নানা প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন দোহাজারী জোনের সহকারী প্রকৌশলী মো. বেলাল হোসেন জানান, ২০২৪-২৫ অর্থ-বছরে ‘ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের মাধ্যমে সেচ উন্নয়ন প্রকল্প’-এর আওতায় নয়া খালটি দুই কিলোমিটার এলাকা পুনঃখনন করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় ৬০০ একর অনাবাদী জমি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। এছাড়া ভরাশঙ্খ-সাতছড়ি খালটিও ইতোমধ্যে ১২ কিলোমিটার এলাকা পুনঃখনন করা হয়েছে। এর ফলে প্রায় চার হাজার একর জমি জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়ে সেচ সুবিধার আওতায় এসেছে। খালের অবশিষ্ট ছয় কিলোমিটার চলতি অর্থবছরে খননের পরিকল্পনা রয়েছে।
সাতকানিয়ার কাঞ্চনা গ্রামের স্কুলশিক্ষক মোজাফফর আহমদ জানান, খালের পানি দিয়ে শুধু সেচ কাজই নয়। জোয়ারের সময় খালগুলোর মাধ্যমে কৃষিপণ্য ও গৃহস্থালি জিনিস নৌপথে পরিবহন করা সম্ভব হচ্ছে। যা স্থানীয় যোগাযোগ ও স্থানীয় অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন এনেছে।
প্রকল্প পরিচালক, প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম জানান, আগে কৃষি বলতে দেশের উত্তর ও দক্ষিণ অঞ্চলকে বোঝানো হতো। আর তাই কৃষির মানোন্নয়নে এখানে আগে তেমন বড় কোনো প্রকল্পও নেয়নি সরকার। কিন্তু এখন সেই ধারণা পাল্টাতে শুরু করেছে। পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বৃহত্তর চট্টগ্রামে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে।
তিনি বলেন, পাহাড়ের পাদদেশের এলাকাগুলো একটু বিশেষ এলাকা। তাই এখানকার চাষাবাদের পদ্ধতিও সমতলের সঙ্গে একটু আলাদা। পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ করলে ফলন হবে সমতলের চেয়ে বেশি। কয়েক বছর ধরে কাজ করতে গিয়ে সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে। কারণ এখানকার সব নদীই জোয়ার-ভাটার নদী। তাই খালগুলোতে পানির প্রবাহ আনতে পারলে ফলন হবে বেশি, খরচও কমবে। একই সঙ্গে মাটির ভূ-গর্ভস্থ পানি অপচয় থেকে রক্ষা পাবে।