আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ
চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডে একসময় নাম ছিল শুধু ‘শিবির ‘নাছিরের। বন্দুক, চাঁদাবাজি, খুন-সবকিছুর কেন্দ্র ছিল তার বাহিনী। সেই সাম্রাজ্য যখন ক্রসফায়ার, দলাদলি আর পুলিশি অভিযানে ধসে পড়ে, তখনই ধুলো–ধোঁয়ার ভেতর থেকে উঠে আসে নতুন এক নাম- সাজ্জাদ আলী খান। বয়স কম, ঝুঁকি নেওয়ার সাহস বেশি, আর সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল মাঠের ক্যাডারদের ওপর তার দখল। নাছিরের ছায়া থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে সে।
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে যখন নাছির বাহিনীর মৃত্যু-মিছিল শুরু হয়, তখন সাজ্জাদ ছিল মাঠের অন্যতম দৌড়ঝাঁপকারী। ক্যাডারদের একে একে হারাতে হারাতে যখন নাছির দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন সাজ্জাদ নীরবে শক্তি সঞ্চয় করে। যে গ্রুপটি একসময় ছিল নাছিরের, সেটিই ২০০০ সালের পর পুনর্গঠিত হয়ে যায় ‘সাজ্জাদ গ্রুপ’-এ। নাছিরের পতনই সাজ্জাদের উত্থানের দরজা খুলে দেয়-আর সে দরজা দিয়ে পা রেখেই শুরু হয় চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ডের নতুন অধ্যায়।
সেই নতুন অধ্যায়টি বদলে যায় এক ভয়ংকর কৌশল। আগে যেখানে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র, টেন্ডারবাজি বা গ্যাংভিত্তিক শক্তির ওপর নির্ভর করতো, এখন সেখানে ‘জামিন-নির্ভর কিলার রিক্রুটিং মডেল’ হয়ে উঠেছে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র। এই মডেলের কারিগর সেই সাজ্জাদ আলী খান ওরফে বড় সাজ্জাদ। মাঠে না থাকলেও জেল, কারাগার তারপর জামিন-সব মিলিয়ে তিনি তৈরি করেছেন একটি কিলার-রিসাইকেলিং নেটওয়ার্ক। আমার দেশ’র অনুসন্ধানে উঠে এসেছে ভয়াবহ এই নতুন চিত্র।
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, সাজ্জাদ বাহিনীর বর্তমান যেসব সদস্য এখন পেশাদার খুনি হিসেবে পরিচিত, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশই একসময় ছিলেন চুরি, ছিনতাই বা চাঁদাবাজির মতো সাধারণ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাওয়ার পর তাদের জামিনের প্রক্রিয়া দ্রুত করে দেন সাজ্জাদ বা তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা। জামিনে বের হওয়ার পরই তাদের জীবনে শুরু হয় দ্বিতীয় অধ্যায়। যা মূলত সাজ্জাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অপরাধচক্রে প্রবেশের পথ।
তদন্ত কর্মকর্তাদের ভাষ্য, জামিনপ্রাপ্তদের শুরুতে নজরদারি, মোটরসাইকেল চালানো বা অস্ত্র পরিবহনের মতো অপেক্ষাকৃত ‘লো-রিস্ক’ কাজ দেওয়া হয়। কয়েক মাস ধরে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হলে শুরু হয় আরও কঠোর প্রশিক্ষণ। অস্ত্র চালানো, পালানোর রুট মুখস্থ করা, টার্গেট শনাক্তকরণ-সবকিছুই ধাপে ধাপে শেখানো হয়। এরপরই তাদের ব্যবহার করা হয় লক্ষ্যভিত্তিক হামলা বা খুনের মতো উচ্চঝুঁকির কাজে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সাজ্জাদ বাহিনীর অপরাধচক্রে এভাবেই ছোট অপরাধী থেকে পেশাদার খুনিতে রূপান্তরিত হওয়ার একটি ধারাবাহিক ও সংগঠিত প্রক্রিয়া বহু বছর ধরে চলে আসছে।
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর রশিদ আমার দেশকে বলেন, ছোটখাটো অপরাধে যারা জেলে যায়, মুক্তির পর তাদের ওপর নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে। সন্ত্রাসী সাজ্জাদের হয়ে কারা কাজ করছে-পুরো নেটওয়ার্কই আমাদের পর্যবেক্ষণে আছে। সাজ্জাদ যাদের টার্গেট করে দলে টানছে, তাদের বিষয়েও আমরা আলাদা করে খতিয়ে দেখছি।
নগর পুলিশের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা (নাম প্রকাশ না করার অনুরোধে) জানান, এখন এক ধরনের ‘রিসাইকেল সিস্টেম’ গড়ে উঠেছে। ছোট অপরাধে ধরা পড়ে যে তরুণরা জেলে যায়, জামিনে বেরিয়ে তারা অনেকেই পেশাদার কিলার হয়ে ফিরে আসে। এই চক্রটিকে ভাঙা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে চট্টগ্রাম জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আশরাফ হোসেন চৌধুরী বলেন, পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করে, চার্জশিটে অনেক সময় তাদের নাম সঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। ফলে কয়েক মাসের মধ্যেই তারা বেরিয়ে আসে। দুর্বল মামলা দেওয়ার কারণে জেল থেকে বের হয়ে একই সন্ত্রাসীরা আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। আমাদের পরামর্শ-অপরাধীদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী ও টেকসই মামলা দেওয়া দরকার, যাতে তারা সহজে জামিন পেয়ে বের হতে না পারে।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, জেল থেকেই সাজ্জাদের নেটওয়ার্কে নতুন সদস্য ভেড়ানোর কাজটি এখন পরিচালনা করছেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ‘সাঙ্গু ওয়ার্ডে’ থাকা রাউজানের খোরশেদ এবং অক্সিজেন এলাকার হাসান। দুজনই বাকলিয়া ডাবল মার্ডারসহ একাধিক হত্যা মামলার আসামি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে আছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের মতে, কারাগারের ভেতর থেকেই তারা সাজ্জাদের নির্দেশনায় সম্ভাব্য সহযোগীদের শনাক্ত করেন এবং জামিনে বের হলে তাদের দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পথ তৈরি করে দেন।
বর্তমানে সাজ্জাদের হয়ে আলোচিত কয়েকজন ‘হিটম্যান’-রায়হান, মোবারক (ইমন), বোরহান, ছোট সাজ্জাদ এবং শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা-এই একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপরাধচক্রে ঢুকে পড়েন। এমনকি সম্প্রতি গুলিতে নিহত সরওয়ার হোসেন বাবলাও একইভাবে কারাগারে থাকা চক্রের প্রভাবে ধীরে ধীরে সন্ত্রাসী জগতে পা রাখেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তার বক্তব্য, সাজ্জাদের পুরো নেটওয়ার্কটি এখন এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে জেলে যাওয়া অনেক অপরাধীর জন্য এটি একধরনের ‘রূপান্তর কেন্দ্র’-যেখান থেকে বেরিয়ে তারা আরও সংগঠিত ও ভয়ংকর হয়ে ওঠে।
যেভাবে সাজ্জাদের কিলার হয়ে উঠলেন তারা
চট্টগ্রামে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পর্যবেক্ষণকারী একাধিক তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে-বর্তমানে ‘হিটম্যান’ হিসেবে সবচেয়ে আলোচিত চারজন হলো রায়হান আলম, ছোট সাজ্জাদ, মোবারক ইমন এবং শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা। শেখ হাসিনা আমলে সাজ্জাদের হয়ে কাজ করেছেন ম্যাক্সন ও সরওয়ার বাবলা। তবে নিজেদের মধ্যে বিরোধ তৈরি হওয়ায় এই দুজন পরে মূল গ্রুপ ছাড়তে বাধ্য হন। এরমধ্যে ম্যাক্সন ২০২২ সালে কলকাতায় মারা যান, আর সরওয়ার বাবলাকে চলতি বছরের ৫ নভেম্বর বায়েজিদের চালিতাতলী এলাকায় সাজ্জাদের অনুসারীরা গুলি করে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর ছোট সাজ্জাদ বড় সাজ্জাদ গ্রুপের কার্যত নেতৃত্ব পাওয়া শুরু করেন। হাটহাজারী শিকারপুর এলাকার মো. জামালের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন মাত্র চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে স্থানীয় একটি মুরগির দোকানে কাজ শুরু করেন। সেখান থেকেই তার জড়িয়ে পড়া চুরি ও ছিনতাইয়ে।
বড় সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগীর বর্ণনায় উঠে আসে-ছোট সাজ্জাদের অপরাধ জগতে দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয় জেল থেকেই। ছিনতাইয়ের অভিযোগে জেলে যাওয়ার পর কারাগারে থাকা বড় সাজ্জাদের লোকজন তাকে দলে ভেড়ানোর প্রস্তাব দেয়। শর্ত ছিল জামিনে বের হলেই সরাসরি বড় সাজ্জাদের হয়ে কাজ করতে হবে। সাজ্জাদ রাজি হওয়ার পর জামিনের সমস্ত ব্যয়ভার বহন করে গ্রুপটি। এরপরই তিনি যুক্ত হন বড় সাজ্জাদের দলে। দলে যোগ দিয়েই সাজ্জাদ সম্পৃক্ত হন ভয়ংকর কর্মকাণ্ডে। গত বছরের ২৯ আগস্ট এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের জেরে প্রতিপক্ষ বাবলার সহযোগী মো. আনিস ও কায়সারকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার অনন্যা আবাসিকে গুলি করে হত্যা করেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এ ঘটনায় দায়ের হওয়া দুই মামলাতেই তিনি প্রধান আসামি।
একই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর চাঁদা না পেয়ে অক্সিজেন কালারপুল এলাকার একটি নির্মাণাধীন ভবনে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়েন তিনি। পুলিশ তাকে ধরতে তৎপর হলে ৪ ডিসেম্বর অক্সিজেন এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালানো হয়। কিন্তু অভিযানের মধ্যেই সাজ্জাদ পুলিশকে গুলি করে পাশের ভবনের ছাদ বেয়ে পালিয়ে যান। এতে দুই পুলিশ সদস্যসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হন।
ঘটনার পর থেকে তিনি প্রকাশ্যে পুলিশকে চ্যালেঞ্জ করতে থাকেন। ২৯ জানুয়ারি নিজের ফেসবুকে বায়েজিদ থানার তৎকালীন ওসি আরিফুর রহমানকে অক্সিজেন এলাকায় প্রকাশ্যে পেটানোর হুমকি দেন। পরদিনই নগর পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন। অবশেষে ১৫ মার্চ ঢাকার একটি শপিং মলে স্থানীয় কয়েকজন তাকে আটকে পুলিশের হাতে তুলে দেন। কারাগারে গিয়েও সাজ্জাদ আলোচনায় থাকেন-বাকলিয়ায় জোড়া খুন, ঢাকাইয়া আকবর খুন এবং সর্বশেষ সরওয়ার বাবলা হত্যাকাণ্ডে তার সহযোগীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠে আসে।
ছোট সাজ্জাদের পর নিয়ন্ত্রণ নেন যারা
ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর চট্টগ্রাম শহরে নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয় তিনজন-রাউজানের রায়হান আলম, মোবারক ইমন এবং শহিদুল ইসলাম ওরফে বুইস্যা। এদের মধ্যে রায়হান সবচেয়ে সংগঠিত ও প্রভাবশালী। রাউজান ৭ নম্বর ইউনিয়নের জুরুরকুল খলিফা বাড়ির মৃত বদিউল আলমের ছেলে রায়হানের অপরাধজীবন শুরু মদ বিক্রি দিয়ে। পরে শেখ হাসিনা আমলে রাউজানের কুখ্যাত আজিজ বাহিনীর হয়ে কাজ করেন। এখান থেকেই তার পরিচয় ছোট সাজ্জাদের সঙ্গে। ছোট সাজ্জাদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর বড় সাজ্জাদ তাকে নিজের ডানহাতে পরিণত করেন।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, রায়হানের বিরুদ্ধে খুন, হত্যাচেষ্টা, চাঁদাবাজিসহ অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে শুধু গত ৫ আগস্টের পর তার বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ৮টি হত্যা মামলা। ৫ নভেম্বর বাবলাকে খুন করার আগেই ফোনে সরাসরি হুমকি দেন রায়হান-এমন অডিও তদন্তকারীদের হাতে রয়েছে।
মোবারক ইমন ও বুইস্যা বর্তমানে বড় সাজ্জাদের ডান-বাম হাত হিসেবে কাজ করছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা, চাঁদা আদায়, নিরাপদ রুট নিশ্চিত করা-সবকিছুই তাদের দায়িত্বে। এরমধ্যে মোবারক ইমন সাজ্জাদের অস্ত্রভাণ্ডার এবং অস্ত্র পরিবহনের দায়িত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
হাটহাজারীর চিমনদণ্ডী গ্রামের ছোট সাজ্জাদ এই নেটওয়ার্কের পুরনো সদস্য। অক্সিজেন এলাকার সোসাইটি পাড়া থেকে পুরো ওপারেশন পরিচালনা করেন হাসান। রাউজানে সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন রায়হান ও মোরশেদ। বায়েজিদের ২ নম্বর সাইট এলাকায় ‘ফিল্ড কমান্ডার’ হিসেবে পরিচিত বোরহান। যিনি মূল হ্যান্ডলারদের একজন। রাউজানের সাতিরকাটি এলাকার ইমন দীর্ঘদিন ধরে সাজ্জাদের ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সহকারী হিসেবে কাজ করছেন; তার বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজি ও অপহরণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
নগরের বায়েজিদের সোসাইটি পাড়ার তপু, সলারপুল–বাদামতল এলাকার আজম, ফালারপুলের মনির এবং ওয়াজদিয়া মোড়ের চেয়ারম্যানবাড়ির আজাদ-এই চারজন মাঠপর্যায়ের কর্মী হলেও গোপন অভিযানগুলোতে নিয়মিত অংশ নেন বলে স্থানীয় সূত্রের দাবি। চান্দগাঁওয়ের হাজীরপুল এলাকার হেলালও বহুদিন ধরে বাহিনীর হয়ে কাজ করছেন; তাকে এলাকাবাসী ভয় পেয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। আর বায়েজিদের চালিতাতলীর ওসমান ও সেগুন-দুজনকেই ‘কোর গ্রুপ’-এর সদস্য হিসেবে চেনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
চন্দনাইশের এক প্রভাবশালী বিএনপি নেতা, চান্দগাঁওয়ের একটি রাজনৈতিক পরিবারের দুই সদস্য এবং নজুমিয়া হাট এলাকার স্বেচ্ছাসেবক দলের এক নেতা-এই তিনজনকে সাজ্জাদ বাহিনীকে রাজনৈতিক সুরক্ষা দেওয়ার অভিযোগে চিহ্নিত করেছে স্থানীয়রা। তাদের আশ্রয়–প্রশ্রয়ের কারণেই ৫ আগস্টের পর এ বাহিনী ভয়ংকর হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে জোড়া খুনসহ অন্তত ১০টি হত্যাকাণ্ডে উঠে এসেছে সাজ্জাদ বাহিনীর সদস্যদের নাম। হাটহাজারী, রাউজান, বায়েজিদ, পাঁচলাইশ ও চান্দগাঁও-এই পাঁচ থানার প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে আতঙ্কে জীবনযাপন করছেন।
এই নেটওয়ার্কে যারা যোগ দিয়েছেন, তাদের অধিকাংশই আগে ছোটখাটো অপরাধে জড়িত ছিলেন। মোবারক (ইমন) বায়েজিদের বাসিন্দা। আগে চাঁদা তোলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। জামিনে বেরিয়ে ‘কাজের খোঁজে’ সাজ্জাদের কাছে গেলে অল্প সময়েই তার হাতে চলে আসে বিদেশি পিস্তল। এরপর থেকেই তাকে সামনে রেখে পরিচালিত হয় বেশ কয়েকটি চাঁদাবাজি ও হামলার ঘটনা। বোরহানের গল্প আরও গভীর। পেশায় ছিলেন গ্যারেজ মেকানিক। ২০১৮ সালে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সাজ্জাদের গাড়িচালক হিসেবে কাজে যোগ দেন। গাড়ির স্টিয়ারিং হাতে নিয়ে চলতে চলতেই পরিচয় হয় বাহিনীর খুন–দমনচক্রের সঙ্গে। পরে একাধিক হত্যাকাণ্ডে ‘সহকারী শ্যুটার’ হিসেবেও নাম আসে তার।
যেভাবে আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রক হলেন সাজ্জাদ
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে চট্টগ্রামের আন্ডারওয়ার্ল্ড ছিল শিবির ক্যাডার নাছিরের দখলে। তার বাহিনীর অন্যতম তরুণ সদস্য হিসেবে উঠে আসে সাজ্জাদ আলী খান। যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু নেছার বাহিনীর ফিল্ড অপারেটরই নয়, পুরো আন্ডারওয়ার্ল্ডের এক প্রভাবশালী নাম হয়ে ওঠে। নাছিরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা বিশাল নেটওয়ার্কে সাজ্জাদের চারপাশে ছিল ভয়ংকর সব সহযোগী-গিট্টু নাছির, হাবিব খান, আহমুদুল হক, হুমায়ুন, ইয়াকুব, বাইট্টা আলমগীর, দেলওয়ার ওরফে ‘আজরাইল দেলওয়ার’, ‘ফাইভ স্টার’ জসিম, ছোট্ট সাইফুল, বাইট্টা ইউসুফ, বিলাই সাইফুল, বিডিআর সেলিম, ভাগিনা রমজান, তসলিম উদ্দিন মন্টু, মনজুর আলম ও সারওয়ার আলম। ধীরে ধীরে নাছিরের দল ভেঙে পড়তে থাকলেও সাজ্জাদ টিকে যায় এবং প্রভাব বাড়াতে থাকে।
১৯৯১ থেকে ২০০৪-এই তেরো বছরে ক্রসফায়ার, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও পাল্টা হামলায় নাছির বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কেউ মারা যায়, কেউ দেশ ছাড়ে, কেউ জেলে যায়। কিন্তু সাজ্জাদ বাঁচতে থাকে প্রায় প্রতিটি সংঘর্ষ থেকে। ওই সময় থেকেই মাঠের ক্যাডারদের একাংশ তাকে কেন্দ্র করে পুনর্গঠিত হতে থাকে। নাছিরের দুর্বলতায় যখন আন্ডারওয়ার্ল্ড নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি হয়, তখনই সুযোগটি কাজে লাগায় সাজ্জাদ।
এই সময়টিতে সাজ্জাদের নাম জড়িয়ে পড়ে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে। ১৯৯১ সালে যুবলীগ কর্মী শ্যামল, জাফর ও দিদার হত্যা; ১৯৯৭ সালে ওমরগণি এমইএস কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের টার্গেট কিলিং; ১৯৯৯ সালে ওয়ার্ড কমিশনার লিয়াকত আলী খান খুন; ২০০০ সালের ১২ জুলাইয়ের সেই কুখ্যাত ব্রাশফায়ার। যেখানে আটজন নিহত হয়েছিল; একই বছরের ছাত্রলীগ নেতা আবুল কাশেম ও আবু তাহেরকে হত্যা-সব ক্ষেত্রেই উঠে আসে তার ভূমিকা। সবচেয়ে আলোচিত ২০০৪ সালের দুই বড় ঘটনায়ও তার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। ১১ এপ্রিল বন্দরের সাবেক চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম রাব্বানী হত্যা এবং কালুরঘাট শিল্প এলাকায় ৫৬ লাখ টাকা লুটের ঘটনা।
২০০৪ সালের ৩০ জুন বালুচরা এলাকায় নিজেদের গ্রুপের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে ছোট্ট সাইফুল, তার ভাই আলমগীর ও বোন মনোয়ারা বেগম খুন হয়। ওই সংঘর্ষের পর থেকেই পুরনো বাহিনী কার্যত ভেঙে পড়ে। ঠিক সেই সময়টিতেই ভয়, প্রভাব ও টিকে থাকার ক্ষমতায় অন্যদের ছাপিয়ে উঠে আসে সাজ্জাদ আলী খান। নাছির পরবর্তী শূন্য রাজনীতিতে সে হয়ে যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক। যে অবস্থান আজও বহু এলাকায় তার অনুসারীরা ধরে রাখছে।
পুলিশ বলছে, সাজ্জাদের দলে অর্থ আসে মূলত কর্ণফুলী নদীর বালুমহাল ও প্রবাসী ব্যবসায়ীদের হাত ঘুরে। কাতার ও দুবাই থেকে হুন্ডি পথে টাকা পাঠানো হয়। এই টাকায় জামিনের খরচ, অস্ত্র কেনা এবং নতুন সদস্য নিয়োগের খরচ মেটানো হয়। জব্দ হওয়া কয়েকটি পিস্তল ও রিভলভার ভারতীয় ও থাই নির্মিত বলে জানিয়েছে পুলিশ। প্রশাসন ও পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, জামিনপ্রাপ্ত অপরাধীদের পর্যবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে জামিনের পর তারা কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে-কেউ জানে না। এই ফাঁকটাই সাজ্জাদরা ব্যবহার করছে, বলেন জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, বর্তমানে বড় সাজ্জাদ ভারতের পাঞ্জাবে অবস্থান করছেন। সেখান থেকেই তিনি অনলাইন ও হোয়াটসঅ্যাপ কলের মাধ্যমে তার বাহিনীকে নির্দেশ দেন। নতুন সদস্য নিয়োগ, টার্গেট নির্ধারণ, এমনকি অর্থ পাঠানো-সব কিছুই হচ্ছে দূর থেকে।
সাজ্জাদ আলী খানের সঙ্গে একাধিক মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত রায়হান আলম আমার দেশকে বলেন, আমাকে যেসব মামলায় জড়ানো হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগই মিথ্যা। বিশেষ করে ডাকাইয়া আকবর সরোয়ার বাবলা হত্যাকাণ্ডে আমাকে দেখানো হয়েছে-যে ঘটনাটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
তিনি আরও বলেন, আমি কোনো হত্যাকাণ্ডে নেই। প্রমাণ হিসেবে অনেক সিসিটিভি ফুটেজ আমার কাছে আছে, যা সময়মতো আদালতে জমা দেব। আইনি লড়াই আমি করবো-তবে এখন নয়।
আত্মসমর্পণের প্রসঙ্গে রায়হান আলম বলেন, এখন যদি আত্মসমর্পণ করি, পুলিশ আমাকে আরও কয়েকটা মিথ্যা মামলা দিয়ে দেবে। এই কারণেই আপাতত আত্মসমর্পণ করছি না।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) তারেক আজিজ বলেন, আমরা এখন খুঁজে দেখছি, জামিনপ্রাপ্ত অপরাধীরা কোথায় যাচ্ছে এবং কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। বেশ কয়েকটি মামলা পুনরায় খোলা হয়েছে। জামিনের নামে যে নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে, সেটা ভেঙে না ফেললে সাজ্জাদের মতো চক্রগুলো থামানো যাবে না।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সৈয়দ শাহ শরীফ বলেন, যারা কারাগারে থেকে সন্ত্রাসী সাজ্জাদের হয়ে কাজ করছে তাদের বিষয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াবো। যদিও কাজটি কঠিন।