বাড়ির উঠানে বসে কেউ বাঁশ টুকরো করছেন। কেউবা বেতি তুলছেন। কেউ বেতি দিয়ে তৈরি করছেন ঝুড়ি, চাঁই, চালন, কেউবা টুবরি, কুলা, ডালি, আবার কেউ মাটি কাটার উড়া, চাটাই, পাখাসহ গৃহস্থালির বিভিন্ন ধরনের সামগ্রী তৈরি করছেন।
এসব পণ্য তৈরি করছেন বাজারে বিক্রির জন্য। জীবিকার তাগিদে এসব সামগ্রী তৈরিতে সারা বছরই ব্যস্ত সময় পার করছেন নারীরা। বংশ পরম্পরায় তারা এসব পণ্যসামগ্রী তৈরি করে আসছেন।
এসব সামগ্রী স্থানীয় হাট-বাজারসহ বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে ঘুরে বিক্রি করেন। বলছি বগুড়ার ধুনট উপজেলায় বাঁশ শিল্পের সঙ্গে জড়িত সহস্রাধিক গ্রামীণ নারীর জীবন সংগ্রামের কথা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, উপজেলার নলডাঙ্গা, পাকুড়িহাটা, বাঁশহাটা, চরপাড়া, কান্দুনিয়া, নাটাবাড়ি, ভুবনগাতী, রুদ্রবাড়িয়া, খাদুলী, জোলাগাতীসহ কমপক্ষে ১৪টি গ্রামের এক হাজারেরও অধিক নারী এ কাজের সঙ্গে জড়িত থেকে স্বামীর পাশাপাশি সংসারে বাড়তি আয়ে অবদান রাখছেন। বাড়িতে সারি সারি বসা এই নারী কারিগররা সুখ-দুঃখের কথা আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে শেষ করছে এক একটি পণ্য তৈরির কাজ। তাদের সঙ্গে কোনো কোনো পরিবারে পুরুষরাও সহযোগিতা করছেন।
উঠানে বসে বাঁশ-বেত দিয়ে একমনে পাতি তৈরি করছিলেন বেলিচা খাতুন। তিনি বলেন, আধুনিক পণ্যসামগ্রীর ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বাঁশ শিল্পের চাহিদা এখনো ফুরিয়ে যায়নি। শৌখিন ব্যক্তিরা এখনো এ শিল্পের জিনিস ব্যবহার করেন। আমরা বাবা-দাদার আমল থেকে এ পেশায় যুক্ত রয়েছি। এ পেশাকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছি। বেলিচা খাতুনের স্বামী-সন্তানসহ চারজনের সংসার। এর আয় থেকেই সংসারের যাবতীয় খরচ চলে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ধান কাটার মৌসুমে এসব পণ্যের প্রচুর কাজের চাহিদা থাকে। এ সময় সবাই রাত দিন কাজ করি। এছাড়া সারা বছরই বাঁশের তৈরি বিভিন্ন পণ্য হাট-বাজারে বিক্রি করা হয়। এগুলো বিক্রি করে যা আয় হয় তা দিয়ে চলে সংসারের যাবতীয় খরচ।
স্বপ্না খাতুন একই গ্রামের গৃহবধূ। স্বামীর সঙ্গে তিনিও হাতে হাত মিলিয়ে ঝুড়ি, চাঁই, বাঁশ-বেতের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করেন। স্বপ্না খাতুন বলেন, ছোটবেলা থেকেই ঝুড়ি, চাঁই, ধান-চাল রাখার গোলা, কুলা, ঢাকি, জালি তৈরি করছি।
অভাব অনটনের সংসারে লেখাপড়া তেমন করা হয়ে ওঠেনি। এ গ্রামেই আমার বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে এসব পণ্যসামগ্রী তৈরি করি। স্থানীয় বাজারে বাঁশের পণ্যসামগ্রীর প্রচুর চাহিদা আছে। প্রতি মাসে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা উপার্জন হয়। এ আয় দিয়ে কোনোমতে চলে যায়।
তিনি আরো বলেন, বাঁশ কেনা থেকে তৈরি করা এবং তা বিক্রি প্রতিটি কাজ আমাকেই করতে হয়। স্বামী সন্তানরাও এসব পণ্যসামগ্রী তৈরিতে আমাকে সহযোগিতা করে। পুঁজি ভালো থাকলে বিক্রিও ভালো হয়। সরকার এগিয়ে এলে এ শিল্পকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে শক্তিশালী করা সম্ভব।
স্বামীর অসুস্থতায় স্ত্রী ফেরেজা খাতুন এ ব্যবসার হাল ধরেছেন। ছেলেমেয়েরাও মাকে সহযোগিতা করে। ফেরেজার মতে, স্বামী ও ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসার। ঝুড়ি, কুলা, জালি তৈরি করি। প্রতি মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়। তিনি আরো বলেন, ধান কাটার মৌসুমে প্রচুর কাজের চাহিদা থাকে। সে সময় রাত-দিন সবাই মিলে কাজ করি। বছরজুড়ে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য হাট-বাজারে বিক্রি করি।
ধুনট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুন্নবী আকন্দ বলেন, নলডাঙ্গা গ্রামে দুই শতাধিক পরিবার বাঁশের বিভিন্ন সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। যতটুকু সম্ভব বাঁশ শিল্পকে ধরে রাখতে তাদের সার্বিকভাবে সহায়তা করা হয়। সরকারিভাবে যদি আর্থিক সহায়তা পায় তাহলে এলাকায় বাঁশ শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
এ বিষয়ে ধুনট উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা নাহিদা সুলতানা বলেন, বাংলার ঐতিহ্য বাঁশেরসামগ্রী টিকিয়ে রাখতে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক সহযোগিতা করা হবে। এছাড়া বাঁশ শিল্পনির্ভর নারীরা একত্রিত হয়ে সমিতি গঠন করলে তাদের পণ্য বিপণন কেন্দ্র করে দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হবে।