সাক্ষাৎকারে এমডি শওকত আলী খান
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব নেন শওকত আলী খান। এমডির দায়িত্ব নিয়েই নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সোনালী ব্যাংকে অল্প সময়ের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরান। আর গ্রাহকদের আস্থার নতুন উচ্চতায় নিতে কাজ করে যাচ্ছেন। ব্যাংকের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমার দেশ-এর সঙ্গে কথা বলেছেন এমডি শওকত আলী খান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রোহান রাজিব
আমার দেশ : দায়িত্ব গ্রহণের সময় সোনালী ব্যাংকের কী পরিস্থিতি ছিল?
শওকত আলী খান : আমি সোনালী ব্যাংকের দায়িত্ব নিয়েছিলাম একটি সংকটময় সময়ে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা তখন কিছুটা অস্থিতিশীল ছিল। আমার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। আমি শীর্ষ নির্বাহী ও সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলি, তাদের বোঝাই-সোনালী ব্যাংক দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সবাই সহযোগিতা করায় অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা ব্যাংকে শৃঙ্খলা ও একটি সুন্দর কর্মপরিবেশ ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হই।
আমার দেশ : ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ও গ্রাহকদের আস্থা সম্পর্কে জানতে চাই।
শওকত আলী খান : যখন দায়িত্ব নিই, তখন অন্যান্য সরকারি ব্যাংকের মতো সোনালী ব্যাংকের অনেক গ্রাহকের মধ্যেও কিছুটা হতাশা ছিল। তবে আমাদের টিমওয়ার্ক এবং স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার ফলে গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছি। এখন ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা সরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম ও যথেষ্ট শক্তিশালী। গ্রাহকদের আস্থার প্রতিফলন হিসেবে বর্তমানে আমানতের পরিমাণ প্রায় পৌনে দুই লাখ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে, যা আমাদের জন্য একটি ইতিবাচক অর্জন। আমি যখন দায়িত্ব নেই তখন আমানত ছিল এক লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আমানত বেড়েছে প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা।
আমার দেশ : খেলাপি ঋণের বর্তমান অবস্থা কী?
শওকত আলী খান : দেশের অন্যান্য ব্যাংকের তুলনায় সোনালী ব্যাংকে নতুন করে খেলাপি ঋণের হার তেমন বাড়েনি। আমরা সব সময় গ্রাহক নির্বাচনের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকি, যা ঋণের গুণগত মান ধরে রাখতে সাহায্য করেছে। আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে খেলাপি ঋণ ছিল ১৮ হাজার ৫৮ কোটি টাকা। এখন সামান্য কিছুটা বেড়ে ২০ হাজার ৬৫৬ কোটি টাকা হয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় খেলাপি ও অবলোপন ঋণ আদায়ে আমরা বিশেষ জোর দিয়েছি এবং ভালো সাফল্য পেয়েছি। এ ৯ মাসে খেলাপি থেকে ৮৯০ কোটি টাকা ও রাইট-অফ থেকে ছয় হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি সহায়তার আওতায় আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীর জন্য পুনঃতফসিলের অনুমোদনও পেয়েছি, যা ভবিষ্যতে ঋণ আদায়ে সহায়ক হবে।
আমার দেশ : ঋণ বিতরণে কোন খাতগুলোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন?
শওকত আলী খান : আমরা দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সব খাতে কাজ করছি, তবে বর্তমানে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি কিছু অগ্রাধিকার খাতেÑরপ্তানি খাত, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই), রমজান উপলক্ষে নিত্যপণ্য খাতে ঋণ বৃদ্ধি ও স্টার্টআপ উদ্যোক্তাদের সহায়তা। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে অর্থনীতিকে আরো সক্রিয় করা।
আমার দেশ : ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ে সোনালী ব্যাংক কতটা অগ্রসর?
শওকত আলী খান : আমাদের আইটি সেক্টর এখন অনেক সমৃদ্ধ। আমরা ডিজিটাল ব্যাংকিংকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি। গ্রাহকরা ঘরে বসেই অ্যাকাউন্ট খুলতে পারছেন, অনলাইনে লেনদেন করতে পারছেন। আমাদের কাস্টমার-ফ্রেন্ডলি অ্যাপ ‘সোনালী ওয়ালেট’ ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ প্ল্যাটফর্ম থেকে আমরা একটি নতুন ডিজিটাল ঋণ পণ্য ‘ন্যানো লোন’ চালু করেছি। এটি জামানতবিহীন ঋণ—গ্রাহকের ই-ওয়ালেট লেনদেনের ধরন, প্যাটার্ন ও আর্থিক সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে ঋণের পরিমাণ নির্ধারিত হয়। এটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টরে একটি নতুন দৃষ্টান্ত।
আমার দেশ : রেমিট্যান্স সংগ্রহ ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ব্যাংকের ভূমিকা কী?
শওকত আলী খান : সোনালী ব্যাংক দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ব্যাংক হিসেবে আমদানি-সংক্রান্ত প্রায় সব দায়িত্বই পালন করে। আমরা রেমিট্যান্স সংগ্রহে নিজেদের সোর্স যেমন- বিভিন্ন এক্সচেঞ্জ হাউস ও প্রবাসী আয় উৎসের মাধ্যমে কাজ করছি। আমাদের নীতি হলো- চাহিদার চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আহরণ না করা, কারণ অতিরিক্ত মূল্যে রেমিট্যান্স কেনা বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি করতে পারে। সোনালী ব্যাংক রেমিট্যান্স আহরণে পাঁচ বা ছয়ের মধ্যে থাকে। ভবিষ্যতে আরো কয়েকটি নিজস্ব এক্সচেঞ্জ হাউস বিদেশে খোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়ে।
আমার দেশ : ব্যাংকের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলবেন?
শওকত আলী খান : আমাদের লক্ষ্য সোনালী ব্যাংককে সব দিক থেকে সর্বোচ্চ অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। আমরা আইটি অবকাঠামো আধুনিকীকরণ করছি, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক ও এটিএম সম্প্রসারণ করছি। লক্ষ্য হলো- গ্রাহকদের কাছে সহজলভ্য, মানসম্মত ও আধুনিক সেবা পৌঁছে দেওয়া। সব কর্মচারীকে গ্রাহকবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছি।
আমার দেশ : জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
শওকত আলী খান : আমি বিশ্বাস করি- প্রতিটি কর্মীকে আগে নিজে স্বচ্ছ হতে হবে। যদি এই সংস্কৃতি তৈরি করা যায়, তাহলে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব। আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।
আমার দেশ : সম্প্রতি ব্যাংকিং খাত নিয়ে কিছু নেতিবাচক আলোচনা চলছেÑআপনার মতামত কী?
শওকত আলী খান : এটা সত্য যে, সাম্প্রতিক সময়ে কিছু ব্যাংকে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে, যা গ্রাহকদের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগ তৈরি করেছে। তবে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে কাজ করছে, যাতে ছোট আমানতকারীরা কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন। ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ সেই পরিকল্পনারই অংশ। আমি আশাবাদী এই সাময়িক হতাশা কেটে যাবে এবং ব্যাংকিং খাত শিগগির স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসবে।