একপাশে ইটের দেয়াল, দুই পাশে কয়েক টুকরো পাশে ভাঙা টিনের বেড়া, তার ওপরে আগুনে পোড়া টিন তুলে ছোট একটা খুপরি ঘর পেতেছেন নির্মাণ শ্রমিক মো. সেলিম। আর নিচের পাঁকা মেঝে থেকে তখনো আগুনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে কিছুটা।
আগের দিন সন্ধ্যায় ভয়াবহ আগুনে নিজ ঘরের মাত্র কয়েকখানা পোড়া টিন ছাড়া আর কিছুই বাঁচাতে পারেনি সেলিম। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে খোলা মাঠে রাত কাটানোর পর নিজ ঘরে ফিরেছেন, বেঁধেছেন ছোট ঘরখানাও। বুধবার সকালে গিয়ে দেখা যায় সেই ঘরেই চার সদস্যের পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সেলিম।
স্ত্রী সুমী গৃহকর্মীর কাজ করেন। প্রতিদিনের মতো বিকেল তিনটার পর বাসায় ফিরে রান্না শেষ করেছেন মাত্র। এরই মধ্যে আগুন আর চিৎকারের শব্দ শুনে ছুটেছেন প্রাণ বাঁচাতে।
সুমী বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, রান্না শেষ কইর্যা বাচ্চা দুইডারে মাত্র খাওয়াইতে বসছি। ওমনি দেহি আগুন। কোনমতে নিজেগো পরানডা লইয়া বাইচ্চা ফিরছি, আর কিছুই বাঁচাইতে পারি নাই।
সেলিম-সুমি দম্পতির জীবনে ভয়াবহ আগুনের ঘর পোড়ার অভিজ্ঞতা এই নতুন নয়। এই কড়াইল বস্তিতে সাত আট বছর আগেও একবার আগুনে পুড়েছিল সব।
তাদের মতো অসংখ্য পরিবার মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগুনে সব হারিয়েছেন। বুধবার সকালে আগুন পুরোপুরি নেভার পর অনেকেই নিজ ঘরে ফিরেছেন। পোড়া ঘরের আনাচে কানাচে খুঁজছিলেন প্রায় সবাই। যদি কিছু থাকে অক্ষত।
কড়াইলের এই বস্তির ঘরগুলোর বেশিরভাগই টিন, বাঁশ, কাঠের তৈরি। এর মধ্যে কোনটি একতলা, কোনটি দোতলা বা তিনতলা।
এই বস্তির বাসিন্দাদের বেশিরভাগই রিকশা চালক, নির্মাণ শ্রমিক, পোশাককর্মী, হকার বা দিনমজুর। বিকেলে আগুন লাগার সময় তাদের অনেকেই বাড়িতে ছিল না।
যে কারণে বস্তির ঘরগুলোর নারী কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরাও ঘরের জিনিসপত্র ফেলেই জীবন বাঁচানোর জন্য দ্রুত ঘর ছেড়েছিলেন।
বুধবার সকালে স্থানীয় বাসিন্দা, ফায়ার সার্ভিসসহ স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সাথে কথা বলেছে বিবিসি বাংলা। তাদের অনেকেই জানান, গত সন্ধ্যার আগুনে পুড়েছে প্রায় দেড় হাজারের মতো ঘর।
কিন্তু হঠাৎ করেই এই আগুন কেন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো বা নেভাতেও বা কেন এত সময় লাগলো পরদিন এই প্রশ্নও করেছেন কড়াইল বস্তির বাসিন্দারা।
সবাই খুঁজছে মাথার ওপর ছাদ
আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পর ফায়ার সার্ভিস তাদের অগ্নি নির্বাপণ অভিযান শেষ করে বুধবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে।
বুধবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায় রাতে খোলা মাঠ বা বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেওয়ার পর অনেকেই তাদের পোড়া ঘরে ফিরছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছেন অবশিষ্ট কিছু অক্ষত আছে কী-না।
কোথাও আগুন নেই। তবুও ছোট একটি বালতিতে পানি নিয়ে পুড়ে যাওয়া ঘরের মেঝেতে ঢালছিলেন সুমন হোসেন। তিনি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহকারীর কাজ করেন। আগের দিন আগুন লাগার সময় অফিসেই ছিলেন।
সুমনের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম কেন মেঝেতে তিনি পানি ঢালছেন?
তিনি জানান, স্ত্রী, বাবা-মা ও ছোট বোনকে নিয়ে তিনি থাকেন পাশাপাশি দুইটি রুমে। পুড়ে গেছে দুই রুমের সব বিছানা ও আসবাব পত্র। গত রাতে পুরো পরিবার নিয়ে ছিল খোলা আকাশের নিচে।
সুমন হোসেন বলছিলেন, আগুন নিভলেও ফ্লোর (মেঝে) অনেক গরম। পানি না ঢাললে এখানে দাঁড়ানোই যাচ্ছে না। আগে পানি দিয়ে ফ্লোর ঠাণ্ডা করে তারপর মাথার ওপর একটা ছাদের ব্যবস্থা করবো। এই শহরে তো আমাগো আর থাকার জায়গা নাই।
আশপাশে পোড়া টিনের চালা, পুরো কড়াইল বস্তিটি যেন একটি যেন একটি ধংসস্তুপ। ছোট ছোট গলি দিয়ে যাওয়া যায় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে।
এই আগুনে পুরো ঘরবাড়ি যেন এক হয়ে গেছে। নিচে পোড়া স্তূপ, নেই বাসা বাড়িতে ঘরের ছাদ। সকাল থেকে অনেকেই এসে শেষ সম্বলটুকু খুঁজতে দেখা গেছে।
তাদেরই একজন সাহিরা খাতুন বলছিলেন, দাউ দাউ কইরা আগুন দেইখ্যা এক মিনিটও দাড়াই নাই। এক কাপড়ে বাসা দিয়ে বাইর হইছি। শুধু জীবনডাই বাঁচাইতে পারছি, আর কিছু না।
আবার অনেককে দেখা গেছে, ঘরের মধ্যে দুয়েকটি জিনিস ছিল অক্ষত। সেগুলোকে যত্ন সহকারে অন্য কোথাও সরিয়ে নিতেও দেখা গেছে কাউকে।
তবে বেশিরভাগেরই ব্যস্ততা ছিল কোনভাবে যদি মাথার ওপর একটু ছাদ বানানো যায়, তাতে অন্তত আশ্রয় নেওয়া যাবে পরের দিনগুলো।