ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর পদে বসার মাত্র আট মাসের মাথায় শেখ হাসিনার পতন ঘটতে পারে-এমনটা বিশ্বাস করতেন না পলাতক প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহিন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরের পরও আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিদের সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হাসিনাকে আইনগত সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। সেনাপ্রধানের ভাষণের পর একটি রায় দিতে হতে পারে, হাসিনার পক্ষ থেকে এমন নির্দেশনাও ছিল তার ওপর। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র আমার দেশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, ভারতে পালানোর উদ্দেশ্যে ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা গণভবন ত্যাগ করার পর ওবায়দুল হাসান একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন ছেড়ে কাকরাইলের জাজেস কমপ্লেক্সে যান। এ সময় তার পরনে ছিল লুঙ্গি আর গেঞ্জি। এ অবস্থায় আত্মগোপনে থেকেই তিনি সুপ্রিম কোর্টের ফুল কোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান করেন। সরকারের উপদেষ্টা, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের নেতা ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা ওই ফুল কোর্ট সভাটিকে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও ভারতের চক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন। সরকারের পদক্ষেপ ও শিক্ষার্থীদের দৃঢ় অবস্থানের ফলে শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ওই সভাটি পণ্ড হয়ে যায়।
ছাত্রআন্দোলন দমানোসহ হাসিনার অবৈধ ও নিবর্তনমূলক নির্বাহী আদেশের অন্যতম সহযোগী তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুলের পলায়ন, ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান এবং পদত্যাগসহ নানা বিষয় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী, আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা, প্রধান বিচারপতির বাসভবন তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত গণপূর্ত অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে আমার দেশ।
তাদের বক্তব্যে উঠে আসে হাসিনার গত সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে ফ্যাসিবাদী হয়ে ওঠার পেছনে ওবায়দুল হাসানের ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে ১১টি মামলার ফরমায়েশি রায় প্রদান, নিজের ভাইকে দুই দফায় বিনাভোটে এমপি বানানো, বিতর্কিত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনে ভূমিকা রাখা, ডিবি হারুনের কাছ থেকে তরবারি ও ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে ফুলের তোড়া নেওয়াসহ নানা ধরনের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের চিত্র।
হাসিনার পতন ও পলায়নের আগে এবং পরে তাকে রক্ষায় ওবায়দুল হাসানের নানা উদ্যোগ ও পদক্ষেপের কথাও তুলে ধরেন তার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালনকারী কয়েকজন বিচারপতি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানার জন্য ওবায়দুল হাসানকে একাধিকবার কল করা হলেও তা তিনি রিসিভ করেননি। তাকে মেসেজ দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।
পরশু নয়, কালই লংমার্চ— কর্মসূচিতে বিচলিত হয়ে পড়েন
২০২৪ সালের আগস্টের শুরুতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো দেশ। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনের পক্ষ থেকে এক দফা দাবিতে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণা করেন ছাত্র নেতারা। এ লংমার্চের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ৬ আগস্ট। এ কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনে ৪ আগস্ট তারিখ এগিয়ে দিয়ে ঘোষণা করা হয় ‘পরশু নয়, কালকেই লংমার্চ টু ঢাকা’। ৫ আগস্টের সাত শব্দের এ কর্মসূচি নিয়ে রাত থেকেই বিচলিত হয়ে পড়েন ওবায়দুল হাসান। এ তথ্য জানিয়েছেন, প্রধান বিচারপতির দপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা।
ওবায়দুল হাসানের সঙ্গে আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চের বিচার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন এমন একজন বিচারপতি আমার দেশকে জানিয়েছেন, পরিস্থিতি আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। ৬ আগস্ট লংমার্চ ধরেই আমরা আদালতের কার্যক্রম কী হবে সেটা ঠিক করি। ৪ আগস্ট রাতে যখন ঘোষণা করা হলো, ‘পরশু নয় কালকেই লংমার্চ’, তখন আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। রাতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির আয়োজনে আমরা দুদফায় ভার্চুয়াল বৈঠক করি।
তিনি আরো বলেন, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়টি রাজনৈতিক হলেও প্রধান বিচারপতি সেটিকে আদালতে টেনে নিয়ে আসেন। ‘আন্দোলন করে উচ্চ আদালতের রায় পাল্টানো যাবে না’Ñ প্রধান বিচারপতির এমন বক্তব্যটিও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে। এছাড়াও হাসিনার পতনের ৫ দিন আগে অর্থাৎ ৩১ জুলাই দেশব্যাপী ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা। ওইদিন সুপ্রিম কোর্টে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী ওইদিন সুপ্রিম কোর্টের গেট ভেঙে আদালত কক্ষে প্রবেশ করে। ৪ আগস্টের শেষ ভার্চুয়াল বৈঠকে আমাদের মধ্যে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ কারণে ৫ আগস্ট আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখা হলেও প্রয়োজনে ভার্চুয়ালি আপিল বিভাগের কার্যক্রম পরিচালনায় সব ধরনের প্রস্তুতি রাখা হয়।
হাসিনার পক্ষ থেকে ৫ আগস্ট একটি রায় দেওয়ার নির্দেশ ছিল
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ওইদিন সকাল থেকেই রাজধানীর কাকরাইল মসজিদ-সংলগ্ন ১৯ হেয়ার রোডের সরকারি বাসভবনে অস্থির সময় কাটান।
সুপ্রিম কোর্ট বিচার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানিয়েছেন, আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও প্রধান বিচারপতি বাসভবনে বসে রায় লেখাসহ দাপ্তরিক কাজ করে থাকেন। প্রথা অনুযায়ী এসব কাজে আমরা তাকে সহযোগিতা করে থাকি। ওইদিনও আমরা আনুমানিক ১০টার দিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বাসভবনে যাই। ১১টা পর্যন্ত পরিস্থিতি আমাদের কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। কোনো জায়গা থেকেই লোক সমাগমের কোনো সংবাদ আমরা পাইনি। কিছুক্ষণ পর চারদিক থেকে হাজার হাজার মানুষ বিশাল মিছিল নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করছে— এমন তথ্য তাকে দেওয়া হয়। ওই সময় তিনি ভেতরের খাস কামরায় অবস্থান করছিলেন। সাড়ে ১২টার দিকে আমরা জানতে পারি, পুরো ঢাকা শহরে লাখ লাখ মানুষের মিছিল বিভিন্ন দিকে থেকে শাহবাগ ও শহীদ মিনারের দিকে যাচ্ছে। আমাদের গলা শুকিয়ে আসছিল। এগুলো তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে জানানোর পর তিনি বিচলিত হলেও আমাদের ছাড়ছিলেন না।
রায়ের বিষয়ে হাসিনার নির্দেশনার কথা জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, বেলা ১টার দিকে জানা যায়, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। এ সংবাদটি তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে দেওয়া হলে তিনি লাল টেলিফোনে কারো সঙ্গে কথা বলেন। ওই প্রান্তের কথা শুনে তিনি চুপ হয়ে যান। এরপর তিনি আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বৈঠক করবেন, এটি আমাদের জানানো হলে আমরা আয়োজন করে দিই। ভার্চুয়াল বৈঠকে সেনাপ্রধানের জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের প্রসঙ্গ ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি নির্দেশনা নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে আমাদের জানানো হয়, ‘সেনাপ্রধানের বক্তব্যের পর আবারও ভার্চুয়াল বৈঠক হবে’। প্রয়োজনে একটি রায় লিখতে হতে পারে বলে আমরা এমন একটি ইঙ্গিত পাই। তবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের আগেই চারদিক থেকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বাড়ির উদ্দেশে হাজার হাজার মানুষের মিছিল ধেয়ে আসছে, এমন সংবাদ পাওয়ায় আমরা নিজ দায়িত্বে ওই ভবন থেকে বের হয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করি।
সে সময় ওবায়দুল হাসানের বাসভবনে দায়িত্ব পালনকরী গণপূর্ত অধিদপ্তরের এক কর্মচারী আমার দেশকে বলেন, তৎকালীন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে তার স্ত্রী ও মা থাকতেন। দুই পাশের দুই গেটে ওইদিন ১৫ থেকে ১৬ জন পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। পাশাপাশি রমনা থানা থেকে বাড়তি নিরাপত্তাও দেওয়া হয়। বেলা আড়াইটার কিছু পর সব পুলিশ প্রধান বিচারপতির বাসভবন থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পালিয়ে গেলে পুরো এলাকাটি অরক্ষিত হয়ে পড়ে। এর কিছু সময় পর আমরাও ওই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাই।
লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে পালান ওবায়দুল
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্য, গৃহ পরিচারিকা, খানসামা, আর্দালি, ব্যক্তিগত সহকারীরা তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বাড়িতে যারাই ওইদিন ছিলেন, পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন। বাড়িতে থেকে যান ওবায়দুল হাসান, তার স্ত্রী নাফিসা বানু ও মা বেগম হোসনে আরা হোসাইন। হাসিনার নির্দেশ পালনে তখনও তিনি হেয়ার রোডের বাড়িটিতে অবস্থান করেন।
বাসভবন থেকে ওবায়দুলের লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে পালিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দেন তার সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালনকারী একজন বিচারপতি। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট সকাল থেকেই আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছিল। দুপুরের পর অবস্থা খারাপ হলে আমরা তাকে আগেভাগেই বাসভবন ত্যাগ করার অনুরোধ করি। কারণ আগের বছর (২০২৩ সাল) ২৮ অক্টোবর অনেক বড় ঘটনা ঘটেছে প্রধান বিচারপতির বাসভবনকে কেন্দ্র করে। তাছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে উন্মুক্ত আদালতে অনেক বিষোদ্গার ও তাচ্ছিল্যমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এগুলো তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বাসভবন ত্যাগ করার অনুরোধ করি। তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর (শেখ হাসিনা) নির্দেশের কথা জানিয়ে সেখানেই অবস্থান করার কথা জানান আমাদের।
ওই বিচারপতি আরো বলেন, বিকাল আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে লাখো মানুষের মিছিল যখন তার বাসভবনের কাছাকাছি চলে আসে তখন তিনি ভীষণ ঘাবড়ে যান। আমাকে ফোন করে তিনি উদ্ধারের কথা বলেন। জাজেস কমপ্লেক্সে থাকা অ্যাম্বুলেন্সটি তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য পাঠালে তিনি তাতে চড়ে স্ত্রী ও মাকে নিয়ে তার বাসভবনের পূর্বপাশের গেট দিয়ে বেরিয়ে মগবাজারের দিকে যেতে চান। রমনা থানার সামনে আটকা পড়েন। সেখান থেকে তিনি আবার ইউটার্ন করে জাজেস কমপ্লেক্সে চলে আসেন। তখন আমরা ৮/১০ জন বিচারপতি তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে একটি বাংলোতে নিয়ে যাই। ওই সময় তার পরনে একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জি ছিল। পরে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির বাসায় তাকে নেওয়া হয়। রাত সাড়ে ৮টার দিকে তিনি ওই অ্যাম্বুলেন্সে করেই স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে জাজেস কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে যান।
ওই বিচারপতি আরো বলেন, আমরা দেখেছি তৎকালীন প্রধান বিচারপতি তার বাসভবন থেকে বের হওয়া মাত্র দুই থেকে তিন মিনিট পর বিপুল ছাত্র-জনতা সেখানে ঢুকে পড়ে।
ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং নিয়ে বিতর্ক
হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার তিনদিন পর অর্থাৎ ৮ আগস্ট প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নেন। ৯ ও ১০ আগস্ট সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় উপদেষ্টারা ১১ আগস্ট রোববার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বুঝে নেবেন, এমনটিই ঘোষণা দেওয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। সরকারের দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার আগেই ১০ আগস্ট আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতিদের নিয়ে ফুলকোর্ট রেফারেন্স সভা আহ্বান করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। ‘অজ্ঞাত’ এজেন্ডা নিয়ে এ মিটিংটিকে বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত করে তাতে অংশ নিতে বেঁকে বসেন হাইকোর্ট বিভাগের ১১ জন বিচারপতি। আর সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগের ৭৯ জন বিচারপতি ফুল কোর্ট সভার বিষয়ে একমত পোষণ করেন বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের বিচার প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ডাকা ওই ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিংয়ের বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের তিনজন বিচারপতির সঙ্গে কথা বলে আমার দেশ। আমার দেশকে তারা জানান, সকালেই তাদের জানানো হয়, প্রধান বিচারপতি এমন একটি মিটিং ডেকেছেন। সকাল ৮টার দিকে আমরা সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে গিয়ে দেখি সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভার্চুয়াল মিটিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছেন। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে আমরা ১০ থেকে ১১ জন বিচারপতি সেখান থেকেই প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পর্যায়ক্রমে কথা বলি। তিনি এজেন্ডা সম্পর্কে আমাদের জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি ওই মিটিংয়ের বিষয়ে জানান, ‘আমি তৎকালীন প্রধান বিচারপতিকে (ওবায়দুল হাসান) বলেছিÑশেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। নতুন সরকার গঠনের বিষয়ে আপিল বিভাগ রাষ্ট্রপতির কাছে একটি অভিমত দিয়েছে। আপনার অবস্থানও অজ্ঞাত। কোথায় আছেন সেটা আমাদের কাছেও বলছেন না। দেশে এখন সরকার গঠন হয়েছে। আগে দেশটা স্থিতিশীল হোক, তারপর এ ধরনের মিটিং করা যাবে। এখন এ ধরনের মিটিংয়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই।’
ফুল কোর্ট ফেরারেন্স সভা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ওইদিন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া জানান, ‘এটি নিয়ে কারও সঙ্গে পরামর্শ করেননি প্রধান বিচারপতি। মনে করা হচ্ছে, স্বৈরাচারী পরাজিত শক্তির এটি একটি মুভ।’
যেভাবে পণ্ড হয় ওবায়দুল হাসানের সেই মিটিং
সুপ্রিম কোর্টের ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং আহ্বানের ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। ওইদিন সকাল সাড়ে ৮টায় আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল আইন দপ্তরে এসে যোগ দেন।
আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, ওইদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন (শনিবার) হওয়ায় সচিবালয় ছিল পুরোপুরি ফাঁকা। আমরা জানতে পারি, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার শিক্ষার্থী তৎকালীন প্রধান বিচারপতির ‘ফুলকোর্ট রেফারেন্স মিটিং’ ডাকার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্ট ঘেরাও করেছেন। তারা প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের দাবিও করছেন। এ অবস্থায় আইন উপদেষ্টা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নিজ দপ্তরে বসে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন।
ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, আইন উপদেষ্টা দপ্তরে যোগ দিয়েই বিচার বিভাগ ও সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা রক্ষায় সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান। পাশাপাশি তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে ওবায়দুল হাসানকে পদত্যাগের অনুরোধ জানান।
ফুল কোর্ট সভা স্থগিত করা এবং প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, আমি যতটুকু জেনেছিÑপ্রধান বিচারপতি ফুল কোর্ট সভা ডেকেছিলেন। তার কিছু ব্যাপারে প্রশ্ন ছিল। বিশেষ করে যখন এই ছাত্র আন্দোলন হয়, তখন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করা যায় কি না। এটি মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় ছিল খুব দুঃখজনক। সেটি হলো, তিনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর ছাত্রলীগের কাছ থেকে ফুলেল শুভেচ্ছা নিয়েছিলেন। এটি আচরণবিধির লঙ্ঘন ছিল। তিনি ডিবি পুলিশের সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের কাছ থেকে সোনার তরবারি উপহার নিয়েছিলেন। এ ছাড়া বিদেশে গেলে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাসায় থাকেন। এসব কারণে তাকে নিয়ে বিতর্ক ছিল।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল আরো বলেন, ‘এত বড় গণআন্দোলন হলো, যার মাধ্যমে ১৬-১৭ বছর ধরে জেঁকে বসা আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। এ রকম জায়গা থেকে আহ্বান আসার পর প্রধান বিচারপতির কী করা উচিত, সেটা তার ওপর ছেড়ে দিলাম।’
অবশেষে ব্যাপক বিতর্কের মুখে ওইদিন বিকেলে ফুল কোর্ট রেফারেন্স সভা বাতিল করে ওবায়দুল হাসান প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অব্যাহতি নেন। ওই মাসেই সরকার তার পাসপোর্ট বাতিল করে বলে জানিয়েছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
হারুনের তরবারি ও ছাত্রলীগের ফুলে আপ্লুত ওবায়দুল
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি থেকে ওবায়দুল হাসান ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর তাকে ছাত্রলীগের পলাতক সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। যা দেশব্যাপী তোলপাড় সৃষ্টি করে।
এই সমালোচনার মধ্যেই ২৮ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল হাসানকে তরবারি উপহার দেন আলোচিত ‘ভাতের হোটেলের মালিক’ খ্যাত ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ। ওই সময় ডিবিপ্রধান বলেন, আমাদের গর্বের ও অহংকারের নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান একজন গুণী মানুষ। তিনি তরবারি গ্রহণ করায় আমিও গর্বিত।
নিজে হন প্রধান বিচারপতি, ভাইকে বানান এমপি
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ওবায়দুল হাসান ১৯৯৬ সালে দলের মনোনয়নে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান। পরবর্তী সময়ে তাকে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাকে হাইকোর্ট বিভাগে অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ দেয়। এর দুই বছর পর তার হাইকোর্ট বিভাগের স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ হয়। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বিচারের জন্য বিচারপতি ওবায়দুল হাসানকে দায়িত্ব দেয় শেখ হাসিনার সরকার। তিনি ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়ে ১১টি মামলার রায় দেন। ২০২০ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন তিনি। ২০২৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ তাকে দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০১৮ সালের রাতের ভোট এবং ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচনের আগে তিনি নির্বাচন কমিশন গঠনে অনুসন্ধান কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন বলে জানান আইনজীবীরা।
উচ্চ আদালতের বিচারকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ছোট ভাই সাজ্জাদুল হাসানকে নৌকা প্রতীকে দুইবার জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা নেত্রকোনাবাসীর মুখে মুখে।
সূত্র জানায়, সাজ্জাদ ২০১৫ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সচিব হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১৮ সালে তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব করা হয়। ২০২২ সালে তাকে দিয়ে আওয়ামী লীগ দেশের বৃহৎ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি’ দখলে নেয়।
২০২৩ সালের ১১ জুলাই নেত্রকোনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য রেবেকা মমিন মারা গেলে ওই আসনে আওয়ামী লীগ ওবায়দুল হাসানের ভাই সাজ্জাদকে বিনা ভোটে সংসদ সদস্য করে নেয়। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারির ভোটেও এমপি হন তিনি। ওই নির্বাচনের দিন মোহনগঞ্জ মহিলা কলেজ কেন্দ্রে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ভোট দিতে যান ওবায়দুল হাসান। কেন্দ্রে ভোটার না দেখে সাংবাদিকদের বলেন, ‘দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার উপস্থিতি আরো বাড়বে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে দেশ এগিয়ে যাবে।’