হোম > ফিচার > সাহিত্য সাময়িকী

নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার শত বছর

সৈয়দ আবদাল আহমদ

‘বল বীর-

বল উন্নত মম শির!

শির নেহারি’ আমারি, নতশির ওই

শিখর হিমাদ্রির!’

কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতার লাইন।

নজরুলের দেশকাঁপানো এই কবিতা রচনার শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। তার অনন্যসাধারণ নির্মাণ এই বিদ্রোহী কবিতাটি নজরুল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পর রবীন্দ্রনাথ তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। এবার ২৫ মে আমাদের জাতীয় কবি নজরুলের ১২৬তম জন্মজয়ন্তী।

বিদ্রোহী কবিতা বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল রচনা করেন এই অনন্যসাধারণ কবিতা।

বিদ্রোহী কবিতা রচনার পর কবিতাটির প্রথম শ্রোতা ছিলেন নজরুলের বন্ধু কমরেড মুজাফফর আহমদ। নজরুল ভোরেই তাকে কবিতাটি শুনিয়েছিলেন। কমরেড মুজাফফর আহমদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ বইয়ে লিখেছেন, “আসলে বিদ্রোহী কবিতা রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে বড়দিনের ছুটিতে। প্রথম ছাপা হয়েছিল ‘বিজলী’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায়।” তিনি আরো লিখেছেন, ‘তখন নজরুল ও আমি নিচের তলার পূর্ব দিকের অর্থাৎ বাড়ির নিচেকার দক্ষিণ-পূর্ব কোণের ঘরটি নিয়ে থাকি। কবিতাটি নজরুল লিখেছিলেন রাতে; এক টানে। রাতের কোন সময় তা জানি না। রাত ১০টার পরে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলুম। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে আমি বসেছি এমন সময় নজরুল বলল, সে একটা কবিতা লিখেছে। পুরো কবিতাটিই সে আমাকে পড়ে শোনাল। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আমিই প্রথম শ্রোতা। আমার মনে হয়, নজরুল শেষ রাতে কবিতাটি লিখেছিল। তা না হলে এত সকালে সে আমাকে কবিতা পড়ে শোনাতে পারত না।... ঐ সময় নজরুল কিংবা আমার ফাউন্টেন পেন ছিল না। দোয়াতে বারে বারে কলম ডোবাতে গিয়ে তার মাথার সাথে তাল রাখতে পারবে না, এই ভেবেই সম্ভবত সে কবিতাটি প্রথমে পেনসিলে লিখেছিল।’

সেদিন ওই বাড়িতে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকার আফজালুল হকও আসেন। তাকেও কবিতাটি পড়ে শোনান নজরুল। তিনি সেটি শুনে একটি কপি সাথে নিয়ে যান। মুজাফফর আহমদ উল্লেখ করেন, “আমি বাইরে গিয়ে ১২টায় ফিরে এলে নজরুল জানায়, অবিনাশ দা এসেছিলেন। তিনি কবিতাটি শুনে বললেন, তুমি পাগল হয়েছ নজরুল, আফজালের কাগজ কখন বার হবে তার ঠিক নেই, কপি করে দাও, ‘বিজলী’তে ছেপে দেই আগে।” তাকেও নজরুল সেই পেনসিলে লিখেই কবিতাটি কপি করে দিয়েছিলেন। ১৩৯ পঙ্‌ক্তির এই কবিতা ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি বিজলী পত্রিকায় প্রথম ছাপা হয়। অবিরাম বৃষ্টির দিনেও পত্রিকার চাহিদা এত হয়েছিল যে, বিজলী দুইবার মুদ্রণ করতে হয়েছিল। পরে মুসলিম ভারতে ফাল্গুন মাসে আবার ছাপা হয়। বিজলী সম্পাদক অবিনাশচন্দ্র নজরুলের মুখে শুনে লিখেছেন, বিদ্রোহী ছাপা হওয়ার পরে নজরুল এটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পর তিনি সানন্দে নজরুলকে বুকে চেপে ধরে আশীর্বাদ করেছিলেন।

নজরুল-গবেষক জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের লেখা থেকে জানা যায়, ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তুরস্কের কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে।’ তাই বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে বিশ শতকে রবীন্দ্রপ্রভাব এত সর্বগ্রাসী হয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন।’ রবীন্দ্রধারা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক বাংলা কবিতার যে জন্ম হলো, বিদ্রোহী কবিতার মাধ্যমেই এর সূচনা। তার মতে, “গত একশ বছরে বহু আন্দোলন-সংগ্রামে কবিতাটি বাঙালিকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। কেবল ‘বিদ্রোহী’র জন্য হলেও নজরুল যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।” এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন, ইংরেজি সাহিত্যে টিএস এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’ ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এ কবিতা ইংরেজি কবিতার ধারা বদলে দেয়। আর নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা বদলে দেয় বাংলা সাহিত্যের ধারা। বাংলা সাহিত্যে ‘আধুনিক কবিতা’ বলতে আমরা যা বুঝি, তার পেছনে রয়েছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা।

নজরুল ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত নজরুল অ্যালবাম ১৯৯৪-এর ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ বিষয়ক দীর্ঘ লেখায় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে লিখেছেন, ১৯২১ সালের জুন মাসে কুমিল্লার দৌলতপুরে নার্গিসের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে দুঃখজনক ঘটনার পর নজরুল ১৭ দিন কুমিল্লায় ছিলেন। এ সময় ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে কুমিল্লা উদ্বেলিত ছিল। নজরুল ব্রিটিশবিরোধী সভা-সমাবেশে যোগ দিয়ে গাইলেন সদ্য রচিত ও নিজের সুর করা স্বদেশী গান ‘এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মা-র আঙিনায়’, ‘আজি রক্তনিশি ভোরে, একি শুনি ওরে, মুক্তি কোলাহল বন্দী শৃঙ্খল’ ইত্যাদি গান। ১৯২১ সালের নভেম্বরে কলকাতা থেকে নজরুল আবার কুমিল্লায় আসেন। অসহযোগ মিছিলে শহর প্রদক্ষিণ করে গাইলেন ‘ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও। ফিরে চাও ওগো পুরবাসী।’ কলকাতায় ফিরে গিয়েই রচনা করেন তার ঐতিহাসিক ‘ভাঙার গান’- ‘কারার ঐ লৌহকপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ এবং বিদ্রোহী কবিতা- ‘বল বীর, চির উন্নত মম শির।’ বাংলা কবিতা ও গানের ইতিহাসে অমন বলিষ্ঠ গান ও কবিতা আর রচিত হয়নি। বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশের পরপরই নজরুলের কবিখ্যাতি ও জনপ্রিয়তা অবিভক্ত বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিতে ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিরূপে যে খ্যাতি অর্জন করেন, হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এর নজির নেই।

বিদ্রোহী কবিতা নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যের ১২টি কবিতার একটি। ‘বিদ্রোহী’ এ কাব্যের দুই নম্বর কবিতা। অগ্নিবীণা কাব্যগ্রন্থেরও শতবছর পার হয়েছে। ‘বিজলী’ পত্রিকায় ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নজরুলের খ্যাতি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। তখন থেকেই ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে তার নাম হয়ে যায়। কবিতাটি হয়ে ওঠে নজরুলের কাব্যমূর্তির প্রতীক।

সেনাবাহিনীর চাকরি শেষ করে কলকাতায় ফিরে নজরুল সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেন। এ সময় তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, যারা সবকিছু ভেঙে নতুন করে গড়তে চাইছে, তাদের প্রেরণা জুগিয়েছিল নজরুল ইসলামের জ্বালাময়ী কবিতা ‘বিদ্রোহী’। বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলের বিদ্রোহ চেতনারই প্রকাশ ঘটেছে। তিনি বিদ্রোহ করেছেন ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে এবং শৃঙ্খল পরা আমিত্বের বিরুদ্ধে। পরাধীন ভারতবর্ষে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব ছিল ধূমকেতুর মতো।

বিশিষ্ট গবেষক মোরশেদ শফিউল তার ‘নজরুল জীবনকথা’ বইয়ে নতুন একটি তথ্য উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, নজরুলের জন্মগ্রাম চুরুলিয়ার কাছে সাঁওতাল পরগনার বিদ্রোহী পরিবেশও বিদ্রোহী নজরুলের প্রাথমিক চেতনাভূমি হিসেবে কাজ করেছে। নজরুলের জন্মের দশ বছর আগেই এ অঞ্চলে ঘটে ‘মুণ্ডা বিদ্রোহ’। এসব বিদ্রোহের গল্প ও গান চুরুলিয়া এবং আশপাশে বেশি বয়সি মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। নজরুল ছোটবেলায় এসব লড়াই-সংগ্রামের গল্প শুনেছেন। তার মনন গঠনে এটি কমবেশি প্রভাব ফেলেছিল।

কবি আল মাহমুদ এক সাক্ষাৎকারে নজরুল সম্পর্কে বলেছিলেন, কাজী নজরুল ইসলাম অসাধারণ কবিপ্রতিভা। তার বিদ্রোহী কবিতার মতো এমন কবিতা বাংলা সাহিত্যে বিরল। তাই তো কবি শামসুর রাহমান তার ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতায় লেখেন, স্বাধীনতা তুমি/কাজী নজরুলের ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা-

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব

ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে বিএম কলেজের প্রশাসনিক ভবনে তালা

অ্যাপেল ওয়াচ দেবে উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কে নোটিফিকেশন

ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসতার প্রতিবাদে জবি ছাত্রী সংস্থার মানববন্ধন

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বহুমাত্রিক গবেষণা অপরিহার্য: ইউজিসি চেয়ারম্যান

মেরুদণ্ড সমস্যা করণীয়

মোমের আলো ছড়ান জেবা

বিহারি নারীর ভাষান্তরের গল্প

ছাত্রদলের ৩০ জনের কমিটিতে সভাপতি-সম্পাদকসহ ১৮ জনই ছাত্রলীগের

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর বুয়েটছাত্র গ্রেপ্তার, কী হয়েছিল

আগামী সোমবার শাকসুর রোডম্যাপ: শাবিপ্রবির ভারপ্রাপ্ত ভিসি