মেয়েটির নাম সুমাইয়া আফরিন। তিনি একজন শেফ। শখের বশে কেক দিয়ে তিনি উদ্যোক্তা হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন। শুরুটি হয়েছিল ২০২০ সালে, করোনাকালীন সময়ে। আরো দক্ষভাবে ও উন্নতমানের কেক তৈরি করার জন্য প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেছিলেন তিনি। সেটি ছিল শর্ট কোর্স। প্রশিক্ষণ ও কাজের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে এই ভুবনে তার ছয় বছর হয়ে গেছে। এখন প্রফেশনাল পেস্ট্রি ও অ্যাডভান্স পেস্ট্রি নিয়ে কাজ করছেন। অনলাইনে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম বেকিং শপ বিডি।
কাজ শুরুর প্রথম তিন, চার মাসে অল্পকিছু কেক বিক্রি করতে পেরেছেন অনলাইন ও অফলাইনে। ২০২১ সালে তার জন্ম ও বসবাসের স্থান কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলায় একটি মেলা হলো। মেলাটি ছিল নারী দিবস উপলক্ষে, নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে। মেলায় নিজের তৈরি নানা ধরনের কেক নিয়ে অংশগ্রহণ করলেন সুমাইয়া। খুব ভালো সাড়া পেয়েছিলেন তিনি। সবাই তাকে চিনলেন ও জানলেন। কেক তৈরির কারিগরের ওপর আগ্রহ বাড়ল তাদের। এরপর থেকে তার কাজ দ্বিগুণ হয়ে গেল। কেক, পেস্ট্রি বিক্রিও বাড়তে শুরু করল অনেক।
এরপর তিনি উপজেলাপর্যায়ে আরো কয়েকটি মেলায় অংশগ্রহণ করলেন এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করলেন। কেক, পেস্ট্রি ছাড়াও পিৎজাসহ নানা ধরনের ডেজার্ট আইটেম নিয়ে দেড় বছর কাজ করেছেন সুমাইয়া। তার কাজ দেখে ও খাবারের অনন্য স্বাদে বুঁদ হয়ে অনেক নারী তার কাছে প্রশিক্ষণ গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের অনুরোধ ফেলতে পারেন না। তাদের শেখানোর জন্য বাসায় কেক ও পিৎজার শর্ট কোর্স করানো শুরু করেন। তবে তখন তাকে অনেক বাধার মোকাবিলা করতে হয়েছে। আত্মীয়স্বজন ও সমাজের অনেকে তার এই কাজ ও ব্যবসাকে বন্ধ করার জন্য অনেক চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউই কিছু করতে পারেননি। তিনি ভালোবাসা থেকে কাজ করেন ও ব্যবসা করেন। আর যারা ক্রেতা তারাও ভালোবাসা ও অতুলনীয় স্বাদ-গন্ধ থেকে ক্রয় করেন। নিজের ছোট দুই বোনকে এই কাজ পুরোপুরি শিখিয়েছেন সুমাইয়া। তারাও এখন খুব ভালো কেক, পেস্ট্রি, পিৎজা ইত্যাদি তৈরি করতে পারেন।
যারা সুমাইয়াকে দেখতে পারতেন না, তার কাজ নিয়ে না জেনে বিরোধিতা করতেন, তারা ভেবেছিলেন সুমাইয়ার বিয়ের পর ব্যবসা ও কাজ বন্ধ হয়ে যাবে । তবে সেটি হয়নি, হয়েছে তার উল্টোটি। সুমাইয়ার স্বামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এবং একজন রেস্তোরাঁকর্মী। তিনি বিয়ের পর থেকে স্ত্রীকে প্রচুর উৎসাহ দেন এবং নিজের কাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাকে অনুপ্রেরণা দিয়ে চলেছেন। এই প্রসঙ্গে সুমাইয়া বলেন, ‘আমার মনে হয় মেয়ে হয়ে কাজ করতে গেলে পরিবার ও স্বামীর সমর্থন থাকা জরুরি। তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া কোনো মেয়ের পক্ষে সামনে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না । আমি ভাগ্যবান যে আমার পরিবার ও স্বামী সবসময় আমাকে সমর্থন করে চলেছেন।’
কাজ করতে করতে একসময় তিনি খেয়াল করলেন, পেস্ট্রি ও বেকারির প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ছে। নিজেকে আরো ভালোভাবে গড়ে তোলার জন্য এবং আরো দক্ষতা অর্জনের জন্য সুমাইয়া প্রফেশনাল পেস্ট্রি বেকারির ওপর একটি শেফ কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপরও তিনি কোর্স করেছেন অ্যাডভান্স লেভেলের। ইয়েস ট্যুরিজম অ্যান্ড হোটেল ম্যানেজমেন্ট থেকে। এখন তিনি এ বিষয়ের একজন দক্ষ প্রশিক্ষক। এও তার ক্যারিয়ারের অনন্য অর্জন। প্রফেশনাল বেকিং, অ্যাডভান্স বেকিং, পিৎজা অ্যান্ড ফাস্টফুড, বেসিক টু অ্যাডভান্স কুকিজ, ডেনিস পেস্ট্রি, ফাইভ স্টার স্টাইল ডেজার্ট, মিষ্টি ও ডেজার্ট ইত্যাদি কোর্স হাতে-কলমে আগ্রহী নারীদের হাতে-কলমে শিখিয়ে চলেছেন। এই পর্যন্ত কুমিল্লার মুরাদনগর থানা ও আশপাশের এলাকার অন্তত এক হাজার নারী তার কাছে এই কোর্সগুলো করেছেন। তাদের বেশির ভাগ নিজ নিজ জায়গা থেকে বিভিন্ন ধরনের আইটেম তৈরি করছেন ও বিক্রি করে নিজেদের জীবনমান উন্নত করছেন। অন্য নারীদেরও তারা বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন।
সুমাইয়া আফরিন শেফ ফেডারেশন অব বাংলাদেশের আজীবন সদস্য। তিনি কুমিল্লার একটি ইনস্টিটিউশনে পেস্ট্রি বেকারি সেকশনে মাস্টার শেফ হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি জানালেন, এই কাজ আমাকে সচ্ছলতা দিয়েছে, নতুন পরিচয় দান করেছে। এই পথচলায় আমার স্বামী ও পরিবারের সমর্থন এবং ভালোবাসা আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস ও শক্তি জুগিয়েছে। তাদের উৎসাহ না থাকলে হয়তো আজ এতদূর আসা সম্ভব হতো না। আমার জীবনের প্রতিটি সাফল্যের পেছনে তাদের অমূল্য অবদান রয়েছে। আর আজ গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, ‘আমি আমার প্রিয় শখ থেকে পেশা তৈরি করতে পেরেছি। যেখান থেকে আমার পরিচয় তৈরি হয়েছে। আমার কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক নারী এখন নিজে উপার্জন করছেন। তারা তাদের পরিবারকে সহায়তা করছেন। সমাজে নিজের অবস্থান গড়তে পেরেছেন। এটিই আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ ও সার্থকতা। কেননা আমি চাই, প্রত্যেক সংগ্রামী নারী নিজের জায়গা থেকে কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখুন, সমাজে নিজের পরিচয় তৈরি করুন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের পেছনে টানার মানসিকতা এখনো আছে। কিন্তু আমরা যদি একে অন্যকে সাহায্য ও অনুপ্রাণিত করি, তাহলে পরিবর্তন নিশ্চিত। সব নারীর উদ্দেশে এই বার্তাÑআমরা নারী, আমরা পারি। আমার গল্প যদি আরো ১০টি মেয়েকে অনুপ্রাণিত করে, তাহলে সেটিই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।’
তিনি গত চার বছর প্রফেশনাল পেস্ট্রি ও বেকারি শেফ হিসেবে প্রশিক্ষণ দিয়ে চলেছেন।