বাকৃবির গবেষণায় তথ্য
দেশের পোলট্রি শিল্প গত তিন দশকে খাদ্য নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এক সময় গ্রামের উঠোনেই সীমাবদ্ধ থাকা হাঁস-মুরগি পালন এখন হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যিক খাতে রূপ নিয়েছে। মানুষের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ব্রয়লার মুরগির অবদান অনস্বীকার্য। তবে এই অগ্রগতির পেছনে একটি বড় সংকটও দ্রুত জটিল হয়ে উঠছে। খামারে নিয়ন্ত্রণহীন ও যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকি। ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) গবেষকদের গবেষণায় এ উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে।
গবেষণায় পাওয়া গেছে, মুরগির শরীরে গড়ে উঠছে ‘মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়া’, যা সুপারবাগ নামে পরিচিত। এটি মানুষের জীবনরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা নষ্ট করছে। শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পোলট্রি শিল্প এখন পরিবেশের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গবেষণা উঠে এসেছে, খামারে মুরগির দ্রুত বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ এবং উৎপাদন বাড়ানোর নামে অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় ও নিষিদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ওষুধের অবশিষ্টাংশ মুরগির মাংসে থেকে যায় এবং খাদ্যচক্রের মাধ্যমে মানবদেহে প্রবেশ করে। এতে মানুষের জীবনরক্ষাকারী অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
অনেক সময় দেখা যায়, মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক সঠিকভাবে কাজ করছে না। এই অকার্যকারিতার উৎস সবসময় মানবদেহ নয়, বরং প্রাণী, ফিড (পশুপাখির খাবার), কৃষি পরিবেশ ও খাদ্য উৎসে থাকা অণুজীবগুলো ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। পরে এসব প্রতিরোধী জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে সংক্রমণ ঘটায়।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘এশিয়ান-অস্ট্রালাশিয়ান জার্নাল অব ফুড সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটিতে’ প্রকাশিত এক বিস্তৃত পর্যালোচনা গবেষণায় এ উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন বাকৃবির ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম। এতে ২০১৭ সালে অধ্যাপক শফিকুলের নেতৃত্বে শুরু হওয়া গবেষণা কার্যক্রমের ১৩টি গবেষণাপত্রের পাশাপাশি ২০০০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে পোলট্রি শিল্প নিয়ে বিভিন্ন গবেষকের জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রের ফলাফল বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ গবেষণার রিভিউ আর্টিকেল প্রকাশ হয় গত ১৯ নভেম্বর।
গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের পোলট্রি খামারগুলো থেকে সংগৃহীত ‘ই. কোলাই’ ব্যাকটেরিয়ার নমুনার মধ্যে ৭৫ শতাংশেরও বেশি ‘মাল্টিড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট’ বা একাধিক ওষুধ প্রতিরোধে সক্ষম। আরো উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মুরগির অন্ত্রে ‘এমসিআর-১’ জিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এটি মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক কোলিস্টিনকে অকার্যকর করে দেয়।
খুচরা বাজার থেকে সংগৃহীত ব্রয়লারের মাংসের নমুনা বিশ্লেষণে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে। নমুনার ২২ শতাংশ মাংসে ফ্লুরোকুইনোলোন এবং ১৮ শতাংশে টেট্রাসাইক্লিনের অবশিষ্টাংশ পাওয়া গেছে, যা সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে অল্পমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক নিয়মিত শরীরে প্রবেশ করলে অ্যালার্জি, কিডনি-লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গের বিষক্রিয়া, অন্ত্রের মাইক্রোবায়োমের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এ কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে শরীর নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।
গবেষণার তথ্যমতে, দেশের ব্রয়লারের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের উৎপাদন করা। কিন্তু অধিকাংশ খামারি ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ না নিয়ে ফিড ডিলার বা ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কথায় মুরগিকে ‘সুরক্ষা ডোজ’ হিসেবে নিয়মিত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ান। এতে সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এনরোফ্লক্সাসিন, টেট্রাসাইক্লিনসহ বিভিন্ন ওষুধের অতিরিক্ত ব্যবহারে মুরগির মাংসে অনাকাঙ্ক্ষিত ওষুধ-অবশিষ্টাংশ থেকে যাচ্ছে।
একটি ব্রয়লার মুরগি পুরো জীবনচক্রে ১ দশমিক ৫ থেকে ২ কেজি বর্জ্য উৎপন্ন করে। বছরে ২০০ মিলিয়নের বেশি ব্রয়লার উৎপাদিত হওয়ায় বিশাল পরিমাণ বর্জ্য জমি ও জলাশয়ে অপরিশোধিত অবস্থায় ফেলা হচ্ছে। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ও নদীনালায় নাইট্রেট ও ফসফরাস দূষণ, ভূগর্ভস্থ পানির মান নষ্ট, অ্যামোনিয়া গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। যার মানুষের পাশাপাশি পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্যও মারাত্মক হুমকি।
অধ্যাপক শফিকুল বলেন, পল্ট্রি শিল্প দেশের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে পাশাপাশি লাখো মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি করেছে। তবে খামারে অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এ অর্জনকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এই সংকট মোকাবিলায় ‘ওয়ান হেলথ’ অর্থাৎ মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের স্বাস্থ্যকে একসঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া’ এই ধারণার বিকল্প নেই। কারণ, এই তিন বিষয় পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত; একটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাকি দু’টিও ঝুঁকিতে পড়ে। তাই আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের বিকল্প হিসেবে প্রোবায়োটিক, প্রিবায়োটিক ও কার্যকর ভেষজ উপাদান ব্যবহারের সুযোগ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি খামারে বায়োসিকিউরিটি জোরদার করা, নিয়মিত টিকাদান নিশ্চিত করা ও নিরাপদ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। খামারিদের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন করা এবং বাজারে এসব ওষুধের অবাধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে গবেষণায় উদ্ভাবিত টেকসই প্রযুক্তি খামারে ছড়িয়ে দিতে হবে, যাতে ভোক্তাদের জন্য নিরাপদ ও টেকসইভাবে উৎপাদিত মুরগির মাংস নিশ্চিত করা যায়।