পৃথিবীর বুকের গভীরে যখন সঞ্চিত শক্তি হঠাৎ মুক্তি পায়, তখন ভূত্বক কেঁপে ওঠে। আর সেই অদৃশ্য কম্পনের ঢেউকে দৃশ্যমান করে তুলতে যে যন্ত্র নিঃশব্দে কাজ করে যাচ্ছে, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার নাম—সিসমোগ্রাফ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল ১৭৬২ সালে, এপ্রিল মাসে। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৮.৫ । এই মাত্রা নির্ণয় করে সিসমোগ্রাফ। তখনকার ওই ভূমিকম্পের ফলে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড তিন মিটার উপরে উঠে আসে। এর আগে সেন্টমার্টিন আইল্যান্ড ছিল ডুবন্ত দ্বীপ। যাই হোক, আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় এই সিসমোগ্রাফ।
সিসমোগ্রাফের পথচলা
ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণের ইতিহাস যতটা রোমাঞ্চকর, ততটাই বৈজ্ঞানিক বিস্ময়ে ভরা।
হান রাজবংশের গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী চাং হেং ছিলেন এই ইতিহাসের প্রথম নায়ক। ১৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি উপস্থাপন করেন একটি অভিনব যন্ত্র ‘সিসমোস্কোপ’। একটি বিশাল ব্রোঞ্জের পাত্র, চারদিকে ড্রাগনের মাথা আর নিচে ব্যাঙের মুখ। কম্পন লাগলেই একটি ড্রাগনের মুখ খুলে বল ফেলত এবং ব্যাঙের মুখে পড়ে টং শব্দ তুলে জানিয়ে দিত ভূমিকম্প কোন দিক থেকে এসেছে। যন্ত্রটি কম্পনের তীব্রতা জানাতে পারত না, কিন্তু এটাই ছিল মানবজাতির প্রথম ভূমিকম্প-সতর্কবার্তা ব্যবস্থা।
সিসমোস্কোপ থেকে বৈদ্যুতিক সেন্সর
সময়ের সঙ্গে সিসমোগ্রাফের রূপ পাল্টেছে অসংখ্যবার। ১৮৫৫ সালে লুইগি পালমিয়েরি পারদভর্তি নলের সাহায্যে এমন এক যন্ত্র তৈরি করলেন, যেখানে কম্পন হলে বৈদ্যুতিক সার্কিট সক্রিয় হয়ে রেকর্ড রাখত। ১৮৭৫ সালে ফিলিপো সেচ্চি পেন্ডুলামের গতিবিধিকে সরাসরি কাগজে আঁকার ব্যবস্থা করেন—এতে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর কম্পন রেখাচিত্রে ধরা পড়ে। ১৮৮০ সালে জাপানে জেমস আলফ্রেড ইউইং, টমাস গ্রে ও জন মিলনে মিলে গড়ে তোলেন আধুনিক সিসমোলজির ভিত্তি। বিংশ শতাব্দীতে প্রেস–ইউইং সিসমোগ্রাফ দীর্ঘমেয়াদি কম্পনও সঠিকভাবে রেকর্ড করতে সক্ষম হয়, যা গবেষণায় যুগান্তকারী ভূমিকা রাখে। এখানে একটি ভুল ধারণা প্রায়ই দেখা যায়—রিখটার স্কেল উদ্ভাবন করেছিলেন চার্লস রিখটার, তবে তিনি সিসমোগ্রাফের আবিষ্কারক নন; তিনি শুধু ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপকে একক রূপে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন।
কীভাবে কাজ করে এই যন্ত্র?
সিসমোগ্রাফের প্রযুক্তি যেমন আধুনিক, এর মূলনীতি কিন্তু সরল। বলা যায় জড়তার সূত্র।
একটি ভারী ভর (পেন্ডুলাম বা প্রুফ মাস) স্থগিত থাকে বসন্ত বা তারের মাধ্যমে। যখন ভূত্বক কাঁপে, ফ্রেমটি নড়ে ওঠে, কিন্তু ভরটি জড়তার কারণে স্থির থাকার চেষ্টা করে। ঠিক এই আপেক্ষিক নড়াচড়া—কলম, ড্রাম বা সেন্সর, কোনো একটি মাধ্যমে রেখাচিত্রে পরিণত হয়, যাকে বলা হয় সিসমোগ্রাম। এসব সূক্ষ্ম রেখা বিশ্লেষণ করেই জানা যায়—কম্পনের ব্যাপ্তি, স্থায়িত্ব, তরঙ্গের গতি, উৎসস্থল (ইপিসেন্টার)।
ডিজিটাল যুগে সিসমোগ্রাফ
আজকের সিসমোগ্রাফ শুধু কাগজে দাগ টানা কলম নয়—এটি সুপারসেনসিটিভ বৈদ্যুতিক সেন্সর, ডেটা লগার এবং কম্পিউটার অ্যালগরিদমের সমন্বিত একটি ব্যবস্থা। এগুলো এতটাই সংবেদনশীল যে মানুষের অজান্তে ঘটে যাওয়া অতি ক্ষুদ্র কম্পনও রেকর্ড করা যায়। শুধু পৃথিবীতে নয়—চাঁদে অ্যাপোলো মিশনে, আর মঙ্গলে ইনসাইট ল্যান্ডারের মাধ্যমে সিসমোগ্রাফ বসানো হয়েছে। এর ফলে অন্য গ্রহের ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কেও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে।
মানবসভ্যতার সুরক্ষায় সিসমোগ্রাফ
আজ বিশ্বজুড়ে হাজারো সিসমিক স্টেশন ২৪ ঘণ্টা পৃথিবীর নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করছে।
এই যন্ত্র ভূমিকম্প পূর্বাভাস ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে, ভূতত্ত্ব গবেষণাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে, খনিজ অনুসন্ধান থেকে শুরু করে টেকটনিক প্লেটের গতিবিধি বোঝাতে অমূল্য তথ্য সরবরাহ করছে।