আপনি যখন ফেসবুকে স্ক্রল করছেন বা ইউটিউবে ভিডিও দেখছেন অথবা লন্ডনে থাকা বন্ধুর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছেন। তখন কি কখনো ভেবেছেন, এই ডেটা কীভাবে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে আপনার কাছে পৌঁছাচ্ছে? অনেকেই মনে করেন, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এসব হয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্বের প্রায় ৯৫-৯৯ শতাংশ আন্তর্জাতিক ডেটা ট্রান্সমিশন হয় সমুদ্রের তলদেশে বিছানো বিশেষ তারের মাধ্যমে। যাকে বলা হয় আন্ডারসি ক্যাবল বা সাবমেরিন ক্যাবল। এই অদৃশ্য প্রযুক্তি আধুনিক বিশ্বের মেরুদণ্ড। ইন্টারনেট, আন্তর্জাতিক ফোন কল, ব্যাংকিং লেনদেন, স্টক মার্কেট সবকিছুই নির্ভর করে এই সমুদ্রের তলদেশের তারের নেটওয়ার্কের ওপর।
আন্ডারসি ক্যাবলের ইতিহাস অনেক পুরোনো। ১৮৫০-এর দশকে প্রথম টেলিগ্রাফ ক্যাবল বিছানো হয় ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে ইংলিশ চ্যানেলের তলদেশে। এটি ছিল যুগান্তকারী উদ্ভাবন, যা দুই দেশের মধ্যে তাৎক্ষণিক যোগাযোগ সম্ভব করেছিল। ১৮৫৮ সালে আরো বড় সাফল্য আসে, যখন আটলান্টিক মহাসাগরের তলদেশে প্রথম ট্রান্স-আটলান্টিক টেলিগ্রাফ ক্যাবল স্থাপন করা হয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে। যদিও এটি মাত্র কয়েক সপ্তাহ টিকেছিল। তবু এটি প্রমাণ করেছিল যে মহাসাগর পার হয়ে যোগাযোগ সম্ভব। ১৮৬৬ সালে স্থায়ী ক্যাবল স্থাপন করা হয়, যা সফলভাবে কাজ করে। বিংশ শতাব্দীতে টেলিফোন ক্যাবল এবং পরে ১৯৮০-৯০-এর দশকে ফাইবার অপটিক ক্যাবল এই প্রযুক্তিতে বিপ্লব ঘটায়। আজকের আন্ডারসি ক্যাবলগুলো অত্যাধুনিক ফাইবার অপটিক প্রযুক্তিতে তৈরি, যা আলোর গতিতে ডেটা পরিবহন করে।
যেভাবে কাজ করে
আন্ডারসি ক্যাবলের মূল উপাদান হলো ফাইবার অপটিক তার। এই তারের ভেতর দিয়ে আলোর সিগন্যাল প্রবাহিত হয়, যা ডিজিটাল ডেটা বহন করে। একটি ক্যাবলে সাধারণত চার থেকে আটটি ফাইবার অপটিক তার থাকে। যদিও আধুনিক ক্যাবলে আরো বেশি থাকতে পারে। ফাইবার অপটিক তারের চারপাশে থাকে একাধিক সুরক্ষামূলক স্তর। ভেতরের দিক থেকে বাইরের দিকে এগুলো হলোÑফাইবার অপটিক কোর, প্লাস্টিক আবরণ, তামার নল, যা বিদ্যুৎ সরবরাহ করে রিপিটারগুলোয়, অ্যালুমিনিয়াম জলরোধী আবরণ, পলিকার্বনেট স্তর এবং সবচেয়ে বাইরে স্টিলের তার, যা শক্তি ও সুরক্ষা দেয়। গভীর সমুদ্রে ক্যাবল পাতলা হয়, কারণ সেখানে ক্ষতির ঝুঁকি কম। কিন্তু উপকূলের কাছে যেখানে জাহাজের নোঙর। মাছ ধরার জাল বা অন্যান্য কার্যক্রম হয়। সেখানে ক্যাবল অনেক মোটা ও শক্তিশালী করা হয়। ব্যাস, হতে পারে প্রায় ৭০ মিলিমিটার পর্যন্ত। প্রতি ৫০-১০০ কিলোমিটার দূরত্বে রিপিটার বা অ্যামপ্লিফায়ার বসানো হয়, যা সিগন্যালকে শক্তিশালী করে। এগুলো সমুদ্রের তলদেশেই থাকে এবং ক্যাবলের মধ্য দিয়ে আসা বিদ্যুৎ দিয়ে চলে। আধুনিক আন্ডারসি ক্যাবলের গতি অবিশ্বাস্য। একটি আধুনিক ক্যাবল প্রতি সেকেন্ডে ১০০ টেরাবিট বা তারও বেশি ডেটা পরিবহন করতে পারে। সহজ ভাষায়, এক সেকেন্ডে হাজারো HD মুভি পাঠানোর ক্ষমতা রয়েছে এই ক্যাবলগুলোর। ডেটা ট্রান্সফারের গতি প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি। সেকেন্ডে প্রায় দুই লাখ কিলোমিটার। তাই নিউ ইয়র্ক থেকে লন্ডনে একটি ডেটা প্যাকেট পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র ৬০-৭০ মিলিসেকেন্ড।
বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্ক
বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০০-৬০০টির মতো সক্রিয় আন্ডারসি ক্যাবল রয়েছে। যাদের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ১৩ লাখ কিলোমিটারের বেশি। এটি পৃথিবীকে প্রায় ৩৫ বার প্যাঁচিয়ে ফেলার মতো দৈর্ঘ্য। প্রধান কিছু ক্যাবল রুট হলো আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা। প্রশান্ত মহাসাগর পেরিয়ে এশিয়া-আমেরিকা এবং ভারত মহাসাগর পেরিয়ে এশিয়া-আফ্রিকা-ইউরোপ। কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্যাবল প্রজেক্ট যেমন : SEA-ME-WE (দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া-মধ্যপ্রাচ্য-পশ্চিম ইউরোপ) সিরিজ, যা এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই ক্যাবলগুলোর মধ্যে SEA-ME-WE-3, SEA-ME-WE-4 এবং SEA-ME-WE-5 বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশের সংযোগ
বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি আন্ডারসি ক্যাবলের সঙ্গে সংযুক্ত। প্রথম সংযোগ আসে ২০০৬ সালে SEA-ME-WE-4 ক্যাবলের মাধ্যমে। যার ল্যান্ডিং স্টেশন কক্সবাজারে অবস্থিত। এই ক্যাবল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, ভারত, মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ফ্রান্স পর্যন্ত বিস্তৃত। মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২০,০০০ কিলোমিটার। পরে ২০১৭ সালে SEA-ME-WE-5 ক্যাবলের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপিত হয়, যা আরো দ্রুত গতি ও অধিক ব্যান্ডউইথ ক্ষমতা প্রদান করে। এছাড়া বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে স্থলপথেও ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ কিনছে। এই আন্ডারসি ক্যাবল সংযোগের ফলে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের গতি ও মান উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশে এই সংযোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।